চট্টগ্রাম ব্যুরো: দুইদিন আগে উদীচী কেন্দ্রীয় কমিটির সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিস্তারিত ব্যাখা দিয়েছে চট্টগ্রামের সংগঠনটির বিবদমান দু’পক্ষের একাংশ। চট্টগ্রামে উদীচীর দুটি পক্ষ সক্রিয় আছে। একপক্ষে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আছেন জসীম চৌধুরী সবুজ ও অসীম দাশ। অপরপক্ষে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডা. চন্দন দাশ ও শীলা দাশগুপ্তা।
শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জসীম-অসীমের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া সংগঠন থেকে ‘বহিষ্কৃত’ ১০ জন সদস্য উদীচীর নাম ভাঙিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করছেন বলে দাবি করা হয়।
রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির এ বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন উদীচী চট্টগ্রাম জেলা কমিটির অপর অংশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি চন্দন দাশ ও সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা।
এতে বলা হয়েছে, সংবাদ সম্মেলনে উদীচী চট্টগ্রাম জেলা কমিটি হিসেবে যাদের (জসীম চৌধুরী সবুজ ও অসীম দাশ) পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের গঠনতান্ত্রিক কোনো বৈধতা নেই। এ অবৈধ কমিটিকে কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা না করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
কেন্দ্রীয় কমিটির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল, ২০১৯ সালে জাতীয় সম্মেলনে উদীচী চট্টগ্রাম জেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
এই তথ্য সর্বতোভাবে মিথ্যা উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদ বিলুপ্তির কোনো বৈধ এখতিয়ার কেন্দ্রীয় কমিটির নেই। গঠনতন্ত্র অনুসারে শুধুমাত্র জাতীয় পরিষদ তদন্ত কমিটি গঠন করে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে এটা করতে পারে।’
‘উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি শাখাকে নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির এ ধরনের অগঠনতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের নিন্দায় চট্টগ্রামসহ সারাদেশের সকল উদীচীকর্মীর পাশাপাশি প্রগতিশীল সুধীসমাজ সোচ্চার হয়েছিল। বিতর্কিত এ কর্মকাণ্ডের দায় এড়াতে কেন্দ্রীয় কমিটি জাতীয় সম্মেলনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সংবাদ সম্মেলন করে মিথ্যাচার করেছেন।’
সংবাদ সম্মেলনে কয়েকজন সদস্যকে বহিষ্কারের বিষয়ে দেওয়া তথ্য অর্ধসত্য, অতিরঞ্জিত এবং মানহানিকর বলে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কেন্দ্রীয় কমিটি কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও জাতীয় পরিষদের অনুমোদন ব্যতীত সেটি চূড়ান্ত হয় না। বিষয়টি এখনও সমঝোতামূলক সমাধানকল্পে আলাপ-আলোচনার পর্যায়ে আছে। এর অংশ হিসেবে গত ৩০ আগস্ট কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে একটি চিঠিও পাঠানো হয়েছে।’
‘কিন্তু জবাবের অপেক্ষা না করেই একদিনের ব্যবধানে আকস্মিক সংবাদ সম্মেলনকে কেন্দ্রীয় কমিটির স্ববিরোধী আচরণ বলে আমরা মনে করি। যাদের প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিলের বিষয় বলা হয়েছে, তারা সবাই চট্টগ্রামে উদীচীর নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক, তারাই চট্টগ্রামে উদীচীর চালিকাশক্তি।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘২০২১ সালে কেন্দ্রীয় কমিটি অনলাইনে অগণতান্ত্রিক ও রীতিবিরুদ্ধ সভা করে একটি কেন্দ্র আরোপিত আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করে। এটিও অগণতান্ত্রিক এবং রীতিবিরুদ্ধ। এ কমিটি সাধারণ সদস্যরা প্রত্যাখান করলেও ১১৯ জন বৈধ সদস্যের আবেদন-মতামতকে পাশ কাটিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি তথাকথিত সম্মেলনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে একটি কমিটি (জসীম-অসীমের নেতৃত্বাধীন) গঠন করে। সেই সম্মেলনেরও গঠনতান্ত্রিক কোনো বৈধতা নেই।’
‘কোনোদিন উদীচীর কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত না থাকা, প্রগতিশীল, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্কহীন কিছু ব্যক্তিকে দিয়ে কমিটি বানিয়ে এখন সংবাদ সম্মেলন করে বলছে, তাদের সহযোগিতা দিতে। উদীচীর মতো একটি সংগঠনের জন্য এর চেয়ে লজ্জা, অপমানের আর কিছুই হতে পারে না।’
‘এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে, গণমানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কহীন ভাড়া করা লোক দিয়ে সংগঠন চালাতে গেলে এমন হতাশাজনক পরিস্থিতিই সৃষ্টি হয়। যুগ যুগ ধরে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উদীচীর আদর্শের পতাকা উড্ডীন রাখা নিষ্ঠাবান কর্মীদের বাদ দিয়ে কিছু সুবিধাবাদী, পদলোভী ব্যক্তিকে জড়ো করে সংগঠন চালানো কার্যত সত্যেন সেন-রণেশ দাশগুপ্তের আদর্শের সঙ্গে বেঈমানি করা বলে আমরা মনে করি।’
এ অবস্থায় চট্টগ্রামে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে চন্দন দাশ ও শীলা দাশগুপ্তা বিবৃতিতে বলেন, ‘চট্টগ্রামের সুধীমহল অবগত আছেন, কারা উদীচীর মূলধারার প্রকৃত আদর্শবান কর্মী আর কারা পদ-পদবি এবং সুযোগ-সুবিধার লোভে জড়ো হয়েছে। চট্টগ্রামের সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংস্কৃতিকর্মী, সংস্কৃতি-অনুরাগী সুধীসমাজ, সরকারী বেসরকারী সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, শ্রেণি-পেশা’র সংগঠনসহ সকলের প্রতি আমাদের উদাত্ত আহ্বান, আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। শত ষড়যন্ত্র, বাধা মোকাবিলা করে আমরা উদীচীর আদর্শের পতাকাকে সমুন্নত রেখে সংস্কৃতির সংগ্রামকে চট্টগ্রামে এগিয়ে নিয়ে যাব।’
‘স্পষ্টভাবে ও দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, এ সংবাদ সম্মেলনে উদীচী চট্টগ্রাম জেলা কমিটি হিসেবে যাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের গঠনতান্ত্রিক কোনো বৈধতা নেই। সুতরাং এ অবৈধ কমিটিকে কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা না করার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।’
উদীচীর কেন্দ্রীয় কমিটির ‘দুষ্টচক্রের’ বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার ঘোষণা দিয়ে তারা বলেন, ‘দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, উদীচীর কেন্দ্রীয় কমিটিতে নীতি-আদর্শহীন, ক্ষমতালোভী একটি দুষ্টচক্র বেশ কিছুদিন ধরে সক্রিয় আছে, তাদের সঙ্গে চট্টগ্রামেও যুক্ত হয়েছে পর্দার আড়ালে থাকা আরও কিছু কলুষিত ব্যক্তি-মহল।’
‘এই দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে চট্টগ্রামের নিবেদিতপ্রাণ উদীচী কর্মীদের হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে বারবার। দেশজুড়ে আপামর উদীচীর নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা ও কেন্দ্রীয় কমিটির আদর্শবান সদস্যবৃন্দ এই দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে সোচ্চার হয়েছেন, যে লড়াইটা আমরা চট্টগ্রাম থেকে শুরু করেছি সেটা ক্রমে সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে, যার ফলশ্রুতিতে দুষ্টচক্রের মুখোশ খুলে গেছে।’
এই দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চট্টগ্রামের সুধীসমাজকে পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের একাংশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি চন্দন দাশ ও শীলা দাশগুপ্তা।