পোশাক কারিগরদের দম ফেলতে দিচ্ছে না ‘আলেয়া কাট-কাটল’
২১ মার্চ ২০২৪ ০১:৫৮ | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪ ১৩:১৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঈদুল ফিতর সামনে রেখে চট্টগ্রামের পোশাক কারিগরদের কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেছে। সময় ও আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত এখন কারিগররা। নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবার জন্য পোশাক তৈরি হচ্ছে কারিগরদের সুনিপুণতায়। দক্ষ হাতের কাজে বৈচিত্র্য এনে দিচ্ছে আধুনিক যন্ত্রাংশ। বলা যায়, একদমই দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না তারা।
বুধবার (২০ মার্চ) সকালে নগরীর দেওয়ানবাজার ওয়ার্ডের খলিফাপট্টি ও ঝাউতলা বিহারি পল্লির বুটিক হাউজগুলোতে গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়।
খলিফাপট্টিতে দেখা যায়, ছোট ও মাঝারি চার শতাধিক দোকানে দুই থেকে আড়াই হাজার কর্মচারী ঈদের পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এই পট্টিতে কেউ কাজ করছেন আট-দশ বছর ধরে, কেউ কাজ করছেন ১৫ বছর ধরে, কেউ বা কাজ করছেন প্রায় ২৫ বছর ধরে। অনেকে বংশপরম্পরায় যুক্ত হয়েছেন এই পেশায়। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তারা এখনো সেই পেশাই ধরে রেখেছেন।
কারিগররা জানাচ্ছেন, এবার ঈদে ‘আলেয়া কাট’, ‘কাটল’, ‘গাউন’, ‘নায়েরা’ ও ‘কুটি ফ্রকে’র মতো জামার কাজ তারা বেশি পাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি কাজ পাচ্ছেন ‘আলেয়া কাট’ ও ‘কাটলে’র। এর মধ্যে কাটল জামার পুরোটাতেই কাজ থাকে অ্যামব্রয়ডারির। আর আলেয়া কাটে সেই কাজ থাকে শুধু বুকে।
কারিগরদের তথ্য বলছে, একেকটি আলেয়া কাট জামা সেলাই করতে কারিগররা পারিশ্রমিক পান ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর কাটল জামা তৈরি করে পান ১০০ থেকে ১২০ টাকা। সাধারণত দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করলেও ঈদের জন্য এখন দিনে ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হচ্ছে কারিগরদের।
২২ বছর বয়সী মো. আল আমিন খলিফা পট্টির জান্নাতুল মাওয়া গার্মেন্টসে জামা সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন ১৪ বছর বয়সে। এরপর আট বছর ধরে একই কাজ করছেন কিনি। আল আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) ১৭ ঘণ্টা কাজ করেছি। দুপুর ১২টা থেকে একদম সেহেরি খাওয়ার আগ পর্যন্ত। এমনি সাধারণ সময়ে ১০ ঘণ্টার মতো কাজ করি। কিন্তু এখন সামনে তো ঈদ, তাই বেশি কাজ। এজন্য বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে।’
চেনা মুখ গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী মো. ওসমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের কাছে অর্ডার আসছে। ঢাকা থেকেও বিভিন্ন অর্ডারের কাজ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে এবার ঈদে মেয়েদের বেশকিছু জামার কাজ পেয়েছি। এর মধ্যে কাটেল জামার কাজ বেশি। দুই-তিন দিনের মধ্যে আরও অর্ডার পেতে পারি। কথাবার্তা চলছে।’
খলিফাপট্টি এলাকায় পোশাক তৈরির পাশাপাশি পাইকারিতেও বিক্রি হয়। দেখা যায়, দোকানে একপাশে ক্রেতাদের পছন্দমতো কাপড় দেখাচ্ছেন বিক্রয়কর্মীরা। কারিগরদের কেউ কাপড় কাটছেন, কেউ সেলাই করছেন, কেউ আবার ব্যস্ত কাপড় ইস্ত্রি করতে। এর মধ্যেই পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে পোশাক। কাটল জামা প্রতি পিস দুই হাজার টাকা আর আলিয়া কাট বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায়।
রুপনা ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী মো. ইমতিয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার ফ্যাব্রিক্সের (কাপড়) দাম অনেক বেশি। তাই আমাদের পোশাক তৈরিতে খরচ বেশি হয়েছে, পোশাকের দামও বেশি। এ কারণে আমরা এখনো তেমন বিক্রি করতে পারিনি। তবে আশা করছি, ঈদ যত সামনে আসবে পাইকারদের আসার হারও বাড়বে। তাতে বিক্রিও বাড়বে।’
খলিফা পট্টি বণিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি খন্দকার নুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যবসা এখনো জমে ওঠেনি। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা আসছেন। তবে গতবছরের তুলনায় এবার জামার দাম বেশি। কারণ এবার কাপড় বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এক গজ কাপড় যেখানে গত বছর ৫০ টাকা করে কিনেছে, সেটা এ বছর ৮০ টাকা করে কিনতে হয়েছে। দাম বেশি হওয়ায় বিক্রি এখনো কম হচ্ছে।’
‘১২ মাসে কেবল এই একটা মাসেই আমরা ভালো জামা-কাপড় বিক্রি করতে পারি। তাই আমরা আশা করছি, ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে ততই বিক্রি বাড়বে,’— বলেন খন্দকার নুরুল ইসলাম।
ব্যস্ততা বেড়েছে বুটিক হাউজগুলোতেও
ঈদ সামনে রেখে ব্যস্ততা বেড়েছে ঝাউতলা বিহারি পল্লির বুটিক হাউজগুলোতেও। এখানে ছোট-বড় ৪০টি বুটিক হাউজে কর্মরত প্রায় দুই শতাধিক কারিগর। ঈদ এলেই তাদের কর্মব্যস্ততা বেড়ে যায়। দিনরাত এক করে সমানতালে কাজ করতে হয় তাদের। এখানকার কারিগররা এখন থান কাপড়ের ওপর পুঁতি, পাথর ও চুমকি বসিয়ে তৈরি করছেন বৈচিত্র্যময় সব নকশার বাহারি শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিস, পাঞ্জাবিসহ অন্যান্য পোশাক।
ঝাউতলা বিহারি পল্লির সবচেয়ে বড় বুটিক হাউজ চয়েস বুটিকস। এ বুটিকসের স্বত্বাধিকারী মো. জালাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার এখানে ১৬ থেকে ১৭ জন কারিগর কাজ করে। আমরা সিজনাল ব্যবসা করি না। ১২ মাসেই আমাদের কাজ থাকে। তবে ঈদে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ব্যস্ততা অনেক বেশি থাকে। এবারও ব্যস্ততা বেশি। আমার এখানে নানা ডিজাইনের শাড়ি, থ্রিপিস, লেহেঙ্গা ও পাঞ্জাবিসহ কারুকাজে সজ্জিত পোশাক তৈরি হয়। এসব পোশাক ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের নামিদামি দোকান ও শোরুমে বিক্রি হয়।’
নাফিসা বুটিকসের এক কর্মচারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনো কোনো কাজ করতে দুই দিনও সময় লাগে। এ কাজগুলোর জন্য আমরা দেড় হাজার টাকা করে পাই। কাজগুলো খুব কষ্টের। এখানে শাড়ি, লেহেঙ্গা ও পাঞ্জাবির কাজ করা হয়। আমরা পাঁচজন এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। ভারত থেকে কাপড় এলে আমাদের কাজ ও অর্ডার কমে যায়।’
সায়রান বুটিকসে কাজ করেন মালেকা বেগম । তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিয়ের আগে থেকেই আমি এ কাজ করি। প্রতিটি কাজের জন্য ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা বা কোনো কোনো কজের জন্য এক হাজার টাকাও পাওয়া যায়। এর মধ্যে কারিগরদের প্রায় অর্ধেক দিয়ে দিতে হয়। এখন কাজ বাড়ছে, তাই ব্যস্ততাও বেশি। দম ফেলবার ফুরসত নেই।’
সারাবাংলা/আইসি/টিআর
আলেয়া কাট ঈদ ঈদ বাজার ঈদুল ফিতর ঈদের পাঞ্জাবি ঈদের পোশাক কাটল খলিফা পট্টি বিহারি পল্লি বুটিক হাউজ