Monday 15 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৩৩ বছর কাটল, প্রকৃতির সঙ্গে পারুবালাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৪ মে ২০২৩ ১৪:১৮

চট্টগ্রাম ব্যুরো: পারুবালা জলদাসের বয়স এখন ৬০। কিছুই ভোলেননি এখনও। স্মৃতিতে এখনও মা, বাবা, ভাই আর শ্বশুরকে হারানোর মর্মান্তিক সেই রাতের কথা জ্বলজ্বল করছে। দুই সন্তানকে বুকে জড়িয়ে সেই রাতে পারুবালা আশ্রয় নিয়েছিলেন হাতিয়ার একটি সাইক্লোন সেন্টারে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার সেই স্মৃতি কী এত সহজে ভোলা যায়!

১৯৯১ সালের প্রলংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কথা আবার মনে পড়ছে যখন পারুবালার, তখন আরেকটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতের ভয়ে তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে। ৩৩ বছর কেটেছে, প্রকৃতির সঙ্গে পারুবালাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি।

বিজ্ঞাপন

তাই-তো ভয়ার্ত অথচ স্পষ্ট কন্ঠে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বলছেন, ‘ভগবানের কাছে প্রার্থনা করিয়ের, একানব্বইর মতন ঘূর্ণিঝড় যেন আর না আসে!’

রোববার (১৪ মে) সকালে পারুবালার সঙ্গে দেখা হয় নগরীর দক্ষিণ হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে।

পারুবালা সারাবাংলাকে বলেন, ‘একানব্বইর তুয়ান (তুফান) যঁত্তে শুরু হয়ছে, তখন আমি হাতিয়ায় ওরো বাড়ি (শ্বশুরবাড়ি)। ছোড দুই ফোলা লইয়া জামাই-শাশুড়ি লইয়া সাইক্লোন সেন্টারে গিয়া আশ্রয় নিই। সেই তুয়ানে মা-বাপ হারাইছি, শ্বশুররে হারাইছি। অনেক মানুষ মরি গেছিল। গরু-মহিষের লাশ আর লাশ। এরপরে আরও তুয়ান দেখছি। এরম আর দেহিনাই।’

সেই আশ্রয়কেন্দ্রে আকমল আলী রোড সংলগ্ন জেলেপাড়া এবং ইপিজেড সংলগ্ন রেললাইন বস্তি থেকে লোকজন গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ তাদের পোষা হাঁস-মুরগি, কেউ গবাদি পশুটাও সঙ্গে এনেছেন। কাঁথা-বালিশ নিয়ে এলেও আসবাবপত্র তেমন কেউ নিতে পারেননি। প্রাণগুলো নিয়েই এসেছেন প্রাণের তাগিদে।

দেখা গেছে, সেই বিদ্যালয়ের নিচতলায় আশ্রিতদের আনা গরু-বাছুর বেঁধে রাখা হয়েছে। চতুর্থ তলায় লোকজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেঝেতে কাঁথা আর পাটি বিছিয়ে কেউ শুয়ে আছে, শিশুরা খেলছে আর বড়দের কেউ কেউ জুড়েছেন আড্ডা।

সেই আড্ডায়ও ৯১’র ঘূর্ণিঝড়রের কথাই আসছে ঘুরেফিরে। ১৯৭০–এর ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। সেবার মারা যায়। ঝড়ের গতিবেগ অনুযায়ী ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ও ছিল সত্তরের মতোই। সরকারি হিসেবে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে নিহত হয়েছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৫৩৯ জন। সম্পদ নষ্ট হয়েছিল কয়েক হাজার কোটি টাকার।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ১৯৯১ সালের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়েই এবার তারা ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়েছে। এ পর্যন্ত তারা প্রায় লাখো মানুষকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, এর মধ্যে উপকূলবর্তী বাসিন্দা এবং ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসরতরাও আছেন।

জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) মো. তৌহিদুল ইসলামের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাঁশখালী উপজেলায় ১১০ টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৪৫ হাজার ১৪৩ জন, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের ১৬২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২৯ হাজার ৮৮৫ জন, আনোয়ারা উপজেলায় ৩৩ টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫২৮০ জন, সীতাকুণ্ড উপজেলায় ৬২ টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১২৮৯ জন, কর্ণফুলী উপজেলায় ১৮ টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২০০ জন এবং মীরসরাইয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ৬০ জন আশ্রয় নিয়েছেন ।

মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুও নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান এনডিসি।

এদিকে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন পাহাড় থেকে সরিয়ে ৯৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৬ হাজার মানুষকে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনডিসি তৌহিদুল ইসলাম।

দক্ষিণ হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া স্থানীয় জেলেপাড়ার বাসিন্দা প্রদীপ জলদাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল বিকেল থেকে বৃষ্টি ও বাতাস বেড়ে যাওয়ায় আমরা অনেকেই এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি। তবে বেশিরভাগই আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চান না। আত্মীয় স্বজনের বাসায় চলে গেছে। আর অনেকে নৌকা ও মাছ ধরার জাল নিরাপদ রাখতে সেখানে পাহারা দেওয়ার জন্য থেকে গেছে। এখানে প্রশাসন থেকে আমাদের তিনবেলা খাবার দিচ্ছে। তেমন অসুবিধে হচ্ছে না।’

আশ্রয়কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা নুরুল আমিন সোহেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল রাতে প্রায়ই ৫০ জেলে পরিবার এখানে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের জন্য তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকালে বনরুটি, চিড়া ও মিঠা, দুপুরে ও রাতে খিচুড়ি দেওয়া হয়।’

হালিশহরে একই এলাকায় আরও দু’টি আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে অবশ্য তেমন লোকজন পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত (শনিবার) রাতে অনেকে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। আবহাওয়া পরিস্থিতি দেখে সকালে অনেকে আবার তাদের ঘরে ফিরে গেছেন। আবহাওয়া পরিস্থিতি খারাপ দেখলে আবার আশ্রয়কেন্দ্রে ফিরবেন।

ছবি: শ্যামল নন্দী, ফটোকরেসপন্ডেন্ট

সারাবাংলা/আইসি/আরডি/ইআ