কী আছে কোটায়, কেন প্রয়োজন সংস্কার?
৯ এপ্রিল ২০১৮ ১৭:২০ | আপডেট: ৯ এপ্রিল ২০১৮ ২২:২৭
।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
‘সকল সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার কোন পদ যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পূরণ করা সম্ভব না হইলে সে সকল পদ মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদের মধ্য হইতে পূরণ করিতে হইবে।’
গত ৬ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত একটি পরিপত্রে এমনটাই বলা হয়।
এর আগে ২০১০ সালের মে মাসে জারিকৃত আরেক পরিপত্রে ১ম ও ২য় শেণির পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বিষয় নির্দেশনা ছিলো। এতে বলা হয়:
বিশেষ কোটার অধীন কোনো জেলার বিতরণকৃত পদের সংখ্যা হইতে যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা কম হইলে উক্ত বিশেষ কোটার অপূর্ণ পদসমুহ জাতীয় ভিত্তিক স্ব-স্ব বিশেষ কোটার জন্য প্রণীত জাতীয় মেধা তালিকা হইতে পূরণ করিতে হইবে।
এতে আরও বলা হয়:
‘উক্ত সিদ্ধান্ত অনুসরণের পর সংশ্লিষ্ট নিয়োগের জন্য মহিলা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটার কোনো কৃতকার্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে উক্ত পদগুলো অবশিষ্ট কোটা অর্থাৎ জেলার সাধারণ প্রার্থীদের দ্বারা পূরণ করিতে হইবে।’
‘উপরিউক্ত পদ্ধতিদ্বয় অনুসরণ করিবার পরও কোনো বিশেষ কোটার (মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী) পদ পূরণ করা সম্ভব না হইলে অপূরণকৃত সে সকল পদ জাতীয় মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদের দ্বারা পূরণ করিতে হইবে।’
এছাড়া ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ কোটার ( মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, এতিম, শারিরীক প্রতিবন্ধী এবং আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা সদস্য) কোনো পদ যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পূরণ করা সম্ভব না হইলে অপূর্ণ পদসমূহ জেলার প্রাপ্যতা অনুযায়ী স্ব-স্ব জেলার সাধারণ প্রার্থীদের মধ্য হইতে মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদের দ্বারা পূরণ করিতে হইবে।’
দুটি বিষয় সামনে এনেই কোটা সংস্কার বিষয়ক বিদ্যমান আন্দোলনের বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা যাক।
সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে উত্তপ্ত রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গন। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেনো দেশের প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই চলছে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ।
কী দাবি তাদের। কোন সংস্কারের কথা বলছেন তারা। তবে তারও আগে জেনে নেওয়া যাক কোটা ব্যবস্থাটি কি? এবং বাংলাদেশে এর প্রয়োগ কিভাবে চলছে? সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত কি?
বর্তমানে যে কোনো সরকারি চাকরির ৫৬ ভাগ কোটা নির্ধারিত রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণীর চাকরিপ্রার্থীদের জন্য। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ কোটা সংরক্ষিত রয়েছে। এর বাইরে ৪৪ শতাংশ চাকরির সুযোগ রয়েছে সাধারণ চাকরি প্রার্থীর জন্য। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ সব আসনে আবার কোটা সুবিধা পাওয়া প্রতিযোগীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫০ জন। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মাত্র দুই লাখ। সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা নির্ধারিত। ২০ লাখ প্রতিবন্ধীর জন্য কোটা রয়েছে ১ শতাংশ, ১৫ লাখ উপজাতির জন্য কোটা ৫ শতাংশ এবং নারী ও জেলা কোটায় ১০ শতাংশ করে সরকারি চাকরিতে সুযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধার মূল্যায়ন কমিয়ে কোটার কদর বাড়ানোয় ধীরে ধীরে দেশের প্রশাসনযন্ত্রে ফাটল ধরেছে। মেধাহীন পরিচালকদের হাতে দেশ পরিচালনার ভার চলে যাওয়ায় ভবিষ্যত প্রজন্ম আরও মেধাহীন ও দুর্নীতিপরায়ণ হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। তাদের মতে, স্বাধীনতার মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ বিষয়টি এখনই সংস্কার প্রয়োজন। তা না হলে রাষ্ট্রে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি প্রফেসর আহমেদ কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ছাত্রদের এ দাবিকে সমর্থন করি। আমার কাছে মনে হয়েছে তারা তাদের ক্যারিয়ারের স্বার্থে যে আন্দোলন করছে সেটি শতভাগ যৌক্তিক। সরকারের উচিত তাদের পালস বোঝা। তা না করে তারা দেশের ছাত্র সমাজের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। একটি কনফ্লিক্টে চলে গেছে। এতে সমস্যার সমাধান হবে না।
‘কোটা ব্যবস্থায় দেশের মেধা, অর্থনীতিসহ সামাজিক ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে’
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি দীর্ঘদিনের। এর মধ্যে রাজনীতিতেও বেশ পাল্টাপাল্টি ইস্যু হয়েছে এ আন্দোলন। বিভিন্ন সময় সরকার সংশ্লিষ্টরা এর পক্ষে যেমন বক্তব্য দিয়েছেন তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর সমর্থনে বক্তব্য দিয়েছেন। চট্টগ্রামের এক জনসভায় বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেওয়ার পর মূলত সরকারের সবপর্যায় থেকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। এমন কী রোববার রাতে হাজার হাজার আন্দোলনকারীর ওপর পুলিশের সঙ্গে মিলে হামলাও করে ছাত্রলীগ।
তবে হামলা-নির্যাতন যাই হোক চাকরিমুখি শিক্ষার্থীরা বলছেন, ন্যায্য দাবি আদায়ে রাজপথেই হবে সমাধান। তারা কোটা সংস্কারের দাবিতে ৫ দফা শর্তও দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করে ১০ ভাগে নামিয়ে আনা, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ না দেওয়া, চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহারের বিধান উঠিয়ে দেওয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন কাটমার্কস ও বয়সসীমা নির্ধারণ করা ও কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শুন্য পদে মেধায় নিয়োগের বিধান রাখা।
এ বিষয়ে অধ্যাপক আহমেদ কামাল বলেন, ‘স্বাধীনতার চেতনায় যদি দেশ চালাতে হয় তা হলে সবার আগে এ ধরনের বৈষম্যমূলক কোটা প্রথা বাতিল করা উচিত। কেননা দেশে বিপুল সংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি চাকরিতে মাত্র ৪৪ ভাগ আসন কোনোভাবেই তাদের অধিকার নিশ্চিত করে না। এটি অবিলম্বে বাতিল করা প্রয়োজন।’
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি চালু হয়। এরপর বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার অধীনে ২৫৮ ধরনের সুবিধাভোগীরা চাকরি পাচ্ছেন। বিভিন্ন সময় কোটা প্রথার সুযোগ নিয়ে চাকরিতে অসাধু উপায় অবলম্বনের পাশাপাশি আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। অন্যদিকে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার যোগ্যতা থাকার পরও চাকরি বঞ্চিত হচ্ছেন। এ অবস্থায় চাকরির বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে।
সংবিধানের ২৯ এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। ২৯ এর (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবে না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাহাত্তরের সংবিধানের মূলত চেতনা হলে বৈষম বিলোপ ও সমতা বিধান। কিন্তু কোটা ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দিয়ে সে চেতনা ভুলুণ্ঠিত করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন-
‘স্বাধীনতার পর কোটা ব্যবস্থা প্রণয়নের একটা বিশেষ প্রেক্ষাপট ছিল। কিন্তু সেটি এখন থাকা উচিত বলে আমার মনে হয় না। কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করা প্রয়োজন।’
কোটা প্রথা বাতিলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড.সৈয়দ আনোয়ার হোসেনও। সারাবাংলাকে তিনি বলেন-
‘কোটা প্রথা সংস্কার এখন সময়ের দাবি। আমি মনে করি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপের অভাবে একটি ছোটো সমস্যা বড় আকার ধারণ করেছে। এখন মনে হচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।’
৫৬ ভাগ কোটাকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘এতে করে বিপুল সংখ্যক মেধাবীদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। আমি বহু গবেষণা করে দেখেছি কোনোভাবেই এখন আর ১০ ভাগের অধিক কোটা থাকা উচিত নয়।’
কোটা সংস্কারের দাবিতে সংহতি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর যে হামলা করেছে সেটি অনাকাঙিক্ষত। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির বাসভবন যদি কোটা বিরোধীরা ভাঙচুর করে থাকে সেটিও কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকারের উচিৎ ছিল আরও আগেই আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করা।
কোটা সংস্কারের এই দাবির বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। সোমবার (৯ এপ্রিল) মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় কথা বলেছেন। এমনকি সংশ্লিষ্টদের কোটা সংস্কার বিষয়ে আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
সারাবাংলা/এমএস/একে