জাকিয়া আহমেদ ও সোহেল রানা
ঢাকা: আমার দেড় আর ছোট ভাইটার যখন দশ মাস বয়স তখন মা মারা যায়। এরপর যখন আমি একটু একটু বুঝতে শিখেছি তখন মারা যায় আব্বু। ভাইয়াও তখন ছোট ছিল। কিন্তু তখন থেকেই আমাদের দুই ভাইয়ের বাবা-মা ছিল ভাইয়া। বলতে বলতে হাত দিয়ে চোখ মোছে মেহেদী হাসান, পাশে বসা হৃদয় হোসেন আব্দুল্লার চোখও ছলছল করে ওঠে।
কিশোর মেহেদী হাসান আর আব্দুল্লাহর বড় ভাই রাজীব হোসেন। গত মঙ্গলবার রাজধানীতে দুই বাসের চাপায় পড়ে ডান হাত হারিয়েছেন তিনি। প্রায় অচেতন রাজীবকে এখন চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ঢামেক হাসপাতালের আইসিই ‘তে ( নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)। তিনদিন পার হবার পর আজও (বৃহস্পতিবার) রাজীব জানে না তার ডান হাত নেই, এদিকে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন।

বৃহষ্পতিবার (৫ এপ্রিল) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের টিকেট কাউন্টার কক্ষে বসে কথা হয় রাজীবের ছোট দুই ভাই মেহেদী হাসান আর আব্দুল্লাহর সঙ্গে।
কিশোর এ দুই ভাই বলে, খুব ছোট বেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছি। তারপর থেকে বাবা-মা হিসেবে ভাইয়া ছিল। আমাদের সব আব্দার ছিল ভাইয়ার কাছে। গত ঈদেও আমাদেরকে নিজের পকেট খরচ থেকে বাঁচিয়ে পাঞ্জাবি- পায়জামা কিনে দিয়েছে । যখন যা দরকার হত তাই কিনে দিত। এখন আমাদের কে দেখবে আর ভাইয়াকেই বা কে দেখবে? কথা গুলো শেষ হলে মেহেদীর অসহায় দৃষ্টি শুন্যে মিলিয়ে যায়।
পাশে বসা তাদের মামা জাহিদুল ইসলাম মেহেদীর মাথায় হাত বোলান, আর তাতে যেন ভেতরের কান্না বেরিয়ে আসে। মামাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে মেহেদী। পাশেই পাথর হয়ে বসে আরেক ছোট ভাই আব্দুল্লাহ।
ভাইয়ের দুর্ঘটনার খবর কীভাবে কখন পেয়েছো জানতে চাইলে মেহেদী বলে, গত মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে খবর পাই ভাইয়ার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছিল সেটা জানতাম না। গতকাল একটা পত্রিকা দেখে মাদ্রাসার কয়েকজন এসে আমাদের খবর দেয়, তোমাদের ভাই রাজীব অ্যাক্সিডন্টে করেছে, তার একটা হাত কেটে ফেলছে ডাক্তারা। পরে আমিও সেই পত্রিকা দেখি বাম হাত কাটা পড়ছে লেখা। দেখে ভাবলাম, তবুওতো ডান হাতটা আছে। সাথে সাথে মামা আর বড় খালারে ফোন দেই, তারা জানায় ভাইয়ার ডান হাত কেটে ফেলা হয়েছে- বলে হাত দিয়ে চোখ মোছে মেহেদী হাসান।
ওদেরকে আমরা জানাই নাই। আমরা চেয়েছিলাম আরও পরে জানুক। কিন্তু পত্রিকা থেকে জানার পর আজ নিয়ে আসছি ওদেরকে, বলেন রাজীবের মামা জাহিদুল ইসলাম।
অ্যাক্সিডেন্টের আগে যেদিন খালার বাসায় ভাইয়ার সাথে দেখা হয় সেদিন খালা বলছিল, তোদের ভাইতো বড় হয়ে গেছে, ভাই-ই সবকিছু করবে। ভাইয়াও বলছিল, এখন আমি আছি-আর কী লাগবে। এখন সেই কথাটি আর থাকলো না বলে মেঝ ভাই মেহেদী হাসান যাত্রাবাড়ীর তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণি আর ছোট ভাই ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তারা লেখাপড়াতেও খুব ভালো। দুজনই কোরআনে হাফেজ বলেন-মামা জাহিদুল ইসলাম। মাদ্রাসাতে ওদেরকে সবাই চেনে ভদ্র ছেলে হিসেবে।
দুই ভাইয়ের হোস্টেল থেকে হাটা পথের দূরত্বে থাকতেন রাজীব। যেন সবসময় ভাইদেরকে চোখে চোখে রাখতে পারে, তাদের সবকিছুতে পাশে থাকতে পারে, বলেন জাহিদুল ইসলাম।
ছোট ভাই হৃদয় হোসেন আব্দুল্লাহর পড়ার টেবিল ছিল না। ভাই সেটা দেখে এক সপ্তাহ আগে টেবিল কিনে দিয়েছে, জিজ্ঞেস করে গিয়েছিল আর কী কী দরকার। বলছিল, সব কিনে দেবে। কিন্তু এখন সেটা কবে হবে, আমাদের কে দেখবে আর আমার ভাইকে কে দেখবে বলে এ প্রতিবেদককে প্রশ্ন করে মেহেদী।
নিজের খরচ বাঁচিয়ে আমাদের হাত খরচের জন্য টাকা দিয়ে যেত যেটা আমরা জানতাম না মন্তব্য করে মামা জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের অজান্তে ভাইদের হাতে টাকা দিয়ে আসতো, পরে সেটা জানতাম আমরা।
রাজীব এখনও জানে না, বুঝতেই পারে না ওর হাত নেই। শুধু বলে, আমার হাতটা এত ভারী কেন? হাতটা একটু সোজা করে দাও, হাত কেন সোজা করতে পারি না-এ রকম বলে। ও এখনও পুরোপুরি সজ্ঞানে নেই। তিনদিন হয়ে গেছে, এখনও জ্ঞান আসেনি ঠিক মতো, সেই ঘুমের ভেতরেই রয়েছে। ওরতো জ্ঞানই নাই-ও বুঝবে কী করে।

তবে হাত কেটে ফেলার পাশাপাশি সিটি স্ক্যান রির্পোট নিয়ে এখন খুব শঙ্কায় আছি জানিয়ে জাহিদুল বলেন, আজ সকালে করা সিটিস্ক্যান রির্পোটে মাথায় আঘাত এসছে-সেটা একটু রিস্কি মনে হচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, মাথায় ছোট একটা ইনজুরি আছে, ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা জানি না, সেটা কী আসলেই ঠিক হবে নাকি চিকিৎসকরা আমাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। জাহিদ বলেন, বাবা-মা মারা যাবার পর এখন আমরা ভাইবোনরা দেখে রাখছি, কিন্তু এখনতো সে-ই সম্বল ছিল ভাই, কিন্তু আল্লাহ শেষ সম্বলটা পঙ্গু করে দিল।
রাজীবের ছোটো দুই ভাই আর মামার সঙ্গে কথা শেষ। এবার আসার পালা। তবে মেহেদীর কথা শেষ হয় না। সে বলে, আমার ভাই এখন নিজের পায়ে দাঁড়াবে কী করে? কীভাবে ইনকাম করবে হাত ছাড়া? আমাদের দেখবে কে? আমরা কীভাবে চলবো? আপনারা সবাই দোয়া করবেন, ভাইয়া যেন সুস্থ হয়ে যায়, আর কিছু চাওয়ার নেই।
এদিকে রাজীবের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ঢামেক হাসপাতালের অর্থপেডিকস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, রাজীবের হাতে আরও দুই থেকে তিনটি অস্ত্রপচার লাগবে। তার কথা-বার্তাও কিছুটা অসংলগ্ন। তাকে আমরা এখনই শঙ্কামুক্ত বলছি না।
সারাবাংলা/জেএ/এমএস