Sunday 14 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফজরের আজানের আগেই ১৪ মুক্তিযোদ্ধাকে ব্রাশফায়ার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:২৪ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ২২:১০

বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বাবুরপুকুর। ছবি: সারাবাংলা

বগুড়া: স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও বাবুরপুকুরের ভোর আজও রক্তমাখা। ফজরের নামাজের আগে যে রাতটি এসেছিল নিঃশব্দে, হায়েনার মতো চুপিসারে-সেই রাতেই নিভে গিয়েছিল ১৪টি মুক্তিকামী প্রাণ। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর, রমজানের পবিত্র সেহরির সময়। ঘরে ঘরে যখন রোজার প্রস্তুতি, তখনই শান্তি কমিটির সহযোগিতায় পাকবাহিনী টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যায় বগুড়ার ঠনঠনিয়া এলাকার ১৪ জন বীর সন্তানকে। ভোরের আলো আর তারা দেখেনি।

স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে যারা ঘর ছেড়েছিলেন, যারা ভেবেছিলেন-লাল-সবুজ পতাকার আলোয় নতুন সকাল আসবে-তারা ঠিকই দেশকে স্বাধীন করেছেন। কিন্তু নিজের জীবন বাঁচাতে পারেননি।

বিজ্ঞাপন

নিঃশব্দ হানা, নির্মম হত্যাযজ্ঞ

সেদিন গভীর রাতে বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া এলাকার শাহপাড়া, মণ্ডলপাড়া, তেঁতুলতলা, হাজীপাড়া ও পশারীপাড়ায় একযোগে হানা দেয় পাক হানাদার বাহিনী। সঙ্গে ছিল স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা। বাড়ি বাড়ি ঢুকে হাত-পা বেঁধে, চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয় মুক্তিকামী মানুষদের।

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মান্নান পশারী ও তার ভাই হান্নান পশারী, মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম, ন্যাপ কর্মী ওয়াজেদুর রহমান টুকু, জালাল মণ্ডল, মন্টু মণ্ডল, আব্দুস সবুর ওরফে ভোলা মণ্ডল, আলতাফ আলী, বাদশা শেখ, বাচ্চু শেখ, ফজলুল হক খান, টিঅ্যান্ডটির অপারেটর নূর জাহানসহ মোট ২১ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বগুড়া-নাটোর মহাসড়কের পাশে শাজাহানপুর উপজেলার বাবুরপুকুরে।

সেখানে শান্তি কমিটির নেতার শনাক্তকরণে ১৪ জনকে আলাদা করা হয়। সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে চালানো হয় ব্রাশফায়ার। মুহূর্তে নিথর হয়ে পড়ে ১৪টি দেহ। বাকি সাতজন প্রাণে বেঁচে ফিরলেও তাদের চোখে-মনে সেই রাত আজও দগদগে ক্ষত।

গণকবর, নীরব কান্না আর অপেক্ষার শেষ নেই

হত্যাযজ্ঞ শেষে মরদেহগুলো সেখানেই ফেলে রাখা হয়। পরে খবর পেয়ে স্বজনরা ছুটে এলেও লাশ বাড়ি নেওয়ার সুযোগ মেলেনি। বাবুরপুকুরেই ১৪ শহিদকে একসঙ্গে দাফন করা হয়-একটি বধ্যভূমিতে, কোনো চিহ্ন ছাড়াই।

১৯৭৯ সালে বগুড়া প্রেসক্লাবের উদ্যোগে কবরগুলো পাকা করা হয়। এরপর ২০০৯ সালে জেলা পরিষদের উদ্যোগে সেখানে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ। ঠনঠনিয়া এলাকা নাম পায় ‘ঠনঠনিয়া শহীদনগর’। ১৯৭২ সালেই রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের শহিদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

শহিদ পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, কেউ শহিদ পরিবারের খবর রাখে না। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে শুধু শহিদ পরিবারের কোনো কোনো সদস্যকে ডাকা হয়। একটি শাড়ি কিংবা অন্যকিছু উপহার দেওয়া হয়। এরপর আর কোন খবর থাকে।

শহিদ পরিবারের সদস্যরা বলেন, সেই ভোরের স্বপ্ন আজও তাড়া করে ফেরে। মনে হয়, ভোর হলেই ছেলেরা, ভাইরা, স্বামীরা ফিরে আসবে। কিন্তু সেই ফেরা আর হয়নি কোনোদিন।

বগুড়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কালাম আজাদ বলেন, ‘বাবুরপুকুরের হত্যাযজ্ঞ শুধু ইতিহাস নয়, এটি এক জীবন্ত বেদনা। ১৪ জনের সেই আত্মত্যাগ আজও মানুষকে কাঁদায়।’

জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমান জানান, বীর শহিদদের স্মৃতি সংরক্ষণে জেলা প্রশাসন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। স্মৃতিসৌধের উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর