Wednesday 10 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইউনেস্কো’র স্বীকৃতি পেল টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৮:২২

টাঙ্গাইলের হাতে বোনা তাঁতের শাড়ি। ছবি: সারাবাংলা

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের হাতে বোনা তাঁতের শাড়ি এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। আর এর পুরস্কারস্বরূপ দেশের ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুননশিল্প’কে বিশ্বের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। গত মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) বিকেলে ভারতের লালকেল্লায় অনুষ্ঠিত ২০তম ইউনেস্কো বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তঃসরকারি কমিটির অধিবেশনে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

শতাব্দীপ্রাচীন এই তাঁতের শাড়ির উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে। বিশেষ ধরনের উৎকৃষ্ট মানের সুতা দিয়ে হাতে বোনা এ শাড়ি পড়তে যেমন আরামদায়ক, তেমনই নরম। আর তাই যেকোনো অনুষ্ঠানেই বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দ টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়ি। নিজের জন্য কিংবা প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার জন্য টাঙ্গাইলের এই তাঁতের শাড়ির জুড়ি নেই।

বিজ্ঞাপন

প্রবাদ আছে ‘নদী-চর, খাল-বিল, গজারির বন-টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন।’ টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি দেশ পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। বিশেষ ধরনের উৎকৃষ্ট মানের সুতা দিয়ে হাতে বুনে তৈরি করা হয় এ শাড়ি। বোনার ধরণ, রঙ, নকশা সব কিছুই নিজস্বতায় ভরা। এই শাড়ি তৈরি করতেও বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়।

ইতিহাস বলে, টাঙ্গাইলে তাঁত শিল্পের প্রসার হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। বসাক সম্প্রদায়ের লোকেরাই টাঙ্গাইলের আদি তাঁতি। মূলত সনাতন ধর্মবলম্বী তাঁতিদের মৌলিক উপাধি হলো বসাক। এরা আসলে দেশান্তরি তাঁতি। ঢাকা ও ধামরাই ছিল, যাদের আদিনিবাস।

টাঙ্গাইল শাড়ির ডিজাইনে নতুনত্ব সৃষ্টিতে যাদের অবদান রয়েছে তারা হলেন-বাজিতপুরের আনন্দ মোহন বসাক, সীতানাথ বসাক, চন্ডি গ্রামের নীল কমল বসাক, মনে মন্টু, নলসুন্দা গ্রামের হরেন্দ্র বসাক, পাথরাইল গ্রামের রঘুনাথ বসাক, আনন্দ, গোবিন্দ, সুকুমার বসাক, খুশি মোহন বসাকের নাম উল্লেখযোগ্য।

তারা জানান, টাঙ্গাইলের শাড়ি বুননের মূল কাজ একেবারেই আলাদা। অনেক পুরোনো একটা ঐতিহ্যের ধারায় চলে আসছে এ কাজ। সেই জ্ঞান ও নিষ্ঠা ছাড়া আসল টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরি করা সম্ভব না। আসল টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরির জন্য এর তাঁতি বা কারিগরদের শিল্পী হয়ে উঠতে হয়। টাঙ্গাইলে সেই শিল্পী তাঁতি আছেন। তাই টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প ও তাঁতের শাড়ির এতো সুখ্যাতি।

টাঙ্গাইলের বিখ্যাত তাঁত পল্লী পাথরাইল, চন্ডি, বাজিতপুর ও পুটিয়াজানি গ্রামেই এখন ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি তৈরি হয়। এ সব গ্রাম থেকেই সুতি জামদানী, সফ্ট সিল্ক, ধানসিঁড়ি, বালুচুরি, গ্যাসসিল্ক, স্বর্নকাতান, দোতারি, চোষা ও রেশম শাড়ির মত বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করে সরবরাহ করা হচ্ছে সারাদেশে।

সরেজমিনে জেলার দেলদুয়ার পাথরাইলে তাঁত শিল্প এলাকায় ঢুকতেই তাঁতের খটখটি শব্দ কানে ভেসে এল। এখানে দিন রাত চলে কাপড় বোনার প্রাতিযোগিতা। কত দ্রুত এবং কত বেশি মানসম্মত শাড়ি তৈরি করা সেই চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন তাঁত শিল্পীরা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।

শাড়ি ব্যবসায়ীরা জানান, এ জেলার প্রায় ১০ হাজার তাঁতি কাপড় বুননের কাজে সম্পৃক্ত রয়েছে। মুসলমানদের দুটি ঈদ ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজায় টাঙ্গাইল শাড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির জন্যই টাঙ্গাইলের সুনাম বা পরিচিতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। আর সে কারণে তাঁতি শিল্পীরা তাঁত শিল্পের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে টাঙ্গাইলের সফট সিল্ক ও কটন শাড়িতে। দৃষ্টি কাড়ছে এই শাড়ির বৈচিত্র্য বুনন ও নতুনত্ব ডিজাইন। আর এ পুরস্কারস্বরূপ টাঙ্গাইলের শাড়ি বুননশিল্পকে বিশ্বের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিল ইউনেস্কো। এর জন্য আমরা অনেক খুশি। এতে করে সারাবিশ্ব টাঙ্গাইল শাড়ির সুনাম ও চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে।

তাঁত শ্রমিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগে সপ্তাহে তিনটি শাড়ি তৈরি করতে পারতাম। কিন্তু এখন সপ্তাহে চারটি শাড়ি তৈরি করছি। মজুরি কম থাকায়, নতুন করে কেউ এ কাজে আসতে চায় না। ধান কাটলে একদিনে মজুরি পাওয়া যায় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। তবুও ধান কাটার শ্রমিকের সমান মজুরি পাওয়া যায় না। আমাদের মজুরি বাড়ানো হলে পরিবার নিয়ে একটু ভালোভাবে চলতে পারতাম।‘

তাঁত শ্রমিক নারায়ন চন্দ্র বলেন, ‘২৩ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত আছি। প্রতিপিস শাড়িতে ৬০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। সপ্তাহে ৫টি শাড়ি তৈরি করছি। এতে আমাদের পোষায় না। কম মজুরি দিয়ে সংসার চালানো দুরূহ হয়ে উঠেছে। আগের মতো জমজমাট নেই তাঁতপল্লী। তবুও বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছি আমরা।’

শাড়ি বিক্রেতারা জানান, আগে যে শাড়ি তৈরিতে ৫০০ টাকা খরচ হতো, তা এখন ৬০০ টাকার বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে ব্যবসার অবস্থা বেশি খারাপ যাচ্ছে। তার কারণ, কাঁচামালের দাম যেভাবে বাড়ছে, সে হারে শাড়ির দাম বাড়েনি।

শাড়ি ডিজাইনার ও বিশিষ্ট শাড়ি ব্যবসায়ী নীল কমল বসাক বলেন, ‘নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির মান ধরে রাখতে টাঙ্গাইল শাড়িতে আনা হয়েছে বাহারি ডিজাইন আর নতুনত্ব। দেশে শাড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় শাড়ি উৎপাদন ও বিক্রি কমে গেছে। ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুননশিল্পকে বিশ্বের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিল ইউনেস্কো দিয়েছে। এজন্য আমরা শাড়ি ব্যবসায়ীরা অনেক আনন্দিত। এতে বিশ্ববাজারে টাঙ্গাইল শাড়ির চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমার বিশ্বাস।’

টাঙ্গাইল জেলা শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, ‘নববর্ষ, ঈদ ও পূজার সময়ে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয় টাঙ্গাইলের শাড়ির। নানা কারণে গত কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে করোনা মহামারীর সময় থেকে শাড়ির ব্যবসা কমে গেছে। মূলধন, প্রয়োজনীয় উপকরণের সমস্যা, নকশা ও প্রযুক্তিগত সমস্যা, দক্ষতার অভাব, বিপণনসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তাঁতি সম্প্রদায়। এই স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে এ শিল্পকে আমাদের বাঁচাতে হবে।’

জেলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি’র সভাপতি বেনজীর আহমেদ টিটো বলেন, ‘ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়া কল্পনার বাইরে। এতে করে বিশ্ববাজারে টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যবসার আরও প্রসার ঘটবে। আমরা ইতিমধ্যে অনেক ভালো মানের তাঁত কারিগর হারিয়ে ফেলেছি। অনেক শ্রমিক অন্য পেশায় চলে গেছে। এ কারণে শাড়ি বুনুন ও নকশায় গুণগতমান ধরে রাখতে অনেক বেগ পেতে হবে। বিদেশি মানুষগুলো এখন হাতে কাজ করা টাঙ্গাইল শাড়ি খুঁজবে।’

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হক জানান, ‘ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি। এ পণ্যটির গুণগতমান ধরে রাখা এবং প্রচার ও প্রসারে জেলা প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। গত ৯ ডিসেম্বর ভারতের লালকেল্লায় অনুষ্ঠিত ২০তম ইউনেসকো বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তঃসরকারি কমিটির অধিবেশনে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুননশিল্পকে বিশ্বের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এ জন্য আমরা গর্বিত ও আনন্দিত। আমাদের প্রত্যাশা ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ টাঙ্গাইলের শাড়ি বুননশিল্পে বিশ্ববাজারে স্থান করে নেবে এবং সম্মানের সঙ্গে টিকে থাকবে।’