বাসচাপায় স্বামীর মৃত্যু, সন্তান হাসপাতালে; শোকে স্তব্ধ রুমানা
৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২১:২৬
ঢাকা: গত বৃহস্পতিবার ভিক্টর পরিবহনের বাসচাপায় মারা যান সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পী পারভেজ রব। আর এর একদিন পর শনিবার একই পরিবহনের আরেক বাসের চাপায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি তার অনার্স পড়ুয়া ছোট ছেলে আলভী। এছাড়া ওই একই ঘটনায় আলভীর বন্ধু ছোটনেরও মৃত্যু হয়। দুই দিনে একই পরিবহনের বাসচাপায় স্বামীকে হারানো এবং সন্তান আহতের ঘটনায় শোকে স্তব্ধ রুমানা সুলতানা।
গত ৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে রাজধানীর তুরাগ থানা এলাকার ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে সঙ্গীত শিল্পী ও পরিচালক পারভেজ রবকে ভিক্টর পরিবহনের একটি বাস চাপা দিলে তার মৃত্যু হয়। আর ৭ সেপ্টেম্বর রাত আটটার দিকে একই পরিবহনের আরেকটি বাস উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের স্লুইচ গেট এলাকায় আলভী ও তার বন্ধু ছোটনকে চাপা দেয়। এতে ছোটনের মৃত্যু হয়। আর আলভী বর্তমানে রাজধানীর শ্যামলী ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
ট্রমা সেন্টারে রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) রাতে আলভীর মা রুমানা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিন ছেলেমেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে সুখেই চলছিল আমাদের সংসার। সঞ্চয় করা টাকা আর ব্যাংক থেকে নেওয়া লোন দিয়ে তুরাগ এলাকায় একটি বাড়ির কাজও চলছিল। হঠাৎ করে পারভেজ চলে যাওয়ায় জীবন নিমিষেই কেমন অগোছালো হয়ে গেলো। স্বামী মৃত্যুর শোক শেষ হয়নি। বাড়িতে চুলা জ্বলছে না। পারভেজের মাগফেরাত কামনায় দোয়া মাহফিলের আয়োজন চলছিল। ঠিক সে সময় আরেক দুর্ঘটনা আমাকে স্তব্ধ করে দিল। আমাদের পরিবারের সবার ঠিকানা এখন হাসপাতাল। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী যেখানে পারভেজের জন্য দোয়া করার কথা, সেখানে আমরা পরিবারের আরেক সন্তানকে নিয়ে উদ্বিগ্ন আছি। সন্তান বাঁচবে তো? বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিক জীবন পাবে কি?’
রুমানা সুলতানা বলেন, ‘একটা বাস কি করে এত বেপরোয়া হতে পারে। বাসের লোকগুলো আমাদের বাসার কাছেই স্ট্যান্ড বানিয়েছিল। তারা আমাদের সবাইকে চেনে। এরপরেও তারা এই কাজ করতে পারল? এখন তিন সন্তানকে নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকব সেটাই ভাবতে পারছি না। বড় ছেলে ইয়াসীন ইশরাক রব মালয়শিয়াতে পড়াশুনা করে। টাকা পাঠাতে না পারলে তার পড়াশুনাতেও ব্যাঘাত ঘটবে। ছোট ছেলে ইয়াসীর বিন আলভী উত্তরা টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। আর মেয়ে তুরাগে একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা কীভাবে হবে তা নিয়ে বিপাকে পড়েছি।’
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আলভী সারাবাংলাকে বলেন, ‘শনিবার রাত আটটার দিকে বন্ধু মেহেদি হাসান ছোটনকে নিয়ে টঙ্গীর দিকে যাওয়ার জন্য স্লুইচ গেইট এলাকায় বাসে ওঠার জন্য হাত উঠাই। বাস থামার পর দুজন দরজায় কেবল উঠছি তখনই চালক গাড়ি টান দেয়। এক পর্যায়ে আমরা বাসের জানালা ধরে ঝুলে থাকি। চালক আরও জোরে বাস টান দিলে আমরা সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি বাসের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাই। এরপর আর কিছু বলতে পারি না। পরে আমার জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি, ছোটন মারা গেছে।’
ট্রমা সেন্টারের চিকিৎসক ডা. কামরুজ্জামান বলেন, ‘আলভীর মেরুদণ্ড ও প্রস্রাবের রাস্তার গোড়ার দিকের হাড় ভেঙে গেছে। সে স্বাভাবিকভাবে প্রস্রাব করতে পারছে না। আপাতত অন্যভাবে লাইন করে দেওয়া হয়েছে। অস্ত্রপচারের আগে বলা যাচ্ছে না আসলে কী হবে।’
এদিকে উত্তরা পশ্চিম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাদেক হোসেন বলেন, ‘ঘটনা দুই রকমের শোনা যাচ্ছে। আটক হওয়া গাড়িচালক ও হেলপার বলেন, ভিক্টর পরিবহনের গাড়ি দেখা মাত্রই কয়েকজন ছেলে ধাওয়া করে আমাদের মারধর করতে যায়। এতে ভয় পেয়ে চালক গাড়ি টান দেয় এবং তারা চাপা পড়ে। তবে আসলে কী ঘটেছিল তা নিয়ে তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। গাড়িচালক রফিকুল, হেলপার সুমন ও কন্ডাক্টর মমিনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া দুটি বাস জব্দ করে থানায় নেওয়া হয়েছে।’
অন্যদিকে ডিএমপির উত্তরা জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হাফিজুর রহমান রিয়াল বলেন, ‘একই পরিবহনের বাসচাপায় দুজনের মৃত্যু এবং একজন আহতের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ’
এদিকে দুই গাড়িচালকের শাস্তি ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে নামে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা। পরে পুলিশ বিচারের আশ্বাস দিলে তারা এদিনের মতো সড়ক ছেড়ে দেয়।