ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ‘বিজয়ের’ নতুন ইতিহাস রচনার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, যা লজ্জাজনক ও ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বিএনপির আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। সভায় সভাপতিত্ব করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ হঠাৎ করে সাগরের বুকে ভেসে ওঠা কোনো ভূখণ্ড নয়—লাখো শহিদের রক্ত, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম আর সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়েই এ দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেশি-বিদেশি অপশক্তি অতীতেও সক্রিয় ছিল, এখনো রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের রঙ-রূপ বদলালেও ষড়যন্ত্রের চরিত্র বদলায়নি।’
তারেক রহমান বলেন, ‘দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল দিন হলো মহান বিজয় দিবস। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন এ দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কখনো মলিন হবে না।’
তবে একইসঙ্গে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা এখনো চলমান।’
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবন্ধটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। অথচ পতিত ও পলাতক একটি চক্র নিজেদের হীন দলীয় স্বার্থে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
তারেক রহমান বলেন, ‘‘ইতিহাসকে দলীয় ইতিহাসে পরিণত করার এই অপরিণামদর্শী চেষ্টার সুযোগ নিয়েই আজ মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ‘বিজয়ের’ নতুন ইতিহাস রচনার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, যা লজ্জাজনক ও ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।’’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘ইতিহাস নিয়ে গবেষণা চলতেই পারে, তবে পরাজিতের মুখে বিজয়ের ইতিহাস রচনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করে বিজয়ের সুফল দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমেই একটি স্বনির্ভর, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এটাই এবারের বিজয় দিবসের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।‘
তিনি বলেন, ‘জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত না হলে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র কখনোই টেকসই হবে না। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, যতবার দেশে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে, ততবারই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কিংবা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, প্রতিটি বাঁকে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।‘
তারেক রহমান বলেন, ‘জনগণকে ক্ষমতাহীন করে রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো শক্তিশালী হতে পারে না। জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠাই জনগণকে ক্ষমতাবান করার পূর্বশর্ত। এ কারণেই বিএনপি সবসময় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘নানা অজুহাত ও শর্ত জুড়ে দিয়ে একাধিক স্বার্থবিরোধী চক্র বারবার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে সব বাধা উপেক্ষা করে প্রায় দেড় দশক পর নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে—যা গণতন্ত্রকামী জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন।’
তবে ষড়যন্ত্র এখানেই থেমে নেই উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘গণতন্ত্রের পক্ষের সাহসী সন্তান ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনাও সেই ষড়যন্ত্রের অংশ। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা গেলে কারা লাভবান হবে? নির্বাচন ছাড়াই সরকার বহাল থাকলে কাদের স্বার্থ রক্ষা হবে? জনগণের ভোটে সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে কারা খুশি হবে? এসব প্রশ্নের উত্তরেই ঘাতকদের পরিচয় লুকিয়ে রয়েছে।’
বিজয় দিবসের প্রাক্কালে দৃঢ় কণ্ঠে তারেক রহমান বলেন, ‘যারা স্বাধীনতাপ্রিয় ও গণতন্ত্রকামী জনগণকে ভয় দেখাতে চায়, তারা ব্যর্থ হবেই। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এগিয়ে গেলে ষড়যন্ত্রকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হবে।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯০ কিংবা ২০২৪ প্রতিটি আন্দোলনেই প্রমাণিত হয়েছে, জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলে জনতার বিজয় কেউ ঠেকাতে পারে না।‘
নির্ধারিত সময়েই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গ্রাম থেকে নগর, অলিগলি থেকে রাজপথ—সবখানে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার এই নির্বাচনি মিছিলে তিনি নিজেও শরিক থাকবেন।’
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘এটি কেবল একটি নির্বাচনি পরীক্ষা নয়; বরং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন এ নির্বাচনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।’
তিনি জানান, ‘আগামী দশক হবে রূপান্তরের দশক’—এই ভাবনা থেকেই বিএনপি ‘দেশ গড়ার কর্মসূচি’ নিয়েছে। নারী, তরুণ, কৃষক-শ্রমিকসহ দেশের বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে একটি স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই দলের লক্ষ্য।
শেষে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে শুভেচ্ছা জানান তারেক রহমান। একই সঙ্গে ১৯৭১ ও ২০২৪সহ গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শহিদদের রুহের মাগফিরাত এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন।