ঢাকা: দেশজুড়ে ভোটের ডামাডোল শুরু হয়েছে বেশকিছু দিন আগেই। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা বিরাজ করছিল। অবশেষে সেই শঙ্কা সম্ভাবনা হয়ে দেখা দিচ্ছি। খুব শিগগিরই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এমনকি সেটা আজ অথবা কাল। তার আগে বুধবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের সার্বিক প্রস্তুতি জানাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে জাতির উদ্দেশে সিইসির একটি ভাষণ রেকর্ড করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। এতে থাকবে ভোটের তফসিল, যা পরবর্তী সময়ে প্রচার করা হবে। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়, অথবা সম্ভব না হলে ১১ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণা করা হবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তফসিল ঘোষণা কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা মাত্র। তফসিলের আগে যেসব প্রস্তুতি দরকার, আলহামদুলিল্লাহ গ্রহণ করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ইলেকটোরাল ইনকয়োরি কমিটি, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, মনিটরিং সেল গঠন, আইন-শৃঙ্খলা সেল গঠন সবধরনের ফরম্যাট প্রস্তুত রয়েছে। শিডিউল ডিক্লেয়ারের পর ক্রনোলজিক্যালি সেই পরিপত্র জারি করব। এসব পরিপত্র ইসির ওয়েবসাইট, ইউটিউবে প্রচার করা হবে।’
তিনি জানান, দুই ভোট একসঙ্গে হওয়ায় বাজেট গতবারের চেয়ে আরও বাড়বে। দুই বছর আগে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। এবার প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার মতো সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হচ্ছে।
ইসি আনোয়ারুল বলেন, ‘আমাদের নির্দেশনা একটাই, আইন-বিধি মেনে সবাইকে কাজ করতে হবে। এর বাইরে আর কোনো বার্তা নেই। সঠিকভাবে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাজ করতে হবে, ব্যত্যয় হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি জানান, সংসদ নির্বাচন, গণভোট ও পোস্টাল ভোটিং নিয়ে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখছে না নির্বাচন কমিশন।
এদিকে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী। জানতে চাইলে সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পরই বোঝা যাবে কারা জোট করছে, কীভাবে মনোনয়ন দিচ্ছে। ইসির আদেশ-নির্দেশ মানছেন কি না তা দেখা যাবে। নির্বাচনি পরিবেশ অনুকূল থাকলে অনেক চ্যালেঞ্জই সহজ হয়ে যাবে।’
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘দলগুলো ও প্রার্থীরা আচরণবিধি অনুসরণ না করলে ইসির চ্যালেঞ্জ বাড়বে। তফসিলের পর পরিস্থিতি কোনো দিকে মোড় নেয় সেটাও দেখার বিষয়।’
এবারের নির্বাচনে যা কিছু নতুন
এদিকে, এবারই প্রথম দেশের ইতিহাসে একদিনে দুই ভোট আয়োজন করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত ১৮ নভেম্বর থেকে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারীদের নিবন্ধন শুরু হয়েছে, চলবে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যন্ত চলবে ভোটের কাজে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী ও আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নিবন্ধন কার্যক্রম। তবে যারা ভোটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকবেন, তাদের নিবন্ধন আরও কিছুদিন পরে শুরু হবে।
এছাড়া এবার পোস্টাল ব্যালটে থাকছে না নৌকাসহ ৪ প্রতীক। ইসি সূত্রে জানা গেছে, এবারের তালিকায় ১১৯টি প্রতীক রাখা হয়েছে। তবে পোস্টাল ব্যালটে ১১৫টি প্রতীক থাকবে। নিবন্ধন স্থগিত আওয়ামী লীগ (নৌকা), সেইসঙ্গে নিবন্ধন বাতিল হওয়া ফ্রিডম পার্টি (কুড়াল), ঐকবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন (চাবি) ও পিডিপির (বাঘ) প্রতীকও থাকবে না পোস্টাল ব্যালটে।
এবারই প্রথম ভোট হচ্ছে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত টানা ৯ ঘণ্টা। আগে সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে একটানা ৪টা পর্যন্ত হলেও এবারই প্রথম ভোট গ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। আর ভোট দেবেন প্রায় ১২ কোটি ৭৭ লাখ ভোটার। ইসির সবশেষ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ এবং নারী ভোটার ৬ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১ হাজার ২৩৪।
ভোটদানের জন্য কেন্দ্র চূড়ান্ত করা হয়েছে ৪২ হাজার ৭৬১টি। এতে মোট ভোট কক্ষ থাকবে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯টি। এর মধ্যে পুরুষদের জন্য ১ লাখ ১৫ হাজার ১৩৭টি এবং নারীদের জন্য ১ লাখ ২৯ হাজার ৬০২টি। তবে দুই ভোট একসঙ্গে হওয়ায় গোপন কক্ষ (ভোট প্রদানের কক্ষ) বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে ইসি। এবার ৩০০ আসনে নির্বাচনি অপরাধ তদন্তের পাশাপাশি বিচারকার্য সম্পাদন করবে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। বিভিন্ন অপরাধের বিচারও করবে তারা।
এদিকে, এবারের নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ নিবন্ধিত অর্ধশতাধিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। তবে আওয়ামী লীগ ভোটের বাইরে থাকলেও জাতীয় পার্টির বিষয়টি এখনো পরিষ্কার হয়নি। যদিও ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘যেসব দলের নিবন্ধন রয়েছে তাদের ভোটে অংশ নিতে কোনো বাধা নেই। যদিও আওয়ামী লীগ চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বর্জন করেছিল।’
২০০৮ সালে দলের নিবন্ধন প্রথা চালুর সময় ৩৮টি দল ছিল। বর্তমানে তা ৫৫ টিতে দাঁড়িয়েছে, এই সংখ্যা ভোটের আগেই আরও বাড়তে পারে।
এদিকে, সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরু থেকেই সব প্রস্তুতি নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। তবে সরকার থেকে গণভোটের ঘোষণা আসায় অতিরিক্ত ব্যালট পেপার, অতিরিক্ত গোপন কক্ষ, বাজেট বৃদ্ধি-এমন আরও বেশ কিছু প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এরই মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, আইন-বিধি সংশোধন, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক নিবন্ধন, অধিকাংশ ছাপার কাজ, অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছে ইসি। এখন অপেক্ষা শুধু তফসিল ঘোষণার।