ঢাকা: দেশ গড়তে চায় বিএনপি। সেজন্য সম্প্রতি তারা ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ শীর্ষক একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটি স্লোগান সামনে এনেছেন— সবার আগে বাংলাদেশ। এই স্লোগানকে সামনে রেখে দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে আগামীতে দেশ গড়তে চায় বিএনপি।
দলীয় সূত্র জানায়, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের সুযোগ পেলে প্রথমেই যে কাজটি তারা করবে সেটি হলো, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। এটি বিএনপির অন্যতম অঙ্গীকার। সে লক্ষ্যে যেসব কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে তা স্পষ্ট জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা জানায়, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। পরাজিত হয় আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত আওয়ামী লীগ। ১০ অক্টোবর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের অব্যাহত দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক লুটপাটের ফলে দেশ মারাত্মক সংকটে পড়ে। দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় আওয়ামী লীগ।
২০০১ সালের ২৬ জুন জার্মানভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত করাপশন পার্সেপশন্স ইনডেক্স (সিপিআই) অর্থাৎ দুর্নীতির সূচকে দেখা যায়, বাংলাদেশ বিশ্বে চ্যাম্পিয়ন। পরে ওই আওয়ামী লীগই বিএনপিকে দোষারোপ করে সারাবছর প্রচার চালায় বিএনপি বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছে। বিএনপির অভিযোগ, আওয়ামী লীগই দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করে রেখে যায়। যা প্রকাশ্যে আসে বিএনপির আমলে। সেটাকেই হাতিয়ার বানায় আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে বিএনপির দলীয় বক্তব্য হলো, ২০০১ সালের জুন মাসে টিআইবির সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ছিল ০.৪। আর এটা ছিল ৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী দুর্নীতির ফসল। পরে বিএনপি দায়িত্ব নিয়েই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। কঠোরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে সম্পূর্ণ স্বাধীন সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করে।
বিএনপি বলছে, তারা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে নানাবিধ পদক্ষেপ নেবে। ফলে প্রথম বছর থেকেই দুর্নীতির সূচক কমতে থাকে। ২০০২ সালে প্রকাশিত টিআইবি রিপোর্টে বাংলাদেশের স্কোর উন্নীত হয় ১.২, ২০০৩ সালে ১.৩, ২০০৪ সালে ১.৪, ২০০৫ সালে ১.৫ এবং ২০০৬ সালে ২.০ হয়। এই রিপোর্ট সূত্রেই বোঝা যায়, বিএনপির সময় দুর্নীতি ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে।
দলীয় নেতারা বলেন, দুর্নীতি দমনে বিএনপি সরকারের কঠোর পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কলঙ্ক থেকে মুক্তি পায়। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে বিএনপি যখন রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় তার আগেই বিশ্বে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের অপবাদ থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব ও বিএনপির দেশ গড়ার পরিকল্পনার বিষয়ক কমিটির আহবায়ক রুহুল কবির রিজভী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি জনগণের রায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে কঠোরভাবে দুর্নীতি এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণই হবে বিএনপির প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার।’
গত ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে দেশ গড়ার পরিকল্পনা শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার ট্র্যাক রেকর্ড বিএনপির আছে। এ কাজটি করতে গিয়েই খালেদা জিয়া সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করেছিল। সে সময় এ কমিশনকে এতটাই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল যে, সরকারের কোনো বিষয়ে তদন্ত করতে চাইলে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন ছিল না। এই নিয়ম স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার পালটে দিয়েছিল। বিএনপি জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় এলে প্রয়োজনে দেশের স্বার্থে এটি আবার পরিবর্তন করা হবে।’
দুর্নীতির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাও ঠিক রাখতে হবে উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘দুর্নীতির মতো আমাদের আরেকটি কাজে সফল হতে হবে। সেটাও দুর্নীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেটি হচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা। যেকোনো মূল্যে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে।’
প্রসঙ্গত, গত ২৭ নভেম্বর দেশ গড়ার পরিকল্পনা বিষয়ক একটি কমিটি গঠন করে বিএনপি। কমিটির আহবায়ক করা হয় দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদকে এবং সদস্য সচিব করা হয় যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন-নবী খান সোহেলকে। সদস্য করা হয় ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার, ড. মাহদী আমিন, আমিনুল হক, মীর শাহে আলম, কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন, আব্দুল মোনায়েম মুন্না, এস এম জিলানী, নুরুল ইসলাম নয়ন, শহীদুল ইসলাম বাবুল, রাজিব আহসান, নিপুন রায় চৌধুরী, মো. আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী, রাকিবুল ইসলাম রাকিব, মো. নাছির উদ্দিন, মাওলানা মো. সেলিম রেজা, মাওলানা কাজী মো. আবুল হোসেন, ড. সাইমুম পারভেজ, ড. আব্দুল মজিদ, কামরুল ইসলামকে।
গত ৭ থেকে ১৩ ডিসেম্বর ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ কর্মসূচির সাত দিনব্যাপী কর্মসূচি শুরু হয়। প্রথম দিন ৭ ডিসেম্বর কর্মসূচির উদ্বোধন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ৮ ডিসেম্বর ছাত্রদল আয়োজিত কর্মসূচি উদ্বোধন করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। ৯ ডিসেম্বর স্বেচ্ছাসেবক দল ও ওলামা দলের যৌথ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
১০ ডিসেম্বর যুবদল ও কৃষক দলের যৌথ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। ১১ ডিসেম্বর বিএনপি আয়োজিত দিনব্যাপী কর্মসূচি উদ্বোধন করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ১৩ ডিসেম্বর বিএনপির আয়োজনে সমাপনী কর্মসূচি উদ্বোধন করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সবগুলো কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।