কক্সবাজারে পানিবন্দি ৪৫টি ইউনিয়নের সাড়ে ৪ লাখ মানুষ
৮ আগস্ট ২০২৩ ১৭:২৬ | আপডেট: ৮ আগস্ট ২০২৩ ১৮:০৬
কক্সবাজার: কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে নতুন করে আরও বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) দুপুর পর্যন্ত জেলার সাতটি উপজেলার কমপক্ষে ৪৫টি ইউনিয়নের সাড়ে চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানির কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
আবহাওয়া অফিসের কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের জৈষ্ঠ্য পর্যাবেক্ষণ কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র দাশ জানিয়েছেন, সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৭ মিলিমিটার। বৃষ্টি আরও তিন দিন অব্যাহত থাকবে। এতে পাহাড় ধসের আশংকাও রয়েছে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারের প্লাবিত ইউনিয়নের সংখ্যা ছিল ৩১ টি। যা মঙ্গলবার এসে ৪৫ ইউনিয়নে প্লাবিত হওয়ার তথ্য মিলছে। যেখানে ছয় হাজারের বেশি পরিবারের সাড়ে ৪ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন।
জেলায় সবেচেয়ে বেশি প্লাবিত এলাকা চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায়। যে দুই উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ২৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়া তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে অন্তত আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢলে সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন ও কাকারা ইউনিয়ন ৪-৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে। জিদ্দাবাজার-কাকারা-মানিকপুর সড়কের কয়েকটি অংশের ওপর দিয়ে মাতামুহুরী নদী থেকে উপচে আসা ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় বসতঘরগুলো পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। শুকনো খাবার ছাড়া রান্নার কোন ব্যবস্থা নেই গত দুইদিন ধরে।
চকরিয়ার লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী, ফাঁসিয়াখালী, বদরখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী এবং পেকুয়া উপজেলার পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, উজানটিয়া, মগনামা, রাজাখালী, টৈটং, শিলখালী, বারবাকিয়া ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পেকুয়ার সদর ইউনিয়নের মেহেরনামার বেঁড়িবাধটি ভেঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানি লোকলয়ে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এসব ইউনিয়নের নিচু গ্রামগুলোতেই পানি উঠেছে অধিক।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, অতি বৃষ্টির কারণে পৌরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ড পানির নিচে তলিয়ে গেছে। স্ব-স্ব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা পানি যাতে দ্রুত নিচের দিকে নেমে যায়, সেজন্য কাজ করছে। এছাড়াও ৯নং ওয়ার্ডের ১নং বেঁড়িবাঁধটি রক্ষার জন্য বালির বস্তা ফেলা হচ্ছে।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম ও কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন জানান, আমাদের ইউনিয়নগুলো মাতামুহুরী নদীর সঙ্গে লাগোয়া। এজন্য পাহাড় থেকে নেমে ঢলের পানি আগে আঘাত আনে এসব ইউনিয়নগুলোতে। এই দুই ইউনিয়নে অধিকাংশ ঘর পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। গত দুইদিন ধরে তাদের রান্নার কাজও বন্ধ। শুধু শুকনো খাবার খেয়ে রয়েছে।
শীলখালী ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। লোকজন পানিবন্দি হয়ে আছেন।
টইটং ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদ চৌধুরী জানান, টানা বৃষ্টির পানিতে আমার ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে অনেক পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে।
পেকুয়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাঙা অংশ মেরামত করা না হলে আরও ভয়াবহ হবে পেকুয়ার জন্য। দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পূর্বিতা চাকমা জানান, সকাল থেকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন সরজমিন পরিদর্শন করেছি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। তাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থার জন্য ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেছেন, বন্যা কবলিত প্রায় এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী প্রায় দেড় লাখ লোক পারিবন্দি রয়েছে। বন্যা কবলিত মানুষদের নিকটস্থ আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। যেসব মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে তাদেও বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এছাড়াও যারা ঘরবাড়ি ছেলে আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে চাচ্ছে না সেসব পরিবারগুলোকে প্রাথমিকভাবে শুকনো খাবার দিতে সকল চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছি। চকরিয়ার বন্যার ব্যাপারে জেলা প্রশাসককে অবহিত করে ত্রাণ বরাদ্দ চেয়েছি।
এছাড়া রামু উপজেলার চার ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। মিঠাছড়ি, খুনিয়াপালং, রশিদনগর ও জোয়ারিয়ানালা এ চার ইউনিয়নের বাঁকখালী নদী সংলগ্ন গ্রামের শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। ঈদগাঁও উপজেলার ঈদগাঁও, জালালাবাদ, পোকখালী, ইসলামাবাদ ইউনিয়ন, কক্সবাজার সদরের পিএমখালী, খুরুশকুল, পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড, কুতুবদিয়ার ছয়টি ইউনিয়ন, মহেশখালীর তিনটি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়া তথ্য জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, গত কয়েক দিন ধরে প্রবল বর্ষণ ও পূর্ণিমার উচ্চ জোয়ার অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে উচ্চ জোয়ারের কারণে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এখন যে তথ্য রয়েছে তাতে কুতুবদিয়ায় ৭০০ পরিবার, পেকুয়াতে ১০ হাজার পরিবার, মহেশখালীতে ৫০০ পরিবার, চকরিয়ায় ৫০ হাজার পরিবার, কক্সবাজার সদরে এক হাজার পরিবার, ঈদগাঁও উপজেলায় ১৫০ পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা মাঠে রয়েছে। তারা বোট নিয়ে পানিবন্দি মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছে এবং তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসছে।
সারাবাংলা/এনইউ