Monday 15 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বৈশাখী মেলা… ঘোড়দৌড়, আনন্দ মেলা হয়ে ভুভুজেলা!


১৪ এপ্রিল ২০১৮ ১৬:০০ | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৮ ১৬:৪৩
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এবারের বৈশাখী মেলার আয়োজনে অনেককে খুব ভুভুজেলা বাজাতে শোনা গেছে। সহকর্মীরা যারা বাইরে অ্যাসাইনমেন্ট করেছেন তারা অফিসে ফিরে সে কথাই বললেন। কোথা থেকে এলো এই ভুভুজেলা! সে কথা ভাবতেই স্মৃতির দুয়ারে এসে ভীর করলো অনেক কথা। মায়ের মুখে শোনা গল্প, নিজের ছেলেবেলার বৈশাখী স্মৃতি হয়ে আজ সকালে ছোট্ট ভাতিজিটির মুখ। সে কথাই শোনাতে চাই।

আমার মা প্রায়ই একটা কথা বলেন- এখন তোরা আড়ংয়ে কেনাকাটা করতে যাস। তা দিয়ে তোরা স্রেফ একটা দোকানই বুঝিস… কিন্তু আমাদের সময় আড়ং বলতে আমরা বুঝতাম বৈশাখী মেলাকে।

‘আব্বা (আমার নানা) আমাদের তিনবোনের হাত ধরে পহেলা বৈশাখের দিন সকাল বেলায় আড়ংয়ে নিয়ে যেতেন। আমরা মহা উৎসাহে পুরো মেলা ঘুরে ঘুরে কদমা বাতাসা খেতাম। তারপর ছোট ছোট দু’হাত ভর্তি করে মাটির হাতি, ঘোড়া, পুতুল, হাঁড়িপাতিল কিনে নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরতাম।’ শুধু কি তাই! আড়ংয়ের পাশেই খোলা মাঠে থাকত ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা।  অবাক চোখে দেখতাম কত দ্রুত ধুলা উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে তাগড়া তাগড়া ঘোড়াগুলো। আর মেলা থেকে বাড়ি ফিরে বাড়ির পাশেই বয়ে চলা নদীতে নৌকা বাইচ দেখতাম।’

বিজ্ঞাপন

বৈশাখী মেলা বা উৎসব নিয়ে আমার মায়ের স্মৃতির ক্যানভাস জুড়ে এগুলোই ঘুরপাক খায়। ছোটবেলার পহেলা বৈশাখের স্মৃতিচারণ করতে গেলে আমি আমার পঞ্চাশোর্দ্ধ মায়ের চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখি। তবে স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই আস্তে আস্তে নত হয়ে আসে চোখ। যাপিত জীবন, হারিয়ে যাওয়া দিন, বাবার স্মৃতি, মুছে যাওয়া রঙিন শৈশব এসে কিছুটা হাহাকার তৈরি করে হয়ত।

মায়ের স্মৃতিচারণ শুনি আর দেখি ঘরময় ছুটোছুটি করে মাতিয়ে রাখা আমার সাড়ে পাঁচ বছরের ভাতিজীকে।  সকাল থেকে মুখ ভার করে বসে আছে মেলায় নিয়ে যাওয়ার বায়না পূরণ হয়নি। ঢাকা শহরের নাগরিক মেলা। কী আর দেখবে এখানে! ভাবি আমি।

তাতে নিজের শৈশব নিয়েও কিছুটা গর্ব হতে থাকে।

আমার জীবনের প্রায় সতেরো বছর কেটেছে নড়াইলে। দক্ষিণ-পশ্চিমের এই জেলায় জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠার সুযোগ পাওয়ায় আমি গর্ব বোধ করি। কারণ, শৈশবে আমিও পেয়েছি হিজল তলায় বসে মালা গাঁথার সুযোগ। বকুলের গন্ধ মেখে বয়ে চলা চিত্রার বুকে উদিত সূর্যের প্রথম আভা গালে মাখার স্বর্ণালী অভিজ্ঞতা। এই শহরে উৎসব আসে যেন, ‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে’। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ ছাড়াও আমরা মহা ধুমধামে পালন করি এস এম সুলতান জন্মোৎসব, আঞ্চলিক গানের উৎসব ছাড়াও ছোট বড় অসংখ্য উৎসব।

এইরকম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের একটা এলাকায় স্বভাবতই পহেলা বৈশাখ আসে মহা সমারোহে। আমার শৈশবে পহেলা বৈশাখের স্মৃতিতে সবার আগে আসে মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হওয়া বৈশাখী মেলা। নড়াইলে দুটো বৈশাখী মেলা হয়। একটা অডিটোরিয়াম চত্বরে আরেকটা ঐতিহ্যবাহী নিশীনাথতলায়। অডিটোরিয়াম চত্বরের মেলাটা মাঝমধ্যে তিনদিন হত মাঝেমধ্যে সাতদিন। কিন্তু এই মেলা ঘিরে আমার কলেজপড়ুয়া বড় ভাই, তার বন্ধু, পাড়ার মামা-চাচা, বড় আপু-ভাইয়াদের মাঝে সে কি উদ্দীপনা। কারণ, তারা মেলায় স্টল দেবে। পাড়ার মধ্যে সবচাইতে মজার চটপটি রান্না করতে পারে কোন চাচী তার খোঁজ শুরু হয়ে যেত। কারণ, মফস্বলে তখনও চটপটি অত সহজে পাওয়া যায় না। এইসব মেলাতেই দেখা যেত পাড়ার ছেলেপেলেরা চটপটি বিক্রি করত।

একদিকে বড়দের চলত মেলার প্রস্তুতি আর অন্যদিকে আমরা ছোটরা জমাতে থাকতাম টাকা। বৈশাখী মেলাতেই কিনতে পারব মাটি, বাঁশ আর ঝিনুকের খেলনা, বেলুন, চড়তে পারব নাগরদোলায় আর অন্যান্য খেলনা বাহনে। দিন গুনতাম পহেলা বৈশাখ আসার, রঙ বেরঙের বেলুন কেনার আর সন্ধ্যাবেলায় কুড়মুড়ে পাঁপড়, চটপটি আর ঘুগনি দিয়ে মাখা ঝালমুড়ি খাওয়ার।

 

এসবের পাশাপাশি পহেলা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সন্ধ্যার পরের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান ঘিরেও চলত আরেক দক্ষযজ্ঞ। পাড়ার নাটকের দল ব্যস্ত নাটকের মহড়ায়, নাচিয়েরা ব্যাস্ত নাচের মহড়ায়, গাইয়েরা গানের আর সুন্দরী ও সুন্দর কণ্ঠস্বরের কোন বড় আপু ব্যস্ত অনুষ্ঠান উপস্থাপনার স্ক্রিপ্টের মহড়ায়। আমরা ছোটরা অবাক হয়ে শুধু আয়োজন দেখতাম, রাতের বেলায় মায়ের হাত ধরে নাচের মহড়া দেখতাম। আর অপেক্ষায় থাকতাম কবে আসবে বৈশাখবরণের দিন!

বৈশাখের আরেকটা আকর্ষণ ছিল হালখাতা! পহেলা বৈশাখের দিন জুয়েলার্সগুলো থেকে কার্ড পাঠানো হত। মা-চাচীরা কখন সবাই মিলে একসাথে যাবে তাই নিয়ে আলোচনা করত। পাড়ার নারীরা দেখা যেত কিস্তিতে টাকা দিয়েই সোনার গয়না গড়াতেন। পহেলা বৈশাখের হালখাতা খোলা উপলক্ষে সবাই সেদিন কিছু না কিছু টাকা দিতেন। অনেকসময় এম্নিতেও সম্পর্কের খাতিরেও দাওয়াত দিত অনেকে। আমরা ছোটরা সন্ধ্যার পরে বড়দের হাত ধরে সোনার দোকানে যেতাম হালখাতা উৎসবে। কলাপাতা, সোলা, ফুল বেলপাতা দিয়ে সাজানো থাকত দোকান। দোকানীরা আমাদের আপ্যায়ন করত মিষ্টি, সন্দেশ এসব দিয়ে। ছোটবেলার পহেলা বৈশাখে মেলার পাশাপাশি হালখাতাও তাই দারুণ মিষ্টি এক স্মৃতি।

ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান টিভিতে দেখতাম সকাল থেকেই। ঢাকায় থাকা আত্মীয়দের কাছেও শুনতাম ঢাকার বৈশাখের কথা। কিন্তু তখনও আমাদের জীবনে ঢাকার বৈশাখের ছায়া সেভাবে পড়েনি। এরপর বড় হতে হতে মেয়ে হিসেবে আমার দুনিয়া ছোট হতে শুরু করল। বৈশাখী মেলার সেই আনন্দ আয়োজনে অংশ নিতে হাজারো বাঁধা বিপত্তি, সাবধানতা। এভাবেই বৈশাখী মেলার আবেদন কমতে থাকল আমার জীবনে। হাতে গোনা দু’একদিন মাত্র মেলায় যেতে পারতাম কোন আত্মীয় কিংবা পরিবার অনুমোদিত পাড়ার আপুদের সাথে। এরপর আস্তে আস্তে দুই হাজার সালের দিক থেকে আমরাও বৈশাখে নতুন কাপড় কিনতে শুরু করলাম, লাল সাদায় উদযাপন করতে শুরু করলাম বৈশাখের আগমন। ১৩ এপ্রিল বাজারে যেয়ে দেখতাম ভীড়ের চোটে পা ফেলার জায়গা নাই। এভাবেই পহেলা বৈশাখের দিন খেতে শুরু করলাম ভালো খাবার। বাড়িতে রান্না হতে শুরু করল তেহারি, নাহয় পান্তা-ইলিশ-শুঁটকি, মুড়িঘন্ট, চিংড়ির মালাইকারী, ভর্তা এসব।

একসময় দেখলাম আমাদের শিল্পকলা একাডেমির চত্বরে একটা বটগাছ লাগানো হয়েছে। সেই গাছের চারপাশ ঘিরে বানানো হয়েছে সিমেন্টের বেদী। সেই বেদী ঘিরে দেখি জমে উঠতে শুরু করল পান্তা ইলিশ খাওয়ার উৎসব। আর আগের মত বৈশাখী মেলা তো ছিলই।

এরপর ঢাকায় এসে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ার সময় প্রথমবারের মত টিএসসির চত্বরের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সাথে পরিচিত হলাম। সেবারই প্রথম লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে বৈশাখ উদযাপন। বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডার চাইতেও ভালো লাগত মানুষ দেখতে। কত মানুষ, সবাই এসেছে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে। এতো আনন্দ আয়োজনে অংশ নিলেও কেন জানি প্রাণের যোগটা খুঁজে পেতাম না। বারো বছর হয়ে গেল ঢাকায় পহেলা বৈশাখে নতুন শাড়ি পরি, সাতরকম ভর্তা, দেশি মাছের পদ দিয়ে ভাত খাই।

কিন্তু সেই যে শৈশবে রঙিন আলোর হাতছানি নিয়ে বৈশাখ আসত, বাংলা মায়ের ঢোলের বাড়িতে প্রাণ মাতিয়ে যে বৈশাখ আসত তা আর আসেনা কেন জানি। মন পড়ে থাকে শৈশবের সেই রঙিন বৈশাখী মেলায়। এখন আমার ভাতিজিদের জীবনেও বৈশাখ আসে। বড় হয়ে তাদের স্মৃতিতে হয়ত থাকবে বৈশাখে কতগুলো জামা পেত তার হিসেব। আরও থাকতে পারে পহেলা বৈশাখের দিন বহুতল মার্কেটের নীচে কিংবা বাজারের রাস্তার দুধারে বসা প্লাস্টিকের খেলনা, ভুভুজেলা, রঙিন বেলুন, কদমা বাতাসা আর উৎসবমুখর অসংখ্য মানুষ।

আমার মায়ের যেমন পহেলা বৈশাখের স্মৃতিতে যেমন আছে ঘোড়দৌড় আর নোকাবাইচ। আমার স্মৃতিতে আছে অসম্ভব আনন্দ আয়োজনে ভরপুর প্রাণের বৈশাখী মেলা, হালখাতা। তেমনি আমার ভাতিজিদের জীবনেও বৈশাখি মেলা থাকবে ভিন্নরুপে, ভিন্ন আবহে, ভিন্নরকম বার্তা নিয়ে, যেভাবে ভুভুজেলা বাজানো হচ্ছে… তাতে তাও থেকে যেতে পারে। প্রজন্ম থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ধরণ ধারন বদলালেও বদলায়নি পহেলা বৈশাখ মানেই বৈশ্বিক সংস্কৃতির ভীড়েও রূপ বদলে টিকে থাকা আমাদের পহেলা বৈশাখের চিরকালীন আবেদন।

সারাবাংলা/আরএফ/এমএম

বিজ্ঞাপন

আরো