ঢাকা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেগম খালেদা জিয়া সাধারণ কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নন— গৃহিণী থেকে রাষ্ট্রনায়কে উত্তরণের অনন্য উদাহরণ। শোকের ছায়া মাড়িয়ে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার যে মানসিক শক্তি তিনি দেখিয়েছেন, তা কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়; এটি ছিল অভূতপূর্ব মানবিক সাহসের প্রকাশ।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব পালন ছিল এক ধারাবাহিক অধ্যায়— উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের অধ্যায়। তিনবার দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে থেকে তিনি প্রমাণ করেছেন, নেতৃত্ব মানে শুধু ক্ষমতা নয়; নেতৃত্ব মানে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, সিদ্ধান্তে দৃঢ়তা এবং সময়ের প্রয়োজনে বিচক্ষণতা। রাষ্ট্র পরিচালনায় তার অভিজ্ঞতা ও দৃঢ় ভূমিকা তাকে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া কঠোর অবস্থান এবং ব্যক্তিগত জীবনের নির্লোভ অধ্যায় তাকে শুধু রাজনৈতিক নেত্রী নয়— নৈতিকতার অবিচল প্রতীক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছে। ক্ষমতা তার কাছে ছিল দায়িত্ব, প্রতিহিংসা অগ্রহণযোগ্য, আর গণতন্ত্র ছিল মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার মূলভিত্তি।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা কখনও মসৃণ কিংবা স্বস্তির ছিল না। প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক কঠোরতা ও প্রতিহিংসার কারণে তিনি বহু বছর জটিল আইনি প্রক্রিয়া ও কারাবাসের ভেতর দিয়ে গেছেন। অসুস্থতা সত্ত্বেও তার চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে নানা বিতর্ক এবং শারীরিক জটিলতা তার পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তোলে। তার চিকিৎসা ও বিদেশে নেওয়া নিয়ে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা তখন মানবিকতার প্রশ্নে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। তবুও তিনি ছিলেন শান্ত ও ধৈর্যশীল, ভয়-ভীতি বা প্রতিকূলতা কোনো কিছুই তাকে নত করাতে পারেনি।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
বেগম খালেদা জিয়ার জীবনকথা কেবল একটি নামের ইতিহাস নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনের এক অনন্য উপাখ্যান। তার জীবনের প্রতিটি ধাপ, সমর্পণ, সাহস, মানবিকতা ও গণতন্ত্রের সাধনার এক স্থায়ী স্মারক। তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন নারী চাইলে শুধু পরিবার নয়, সমগ্র জাতিকেও পথ দেখাতে পারেন, শুধু নেতৃত্ব নয়— একটি আদর্শের প্রতীকেও রূপ নিতে পারে।
বাংলার ইতিহাসের পাতায় তাই তার নাম থাকবে অবিচল— সংগ্রামের শিখায় উজ্জ্বল, সততার দীপ্তিতে দীপ্যমান এবং গণতন্ত্রের যাত্রাপথে এক অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা হয়ে।
বেগম খালেদা জিয়া নিছক কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নন, বরং এক অগ্নিঝরা ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি ছিলেন সেই নারী, যার পদচারণায় বদলে গিয়েছিল বাংলাদেশের রাজনীতি, যার চোখের দৃঢ়তায় আমাদের তারুণ্য খুঁজে পেয়েছিলো অহংকার, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শিক্ষা। তার রাজনীতি ছিল এক অবিরত সংগ্রাম। শোক, কষ্ট, ষড়যন্ত্র ভরা এক বিস্তীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র।
ইতিহাসের ঘটনাক্রম আজ বেগম খালেদা জিয়াকে এই মানচিত্রের, এই জাতিসত্তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীকে পরিণত করেছে। তিনি আজ সকল দলীয় গণ্ডির ঊর্ধে। তিনি দেশের এবং অখণ্ড জাতিসত্তার। মানবীয় সীমাবদ্ধতা তাকে দৈহিক অমরত্ব দেয়নি কিন্তু একজন নির্যাতীত মানুষকে বাংলাদেশের অস্তিত্বের পতাকা হিসেবে উড্ডীন করেছে।
বেগম খালেদা জিয়া কেবল একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী ছিলেন না; তিনি ছিলেন গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের এক অবিচল প্রতীক। তিনি দেখিয়েছেন, আপসহীনতা মানে শুধু বিরোধিতা নয়, বরং নীতির প্রতি অবিচল থেকে জনগণের পাশে দাঁড়ানো। বেগম খালেদা জিয়া’র এই অবস্থান তাকে সমর্থকদের কাছে যেমন অবিস্মরণীয় মর্যাদা দিয়েছে; তেমনি বিরোধীদের কাছেও একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও অদম্য নেতা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন।
পারিবারিক জীবন
বেগম খালেদা জিয়ার পারিবারিক নাম খালেদা খানম, ডাক নাম পুতুল। তার জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে। তার আদিবাড়ি ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায়। বাবার নাম ইস্কান্দর মজুমদার এবং মা বেগম তৈয়বা মজুমদার। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়ন করেন।
তিনি সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের স্ত্রী ছিলেন। ১৯৮১ সালের ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কিছু সেনা সদস্যের গুলিতে নিহত হন জিয়াউর রহমান। স্বামীর মৃত্যুর পরই তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। রাজনীতিতে আসার আগ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া একজন সাধারণ গৃহবধূ ছিলেন।

রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম না নিলেও ইতিহাসের এক চরম প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যখন মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তখন বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন সেনানিবাসে অন্তরীণ। দুই শিশু সন্তানসহ অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে কাটিয়েছেন তার বন্দিজীবন। পাকিস্তানি সেনারা তাকে ও তার সন্তানদের বন্দী করে রেখেছিল এবং এই সময়ে তিনি যে মানসিক দুর্ভোগ সহ্য করেছেন, সেটি তাকে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনে দৃঢ়তা দিয়েছে ও আপসহীন এক নেতৃত্ব তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বেগম জিয়ার দুই ছেলে। বড় ছেলে তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়াতে মারা যান।
রাজনৈতিক জীবন
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তিনি প্রথম বক্তৃতা করেন। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে পার্টির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র সর্বোচ্চ পদে ছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব কেবল রাজনীতির মাঠেই সীমাবদ্ধ ছিল না; দুর্যোগ মোকাবিলা, গণমানুষের দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেওয়া এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা–সব ক্ষেত্রেই তিনি অদম্য ছিলেন। তাঁর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে একটি সাধারণ সূত্র রয়েছে–নীতির প্রশ্নে আপসহীনতা।
বেগম খালেদা জিয়া’র রাজনৈতিক জীবন একদিকে যেমন অনুপ্রেরণার প্রতীক। অন্যদিকে তা হলো— এক অবিরাম সংগ্রামের ইতিহাস। তার আপসহীনতার প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হয় তখনই, যখন আমরা দেখি ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও তিনি নিরংকুশ ও একচেটিয়া ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হননি।
১৯৮২ সালে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনের সূচনা করেন খালেদা জিয়া। তিনি এরশাদের স্বৈরাচারের অবসান ঘটাতে ১৯৮৩ সালে গঠিত সাত দলীয় জোট গঠনের স্থপতি ছিলেন। তিনি ১৯৮৬ সালের কারচুপির নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তাঁকে সাতবার আটক করা হয়েছিল । ১৯৮০-এর দশকে এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কঠোর বিরোধিতা এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়া কখনও কোন নির্বাচনে হারেননি। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি সংসদ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন জেলার ১৮টি সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচন করে সবকটিতেই জয়লাভ করেন তিনি।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া সর্বোচ্চ অনুমোদিত পাঁচটি আসনে নির্বাচন করেছিলেন— বগুড়া-৬ ও ৭, ঢাকা-৯, ফেনী-১ এবং চট্টগ্রাম-৮ থেকে জয়ী হয়েছিলেন পাঁচটিতেই।
১৯৯৬- এর নির্বাচনেও খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন— বগুড়া-৬ ও ৭, ফেনী-১, লক্ষ্মীপুর-২ এবং চট্টগ্রাম-১ থেকে। বলাবাহুল্য, তিনি পাঁচটি আসনেই বিজয়ী হয়েছিলেন বিপুল ভোটে।
২০০১- এর নির্বাচনেও খালেদা জিয়া বগুড়া-৬ ও ৭, খুলনা-২, ফেনী-১ এবং লক্ষ্মীপুর-২—এই পাঁচ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন।

জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া।
২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন একজনের জন্য সর্বোচ্চ তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নির্ধারণ করলে খালেদা জিয়া সেবার বগুড়া-৬ ও ৭ এবং ফেনী-১ আসন থেকে নির্বাচন করে শতভাগ সফলতা অর্জন করেছিলেন। এমনকি ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটের’ নির্বাচনেও খালেদা জিয়া প্রার্থিতার আবেদন করেছিলেন; কিন্তু আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার রেকর্ডকে থামিয়ে দিতে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে খালেদা জিয়াই একমাত্র উদাহরণ, যিনি এযাবৎ চারটি সংসদীয় নির্বাচনে ১৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শতভাগ সফলতা পেয়েছেন। বিপরীতে শেখ হাসিনার বিজয়ের রেকর্ড তাঁকে যতটা সমৃদ্ধ করেছে, তার চেয়েও বেশি বিব্রত করেছে পরাজয়ের গ্লানি।
২০০৬ সালে, তিনি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে, তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্বাসনে পাঠানোর একাধিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দুর্নীতির তুচ্ছ এবং ভিত্তিহীন অভিযোগে স্বৈরাচারী সরকার গ্রেপ্তার করে। শারীরিক অসুস্থতা, পারিবারিক কষ্ট এবং রাজনৈতিক চাপ— সবকিছুর মাঝেও তিনি নীতিগত অবস্থান থেকে সরেননি। বরং তিনি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি’র ঐক্য অটুট রাখতে, জনগণের আস্থা ধরে রাখতে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান রাখতে নিজেকে কষ্টের পথে ঠেলে দেন।
২০০৯ সাল থেকে, যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করে, তখন তিনি গণতন্ত্রের জন্য তার লড়াই নতুন করে শুরু করেছিলেন। সরকার তাকে জোরপূর্বক তার বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন শুরু করায় তাকে দুইবার গৃহবন্দী করা হয়। গণতন্ত্রের প্রতি তার ভূমিকার জন্য, তাকে ২০১১ সালে নিউ জার্সির স্টেট সিনেট ‘গণতন্ত্রের জন্য যোদ্ধা’ উপাধিতে সম্মানিত করে।
২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি’র অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তও তার আপসহীন নেতৃত্বের প্রতিফলন। ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা না পেয়ে তিনি নির্বাচন বর্জন করেন; যদিও এটি রাজনৈতিকভাবে বড় ঝুঁকি ছিল। তার কাছে নীতি ও ন্যায়বিচার ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এরপরের সময়ে বেগম খালেদা জিয়া নানাবিধ মামলা, গ্রেপ্তার ও কারাবাসের শিকার হন। ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মিথ্যা ও সাজানো মামলায় সাজা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়, যেখানে তার স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি হয়। বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি বিদেশ যেতে না পারা এবং উন্নত চিকিৎসা না পাওয়ায় অসহনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন। সরকার বিভিন্ন সময়ে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাব দিলেও তিনি তাতে সম্মত হননি। কারণ সেই শর্তগুলো তাঁর রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থানকে ক্ষুণ্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ করত।
রাষ্ট্রীয় সাফল্য
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বেগম জিয়া। তার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার মেয়াদে কিছু বড় অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। কর্মসংস্থানের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এই সময়।
এই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতি, বিশেষ করে বাজারমুখী অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপগুলো ছিল দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পরিকল্পনা থেকে নেওয়া। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে তিনি দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি দেন। তাঁর শাসনামলে গার্মেন্টস শিল্প ব্যাপক প্রসার লাভ করে, যা আজকের বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— তিনি যে কোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন; যদিও সেসময় কিছু পদক্ষেপ রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
তিনি জাতিসংঘে গঙ্গার পানি-বণ্টনের সমস্যা উত্থাপন করেন যাতে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য অংশ পায়। ১৯৯২ সালে তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হলে সেখানে তিনি রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের সমস্যা উত্থাপন করেন এবং পরে মিয়ানমার সরকার ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সাথে একটি চুক্তি করে।
১৯৯৬ সালে বিএনপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর খালেদা জিয়া টানা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পুনরায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রতিশ্রুতির কারণে, তিনি এক মাসের মধ্যে পদত্যাগ করেন। যদিও বিএনপি ১৯৯৬ সালের জুনের নতুন নির্বাচনে হেরে যায়, দলটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে ১১৬টি আসন পায় সেই নির্বাচনে।
১৯৯৯ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে চারদলীয় জোট গঠন করে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করে। বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন। ফোর্বস ম্যাগাজিন নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে তার ভূমিকার জন্য ২০০৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় তাকে ২৯ নম্বরে স্থান দেয়।
২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বেগম খালেদা জিয়া কঠোর হাতে জঙ্গিবাদ দমন করেন, যা আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয়। এই সময়ে তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নতি, যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) শীর্ষ সম্মেলন সফলভাবে আয়োজন তাঁর কূটনৈতিক সক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ক্ষমতায় থাকাকালীন, খালেদা জিয়ার সরকার বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, ছাত্রীদের জন্য একটি শিক্ষা ‘উপবৃত্তি’ এবং শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য খাদ্য প্রবর্তন করে শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছিল। তার সরকার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করে এবং শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অবদান
বেগম খালেদা জিয়া’র নেতৃত্ব শুধু বাংলাদেশের ভেতরে সীমাবদ্ধ ছিল না; আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। তার কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী ছিল সুস্পষ্ট—বাংলাদেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে রাখা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দেশের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা। তিনি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করতেন যাতে দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা আদায় করা যায়। তাঁর শাসনামলে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও উন্নয়ন সহযোগিতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল যা অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে ব্যয় করা হয়।
তবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার দৃঢ় অবস্থান কেবল কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নয়; মানবাধিকার, নারী নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার ক্ষেত্রেও ছিল সুস্পষ্ট। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক গণমাধ্যম তাকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী নারী নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক অনন্য প্রতীক। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দুই শিশু সন্তানসহ বন্দিজীবন, স্বামী হত্যার শোক, স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন, তিনবার প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং অসংখ্যবার কারাবাস— সবকিছু মিলিয়ে তার জীবন এক লিজেন্ডারী ইতিহাস। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন থাকা এবং গণমানুষের অধিকারের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়াই তাঁকে সর্বজন স্বীকৃত ‘আপসহীন দেশনেত্রী’তে পরিণত করেছে।