রংপুর: ঘাঘট নদীর তীরে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলে যেন চিৎকার শোনা যায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষের আর্তনাদ, মেশিনগানের গর্জন, রক্তে লাল হয়ে যাওয়া নদীর জল। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ, রংপুরের সেনানিবাস আক্রমণের চেষ্টায় জড়ো হয়েছিলেন হাজারো বিক্ষুব্ধ বাঙালি, হাতে লাঠি, বল্লম, তির-ধনুক। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলির ঝাঁঝরা হয়ে গেল সেই স্বপ্ন।
হাজারো শহিদের মরদেহ লুটিয়ে পড়ল নদীর তীরে, জল হয়ে গেল রক্তের স্রোত। আজ, ৫৪ বছর পর, সেই বধ্যভূমিগুলো অযত্নে পড়ে আছে, বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। সরকারি বরাদ্দের অভাবে, ব্যক্তি মালিকানার জটিলতায় আটকে আছে সংরক্ষণের কাজ। বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সেই রক্তাক্ত আত্মত্যাগের, অবহেলার এবং একটি জাতির ভুলে যাওয়া নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে সর্বত্র। চোখে জল, নতুন প্রজন্মের অজান্তায় ভুলে যাওয়া এই স্মৃতিগুলো কি শুধু ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে-এমন প্রশ্ন এখন সামনে আসছে।

ঐতিহাসিক পটভূমি: গণহত্যার শুরু এবং রংপুরের ভূমিকা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুরু করল বিশ্বের নজিরবিহীন গণহত্যা। তিন মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি, দুই থেকে চার লাখ নারীর উপর পাশবিক নির্যাতন—এটি ছিল না শুধু যুদ্ধ, একটি পরিকল্পিত জাতিগত নিধন। রংপুরে এই গণহত্যা শুরু হয় আরও আগে, ৩ মার্চ থেকে। ছোট্ট শিশু শঙ্কু শমাজদার, যাকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহিদ, সেই দিনই প্রাণ দেন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। রংপুর সেনানিবাস ছিল পাক বাহিনীর ২৩তম ব্রিগেডের হেডকোয়ার্টার, যেখান থেকে পরিচালিত হয় সারা বিভাগের হত্যাকাণ্ড। সাঁওতাল নেতা বুন্দো ওদাওনের নেতৃত্বে বাঙালিদের যৌথ আক্রমণও এখানে ব্যর্থ হয়, ফলে শুরু হয় ব্যাপক গণহত্যা। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের প্রফেসর ড. মো. মোহশিন রেজার ‘Genocide at Rangpur City in the Liberation War of Bangladesh, 1971: Fire, Fury and Fragrance (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রংপুর শহরে গণহত্যা, ১৯৭১: আগুন, ক্রোধ এবং সুগন্ধি’ গবেষণায় দেখা গেছে, রংপুর শহরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়, আর ধ্বংস হয় ২০ হাজারের মতো ঘর। স্বাধীনতার পর ৫ হাজারেরও বেশি বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে সারা দেশে, কিন্তু রংপুরে মাত্র ১৩টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। বাকিগুলো অজানা, অরক্ষিত, অবহেলিত।

বধ্যভূমিগুলোর হৃদয়বিদারক গল্প: একেকটি রক্তের ছাপ
রংপুরের বধ্যভূমিগুলো যেন জীবন্ত সাক্ষী। প্রতিটিতে লুকিয়ে আছে অসংখ্য আত্মত্যাগের কাহিনি। যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে যুদ্ধচলাকালীন সময়ের সেই ভয়াবহ দৃশ্য।
ঘাঘট নদতীরের বধ্যভূমি: ২৮ মার্চের সেই দিন, হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছিল সেনানিবাস আক্রমণে। পাক বাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন তারা, নদীর জল হয়ে গেল রক্তের। আজ এখানে ‘রক্ত গৌরব’ স্মৃতিস্তম্ভ আছে, কিন্তু অযত্নে পড়ে আছে। বীরমুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু বলেন, ‘এই নদীতে আমার সঙ্গীদের রক্ত মিশেছে, কিন্তু নতুন প্রজন্ম জানে না এর কথা।’
দমদমা বধ্যভূমি: কারমাইকেল কলেজ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে, ৩০ এপ্রিল পাক বাহিনী হত্যা করে কলেজের ছয় অধ্যাপক শাহ্ মোহাম্মদ সোলায়মান, আব্দুর রহমান, রামকৃষ্ণ অধিকারী, কালাচাঁদ রায়, সুনীলবরণ চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন রায় এবং কালাচাঁদ রায়ের সহধর্মিণী মঞ্জুশ্রী রায় প্রমুখ। প্রতিদিন এখানে বাঙালিদের হত্যা হতো। আজ স্মৃতিসৌধ আছে, কিন্তু ধুলোয় ঢাকা। বীরমুক্তিযোদ্ধা নূরুল আমিন বলেন, ‘আমরা প্রাণ দিয়েছি, কিন্তু সরকার ভুলে গেছে।’

রংপুর টাউন হল বধ্যভূমি: এখানে ছিল নারী নির্যাতনের কেন্দ্র। পাক বাহিনী ও রাজাকাররা মেয়েদের আটকে নির্যাতন করে হত্যা করত, মরদেহ ফেলত কূপে। স্বাধীনতার পর কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে। ২০২০ সালে সংস্কারের সময় রক্তমাখা কাপড় পাওয়া যায়। আজ স্মৃতিস্তম্ভ আছে, কিন্তু অরক্ষিত। বীরমুক্তিযোদ্ধা শরীফ উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘এখানে রাতের অন্ধকারে নারীদের নির্যাতন করা হতো। চিৎকার, গোঙ্গানির শব্দে আশপাশ ভারি হয়ে যেত। কূপে মরদেহের স্তূপ পড়ে থাকতো।’
দখিগঞ্জ শ্মশান বধ্যভূমি: ৩ এপ্রিল, পাক বাহিনী ১১ জনকে হত্যা করে। স্থানীয় মন্টু ডাক্তার অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তার সঙ্গী ছিলেন ন্যাপ নেতা ইয়াকুব মাহফুজ আলী। আজ স্মৃতিস্তম্ভ অযত্নে পড়ে আছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা মন্টু ডাক্তার অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই বললেন, ‘আমি বেঁচে গেলাম, কিন্তু স্মৃতি মরে যাচ্ছে।’

রংপুর সেনানিবাস গণকবর: এখানে ২০০ বাঙালি সেনা ও ইপিআর সদস্যের মরদেহ পুঁতে রাখা হয়। স্বাধীনতার পর ১০ হাজার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ১২ এপ্রিল সৈয়দপুর থেকে মাড়োয়ারিদের হত্যা করে এখানে পুঁতে রাখা হয়। আজ গণকবর নেই, আছে শুধু স্মৃতিফলক।
জাফরগঞ্জ পুল বধ্যভূমি: ১৪ এপ্রিল, ১৯ জনকে হত্যা করা হয় এখানে। সদরুল আলম দুলু বলেন, ‘আজ এখানে কোনো স্মৃতিফলক নেই, নতুন প্রজন্ম জানেই না যে জাফরগঞ্জে বীরত্বগাঁথা স্মৃতি আছে।’
নিশবেতগঞ্জ বধ্যভূমি: নিশবেতগঞ্জ সেতু এলাকায় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অসংখ্য খুলি ও কঙ্কাল পাওয়া যায়। ১ এপ্রিল ১২ জনকে হত্যা। আজ অরক্ষিত।

ঝাড়ুয়ার বিল: ঝাড়ুয়ার বিলে ৪০০ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এটিই রংপুরের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। আর পদ্মপুকুর বধ্যভূমিতে ১৫ এপ্রিল ১,৫০০ মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে স্মৃতিস্তম্ভ হলেও কিন্তু অরক্ষিত।
বালারখাইল বধ্যভূমি: ১২ এপ্রিল ৩ ট্রাক বাঙালিকে হত্যা করে এনে ফেলে পুঁতে রাখা হয়।
এছাড়া মহিগঞ্জ শ্মশানঘাটে, ৩ এপ্রিল ১১ জনকে হত্যা, সাহেবগঞ্জ বধ্যভূমিতে ১৯ বাঙালি সেনাকে হত্যা যা ২০২০ সালে হাড় উদ্ধার করা হয়। মডার্ন সিনেমা হল বধ্যভূমিতে ১ মে ১৯ সেনাকে হত্যা করা হয়। নভেম্বরে ৩০০ বন্দিকে নির্যাতন। বৈরাগীগঞ্জ বধ্যভূমি, বলদিপুকুর বধ্যভূমি, দেবীপুর বধ্যভূমি, কুকুরুন বিল বধ্যভূমি, শিবগঞ্জ এলাকা বধ্যভূমি, জয়রাম আনোয়ার মৌজা বধ্যভূমি নব্দীগঞ্জ বধ্যভূমি, লাহিরীর হাট বধ্যভূমি, নজিরের হাট বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয় যার কোনো হিসাব বা বিস্তারিত জানা নেই কারও।

বীরমুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ এবং আত্মত্যাগের স্মৃতি
বীরমুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা প্রাণ দিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম, কিন্তু বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষিত হয়নি। নতুন প্রজন্ম জানে না আমাদের ত্যাগ।’
বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমিন বলেন, ‘পাক বাহিনীর সঙ্গে রাজাকার-আলবদরের সহযোগিতায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আজও সেই ভয়াবহতা মনে পড়লে শরীর কাঁপে। নতুন প্রজন্মের অজ্ঞতা তাদের ক্ষোভ বাড়ায়। স্কুলে ইতিহাস পড়ানো হয় না, স্মৃতিস্তম্ভগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে।
সংরক্ষণের অবস্থা: প্রশাসনের বক্তব্য এবং বিশ্লেষণ
রংপুর বিভাগে ৩৯৫টি গণহত্যা হয়েছে, যার ফলে গণকবর ও বধ্যভূমি গড়ে ওঠে। কিন্তু অনেক জমি ব্যক্তি মালিকানায়, মালিকরা স্বীকার করেন না। হালচাষ বা অবকাঠামোয় হারিয়ে যাচ্ছে। ২০১২ সালে সংস্কারের বরাদ্দ আসে, কিন্তু শেষ হয়ে যায়। ফাইল লাল ফিতায় বন্দি। গণপূর্ত বিভাগ বলছে, বরাদ্দ এলে কাজ শুরু হবে, কিন্তু জটিলতা অধিগ্রহণে। রংপুর জেলা বীরমুক্তিযোদ্ধা সংসদের সূত্রে, জেলায় ১৩টি চিহ্নিত, কিন্তু অনেক অজানা। রংপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু বলেন, ‘অনেক বধ্যভূমি সংরক্ষিত হয়নি। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে সংরক্ষণ জরুরি।’
গণপূর্ত অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বরাদ্দ না আসায় সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না। ব্যক্তি মালিকানার জমি অধিগ্রহণ জটিল।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি জায়গায় কোনো জটিলতা নেই, কিন্তু ব্যক্তি মালিকানায় আটকে আছে। ফলে অনেক বধ্যভূমি দখলের মুখে, হালচাষে মিশে যাচ্ছে। যা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এটি শুধু ইতিহাসের অপমান নয়, শহিদদের প্রতি অশ্রদ্ধা। সূত্র জানায়, রংপুরে পাঁচটি বধ্যভূমির সংস্কারের সিদ্ধান্ত কাগজে সীমাবদ্ধ, তিনটি ব্যক্তি মালিকানায়। ২০২৫ সালেও অবস্থা একই বরাদ্দের অভাবে থমকে আছে কাজ।
চতরা ডিগ্রী কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হারুন অর রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘রংপুরের বদ্ধভূমিগুলোতে আজও যেন লুকিয়ে আছে সেই হাজারো শহিদের আর্তনাদ। সেই রক্তের দাগ আজও মুছে যায়নি, কিন্তু বধ্যভূমিগুলো অযত্নে, অবহেলায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সরকারি বরাদ্দ ফুরিয়ে গেছে, ব্যক্তি মালিকানায় জমি অধিগ্রহণের জটিলতায় আটকে আছে সংস্কার কাজ। রংপুর জেলায় চিহ্নিত ১৩টি বধ্যভূমির মধ্যে মাত্র কয়েকটিতে স্মৃতিস্তম্ভ আছে, বাকিগুলো দখলের মুখে। এই অবহেলা শুধু ইট-পাথরের নয়, এটি সেই ত্যাগের অপমান যা ৩০ লাখ শহিদের রক্তে লেখা।’
বীরমুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ভুলে গেলে আমরা কী হব–এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘এই বধ্যভূমিগুলো শুধু স্থান নয়, এগুলো জীবন্ত স্মৃতি। রংপুরের তাঁরাগঞ্জে এক বীরমুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে আরও ব্যথিত করে। আমাদের দায়িত্ব এই স্মৃতিগুলো রক্ষা করা, নতুন প্রজন্মকে জানানো। রংপুরের বধ্যভূমিগুলো যেন অযত্নে হারিয়ে না যায়, যেন সেই রক্তের দাম আমরা ভুলে না যাই। সরকারি উদ্যোগ, সমাজের সচেতনতা—এটাই এখন সময়ের দাবি। কারণ, এই স্মৃতি হারালে হারাবে আমাদের পরিচয়।’
তিনি বলেন, ‘সময় হয়েছে দ্রুত বরাদ্দ, অধিগ্রহণ এবং শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির। যেন স্মৃতি চিরকাল জীবন্ত থাকে। যদি না সংরক্ষণ হয়, নতুন প্রজন্ম ভুলে যাবে এই ইতিহাস।’ বীরমুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ থাকাটা সঙ্গতই ‘আমরা প্রাণ দিলাম, কিন্তু দেশ ভুলে গেল।’