Monday 15 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পেটের দায়ে নীরবে অত্যাচার সহ্য করত ফারজানা

আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:১৩ | আপডেট: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:৫৫

ঢাকা: পান থেকে চুন খসলেই গুনতে হতো বড় ধরনের মাশুল। তেমনটি ঘটেছে গরিবের ঘরে জন্ম নেওয়া গৃহকর্মী ফারজানার কপালে। অন্যের বাসায় কাজ করে খেতে হবে এটিই যেন তার নিয়তি। সইতে হবে নির্যাতন, অবহেলা আর কটাক্ষ। ফারজানা যে বাসায় কাজ করত সেই গৃহকর্ত্রী বিভিন্ন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে মারপিট করত। পেটের দায়ে সব অত্যাচার নীরবে সহ্য করে আসছিল।

১৫ বছরের ফারজানাকে দেখে মনে হবে রোগে শোকে কাতর বয়স্ক কেউ। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে হরহামেশা মারধর করা হতো তাকে। বাথরুমে আটকে ঠান্ডা এবং গরম পারি ঢালা হতো। মারের পর প্রায় সময় ক্ষতস্থানে মরিচ লাগিয়ে দিত গৃহকর্ত্রী সামিয়া ইউসুফ ওরফে সুমি।

বিজ্ঞাপন

চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি নির্যাতন সইতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায় ফারজানা। এ অবস্থায় কেটে যায় দুইদিন। অবস্থার অবনতি ঘটায় গৃহকর্ত্রী ভয় পেয়ে ১৭ জানুয়ারি ফারজানার বাবাকে ফোন দেয়। এরপর ফারজানার বাবা-মা এসে তাকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফারজানা।

ওই ঘটনায় মেয়েকে গুরুতর জখম করার অভিযোগে তার বাবা বিল্লাল হোসেন ভূঁইয়া কলাবাগান থানায় গত ২০ জানুয়ারি একটি মামলা দায়ের করেন। এরপর ওই গৃহকর্ত্রীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

গত ২১ জানুয়ারি সামিয়াকে আদালতে হাজির করে ৩ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। কিন্তু ওইদিন সামিয়ার ভাই ফারজানার বাবা বিল্লাল হোসেনকে আদালতে নিয়ে যান। সেখানে তারা একটি হলফনামায় স্বাক্ষর করিয়ে নেয়।

সেখানে উল্লেখ করা হয়— ভুল তথ্যের ভিত্তিতে আমি (বিল্লাল হোসেন) মামলা করেছি। নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আসামি কোনো অপরাধমূলক কাজ করেনি। আমি পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এটি ছিল দুর্ঘটনা। আসামি জামিন পেলে আমার আপত্তি নেই। পরে তার রিমান্ড না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

ঘটনার তিনদিন পরে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ ছিদ্দিকীর আদালতে সামিয়ার পক্ষে তার আইনজীবী জামিন আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জামিনের বিরোধিতা করা হয়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে এক হাজার টাকার মুচলেকায় আসামির জামিন মঞ্জুর করেন আদালত।

এ বিষয়ে ফারজানার বাবা বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘সামিয়ার ভাই আমাকে আদালতে নিয়ে যায়। তারপর বলে একটা কাগজে নাম লিখতে। আমি নাম লিখে দেয়। জানতে চাই, কেন নাম লিখতে বললেন। তারা আমাকে আর কিছু বলেনি। কাগজে এমন কথা লেখা ছিল জানলে সই করতাম না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আসামির লোকজন আমার কাছ থেকে কাগজে সই নিয়েছে। সেই কগজে লিখছে, অভিযোগ সত্য নয়, আমার জামিনে আপত্তি নেই। সেই কাগজ দেখাইয়া না কি, জামিন নিছে। আমি লেখাপড়া জানি না। কি লেখা ছিল জানি না। আমি জামিন বাতিল চাই।’

ফারজানার মা জোসনা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়েকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয়েছে যা দেখা যায় না। ওর শরীর থেঁতলে ফেলা হয়েছে। নির্যাতনে ওর পেটে সমস্যা, লিভার, লাঞ্চ, কিডনিতে সমস্যা হয়ে গেছে। খাবার হজম হচ্ছে না। আমার মেয়ের সঙ্গে যে এমন অন্যায় করছে, নির্যাতন করছে তার সঠিক বিচার চাই।’

এদিকে বাদীপক্ষের নিযুক্ত আইনজীবী আরিফুল ইসলাম জানান, গত ৩১ জানুয়ারি বাদীপক্ষ থেকে আসামির জামিন বাতিল চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি আসামির হাজিরার দিন ধার্য রয়েছে। ওইদিন আমরা জামিন বাতিল চেয়ে শুনানি করব।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী সাজেদুল ইসলাম জানান, এ মামলার বাদী প্রথম দিন আদালতে এসে বলেছেন, জামিন দিলে তার আপত্তি নেই। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে— আগুন দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়ার কথা। কিন্তু মেডিকেল রিপোর্ট বলছে, তার সিস্টের সমস্যা আছে। পেনাল কোডের ৩২৩, ৩২৪ ধারা জামিনযোগ্য। আর ৩২৬ ধারা মারাত্মক জখমের। মারাত্মক জখমের তো একটা ম্যাটার থাকতে হবে। সবকিছু বিবেচনা করে আদালত আসামির জামিন মঞ্জুর করেন।

মামলায় অভিযোগ থেকে জানা যায়— বাদীর বড় মেয়ে ফারজনাকে (১৫) ২০১৫ সালে থাকা-খাওয়া মাসিক দুই হাজার টাকা দেওয়ার চুক্তিতে সামিয়া ইউসুফ সুমি (৩২) এর বাসায় কাজে দেন। গত ১৭ জনুয়ারি বিবাদী সুমি ফোনে জানায় বাদীর মেয়ে ফারজানা খুব অসুস্থ। এরপর ওইদিনই স্ত্রী জোছনা বেগমসহ (৩৫) বিবাদীর বাসায় গিয়ে ফারজানাকে (১৫) অচেতন অবস্থায় দেখতে পান। লোকদের সহায়তায় মেয়েকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিছুটা সুস্থ হলে মেয়ে জানায় যে, কাজে যোগদান করার পর থেকেই বিবাদী সুমি বাদীর মেয়েকে বিভিন্ন তুচ্ছ কারণে মারপিট করত। পেটের দায়ে সব অত্যাচার নীরবে সহ্য করে আসছিল।

অভিযোগে আরও বলা হয়, গত ১৫ জানুয়ারি ঘর গোছানো ও বাসন-পত্র ভেঙে ফেলার মিথ্যা অভিযোগে এবং কাজে দেরি হওয়ার তুচ্ছ অজুহাতে বিবাদী সুমি ক্ষিপ্ত হয়ে লাঠি নিয়ে এলোপাথাড়ি মারপিট শুরু করে। একপর্যায়ে তাকে লোহার খুনতি গরম করে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছ্যাঁকা দেয়।  এতে তার শরীরের বিভিন্ন স্থান মারাত্মক পোড়া জখম হয়।

আরও পড়ুন
গৃহকর্ত্রী সুমির জামিন বাতিল চেয়ে আদালতে গৃহকর্মী ফারজানার বাবা
গৃহকর্ত্রীর নির্মম অত্যাচারে কেবল হাড্ডিসার দেহই রয়েছে ফারজানার

 

সারাবাংলা/এআই/একে
বিজ্ঞাপন

আরো