ঠাকুরগাঁও: ইটভাটার কালো ধোঁয়া আর ক্ষতিকর গ্যাস পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। আর মিথেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইডের মতো গ্যাস বাতাসে মিশে বাড়াচ্ছে তাপমাত্রা, ক্ষতিগ্রস্ত করছে শ্বাসতন্ত্র, ত্বক ও ফসল। এই বাস্তবতায় পরিবেশ দূষণ কমাতে ঠাকুরগাঁওয়ে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে পরিবেশবান্ধব কার্বন পিউরিফিকেশন প্লান্ট (সিপিটি প্লান্ট)।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিজের ইটভাটা রূপান্তর করেছেন ঠাকুরগাঁওয়ের এম.এ ব্রিক্স-৩ ইটভাটার স্বত্বাধিকারী আরিফুল ইসলাম জুয়েল। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের বকেশের হাট এলাকায় অবস্থিত তার ইটভাটাতেই প্রথমবারের মতো এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে যেমন পরিবেশ দূষণ কমছে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও সুফল পাচ্ছেন ভাটার মালিক।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ ছিল, আগে ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় আশপাশের এলাকা প্রায়ই ঢেকে যেত। ধোঁয়ার কারণে শিশু ও বয়স্কদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেত। ফসলের পাতায় জমত কালো আস্তরণ। কার্বন পিউরিফিকেশন প্লান্ট চালুর পর সেই চিত্র অনেকটাই বদলেছে বলে জানান তারা।
আকচা ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল হক বলেন, আগে ইটভাটার ধোঁয়ায় ধানের পাতায় কালো আস্তরণ পড়ে যেত। জমিতে কাজ করলে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো। এখন ধোয়া কম হওয়ায় ফসল আগের চেয়ে ভালো আছে।
একই এলাকার কৃষক মোস্তাফিজার বলেন, ভাটার ধোঁয়ার কারণে আগে আলু আর সবজির ক্ষতি হতো। কার্বন পিউরিফিকেশন প্লান্ট চালুর পর সেই সমস্যা অনেক কমেছে। এবার ফলনও ভালো হবে আশা করা যায়।
কার্বন পিউরিফিকেশন প্লান্ট সম্পর্কে আরিফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, আধুনিক এই চিমনি মূলত আটটি চেম্বারে কাজ করে। চিমনি দিয়ে বের হওয়া কালো ধোঁয়া প্রথমে আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার স্প্রে চ্যানেলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানির স্প্রের মাধ্যমে ধোঁয়ার ভেতরের কার্বন কণা ও ক্ষতিকর উপাদান আটকে যায়। পরিশোধনের পর কালো ধোঁয়ার পরিবর্তে সাদা ও শীতল বাষ্প আকারে তা বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়।
তিনি আরও বলেন, আগে যে ধোঁয়া বের হতো, সেটি চোখে দেখা যেত। এখন ধোয়ার রং বদলেছে, তাপও কম। এতে পরিবেশের ক্ষতি কম হচ্ছে, মানুষের ভোগান্তিও কমছে।
এদিকে ইটভাটাটি পরিদর্শন করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ডা. মুরাদ আহম্মেদ ফারুক। পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ কমানো অত্যন্ত জরুরি। ইটভাটাগুলো দেশের বায়ুদূষণের বড় উৎস। এই খাতে কার্বন পিউরিফিকেশন প্লান্ট ব্যবহার করা গেলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।
তিনি আরও বলেন, ইটভাটা শিল্প একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে কমানো যায়। এম.এ ব্রিক্স-৩ ইটভাটায় যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও অনুসরণযোগ্য।
এ বিষয়ে রংপুর বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মো. নূর আলম বলেন, ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোয়া ও ক্ষতিকর গ্যাস বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। এসব গ্যাস পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করার পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। এই পরিস্থিতিতে কার্বন পিউরিফিকেশন প্লান্টের মতো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সময়ের দাবি।
তিনি বলেন, ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো গেলে কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। এতে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে, পাশাপাশি কৃষিজমি ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে। ঠাকুরগাঁওয়ে পরীক্ষামূলকভাবে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত ইতিবাচক এবং অনুকরণীয় উদাহরণ।