ঢাকা: রাজনীতিতে ‘নাম’ কখনো কখনো নিজেই একটি বার্তা হয়ে ওঠে। কিছু নাম কেবল পরিচয় নয়, বরং ইতিহাস-আবেগ ও প্রত্যাশার সমষ্টি। কোনো কোনো নাম তো ইতিহাসকেই নির্মাণ করে দেয়। আবার কোনো নামই হয়ে ওঠে ‘ব্রান্ড’। ‘জিয়া পরিবার’ তেমনই একটি নাম; যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনা, সামরিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে উত্তরণ, ক্ষমতায় আরোহণ ও ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার পর প্রতিপক্ষের জুলুমের শিকার।
শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান থেকে বেগম খালেদা জিয়া, খালেদা জিয়া থেকে তারেক রহমান, তারেক রহমানের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ আলোচিত নাম জাইমা রহমান। আসছে ২৫ নভেম্বর দীর্ঘ দেড়যুগ পর বাবা তারেক রহমানের সঙ্গে দেশে ফিরছেন তিনিও। তাই প্রশ্ন উঠেছে, জাইমা কি ভবিষ্যতে রাজনীতির নেতৃত্ব আসবেন?
উত্তরাধিকার রাজনীতির বাস্তবতা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নতুন কোনো ধারণা নয়। ‘শেখ মুজিবর রহমান পরিবার’ কিংবা ‘জিয়া পরিবার’— এই দুটি ধারা প্রমাণ করেছে, রাজনীতিতে পরিবারের যে কেউ যোগ্যতা বলে নেতৃত্ব দিতে পারে। এই বাস্তবতায় জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার নাতনি এবং তারেক রহমানের একমাত্র কন্যা হিসেবে জাইমা রহমানের রাজনীতির আলোচনায় আসা প্রায় অনিবার্যই ছিল। তবে জাইমার ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম। তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন দৃশ্যপটের বাইরে— না আন্দোলনে, না বক্তৃতায়, না দলীয় কোনো পদ-পদবি। তার নামটি এতদিন ছিল ‘সম্ভাবনার তালিকায়’।

দাদি বেগম খালেদা জিয়ার কোলে নাতনি জাইমা রহমান। ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রথম ইঙ্গিত
জাইমার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার প্রথম ইঙ্গিত আন্তর্জাতিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত ‘ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্ট’-এ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ। ওই সময় তার এই অংশ নেওয়াকে রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এটি কোনো দলীয় সম্মেলন বা রাষ্ট্রীয় সফর না হলেও বিশ্ব রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এমন একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিনিধিত্ব করা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসাজনিত কারণে তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে কন্যাকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো শুধু পারিবারিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক বার্তাও বহন করে। এতে একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিএনপির উপস্থিতি বজায় ছিল, অন্যদিকে জিয়া পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মকে ধীরে ধীরে পরিচিত করার কৌশলও স্পষ্ট হয়েছে।
ভার্চুয়াল বৈঠকে অংশগ্রহণ
গত ২৩ নভেম্বর প্রবাসী বিএনপি ও দলীয় নেতাদের সঙ্গে তার প্রথম অনলাইন বৈঠক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের নজর কাড়ে। এটিকে অনেকেই তার ‘রাজনৈতিক প্রস্তুতির নীরব সূচনা’ হিসেবে দেখেন। গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকে অংশগ্রহণকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে বিএনপি ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অভিনন্দন জানিয়েছেন জাইমাকে। এমনকি নেটিজেনরা ফেসবুকে জাইমা রহমানের প্রশংসা করে লিখেছেন ‘জিয়া পরিবারের সুনাম ধরে রাখবে, বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্ণধার, শহিদ জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি’ ইত্যাদি মন্তব্য।
অবশেষে দেশে ফেরা
দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব তারেক রহমান। সেইসঙ্গে ফিরছেন কন্যা জাইমা রহমানও। তার এই দেশে ফেরা রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা হিসেবেই দেখছেন নেতাকর্মীরা। জাইমার ফেসবুক পোস্টগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তিনি ভাষা বেছে নিচ্ছেন অত্যন্ত সতর্কভাবে— না অতিরিক্ত রাজনৈতিক স্লোগান, না চূড়ান্ত ঘোষণা। বরং ‘দায়িত্বশীল নাগরিক’, ‘দেশকে নতুন করে জানা’, ‘মানুষের পাশে থাকা’— এই শব্দগুলো দিয়ে নিজেকে ধীরে ধীরে জনপরিসরে উপস্থাপন করছেন।

বাবা-মার সঙ্গে জাইমা রহমান। ছবি: সংগৃহীত
উত্তরাধিকার বনাম যোগ্যতার বিতর্ক
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। জাইমা রহমানের ক্ষেত্রেও সেই বিতর্ক উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সমালোচকদের একাংশ মনে করেন, তিনি মূলত পারিবারিক পরিচয়ের কারণেই আলোচনায় আসছেন। তবে সমর্থকদের যুক্তি ভিন্ন। তাদের মতে, একজন শিক্ষিত, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তরুণ নেতৃত্ব বিএনপির জন্য সময়োপযোগী হতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রমিত আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিয়া পরিবারের উত্তরসূরি হিসেবে জাইমা রহমানের রাজনীতিতে আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার উপস্থিতি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতির অংশ।’
অন্যদিকে প্রবীণ এক রাজনীতিকের মতে, এটি এখনো আনুষ্ঠানিক রাজনীতিতে প্রবেশ নয়, বরং ‘গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের প্রাথমিক ধাপ’। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হিসেবে তার রাজনীতিতে আসা স্বাভাবিক এবং ভবিষ্যতে তিনি বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। সিনিয়র নেতারা জাইমা রহমানের মধ্যে খালেদা জিয়ার প্রতিচ্ছবি দেখছেন। তারা বলেছেন, জাইমা রাজনীতিতে এলে বাংলাদেশের রাজনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
বিএনপির প্রজন্মগত সেতুবন্ধনে জাইমা
বিএনপির নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় জাইমা রহমান একটি সেতুবন্ধন হতে পারেন পুরোনো আবেগ ও নতুন সময়ের মধ্যে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—তিনি কি মাঠের রাজনীতিতে নামবেন? আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন? নাকি থাকবেন নীতিনির্ধারণ, কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের স্তরে?
এদিকে সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে বলা যায়, জাইমা রহমান রাজনৈতিক অঙ্গণে একটি পরিকল্পিত সম্ভাবনা। তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হলে তা হবে ধীরে, নিয়ন্ত্রিতভাবে ও সম্ভবত ভিন্ন কৌশলে। কারণ, জাইমা আর কেবল একটি পারিবারিক নাম নয়। তিনি এখন একটি রাজনৈতিক সম্ভাবনা, যার দিকে দৃষ্টি রাখতে শুরু করেছে দেশ।

পরিবারের সঙ্গে জাইমা রহমান। ছবি: সংগৃহীত
পারিবারিক পরিচয় ও শৈশব
১৯৯৫ সালের ২৬ অক্টোবর ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে জন্ম জাইমা রহমানের। তার শৈশব কেটেছে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাসায়, যেখানে দীর্ঘদিন বসবাস করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এই বাসাটিই একসময় ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও ঘটনার নীরব সাক্ষী। ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও জাইমাকে কখনো প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি।
ঢাকার বারিধারায় ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অব ঢাকায় (আইএসডি) ইংরেজি মাধ্যমে তার শিক্ষাজীবন শুরু। ২০০৮ সালে ১/১১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান জাইমা। এরপর দীর্ঘ সময় প্রবাসে কাটলেও জিয়া পরিবারের উত্তরসূরি হিসেবে তার নাম বিএনপির নেতাকর্মীদের আলোচনায় থেকেছে নীরবে, অনেকটা সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে।
প্রবাস জীবন ও শিক্ষা
লন্ডনে গিয়ে জাইমা রহমান তার উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং আইন বিষয়ে ব্যারিস্টার হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করেন। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হলেও তার পরিচয় এতদিন মূলত একজন শিক্ষিত, পেশাদার তরুণী হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা দলীয় কর্মসূচিতে তার দৃশ্যমান উপস্থিতি না থাকায় বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রশ্নে তার নাম কখনোই আনুষ্ঠানিক আলোচনায় আসেনি। কিন্তু ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘জাইমা রহমান’ নামটি ধীরে ধীরেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।