সুনামগঞ্জ: ‘কত নেতা এসে দেখে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। বছরের পর বছর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে আমাদের। একটা সেতু হলে বই খাতা নিয়ে আতঙ্ক ছাড়া স্কুলে আসা যাওয়া করতে পারতাম’— এমন কথা বলল জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের মৌলিনগর গ্রামের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মনসুরা বেগম। শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান, আয়েশা আক্তারসহ অনেকে ভেলায় পার হয়ে মৌলিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। প্রায় ১০০ মিটার চওড়া আনোয়ারা নদীর কারণে উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের মৌলিনগর গ্রামটি দুই ভাগে বিভক্ত। হেমন্তে ৫০ মিটার ও বর্ষায় ১০০ মিটার চওড়া হয় নদী। বর্ষায় এই নদীতে পানি থৈ থৈ করে। নদীর দুই পাশে রাস্তা থাকলেও এই নদীতে ব্রিজ নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর। গত প্রায় একদশক ধরে এই মানুষদের ভেলায় চড়ে নদী পার হতে হয়। এতে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছে শিক্ষার্থী, রোগি ও বয়স্করা।
গ্রামবাসী জানায়, আনোয়ারা নদীর পশ্চিমপাশে আছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, আটগাঁও মাহমুদপুর মাদরাসা। মাহমুদপুর গ্রামে দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং লালবাজারসহ একটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। পূর্বপাশে নোয়াগাঁও অষ্টগ্রাম মাদরাসা, মৌলিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নোয়াগাঁও বাজার। বেশ কয়েক বছর শিক্ষার্থী ও পথচারীরা নৌকায় পাড় হতো। কিন্তু নৌকা সব সময় পাওয়া যায় না। এ কারণে শিক্ষার্থীরা প্রায় আট বছর ধরে ভেলায় পার হচ্ছে। ছয়টি প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর তক্তা দিয়ে ভেলা বানানো হয়।
সরজমিনে দেখা যায়, প্লাস্টিকের ছয়টি ড্রাম চারকোণা করে বেঁধে ওপরে তক্তা দিয়ে পাটাতন বানিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই ভেলা। এর দুই পাশে দু’টি লম্বা রশি আড়াআড়ি ভাবে খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। শিক্ষার্থী ও পথচারীরা ভেলায় উঠে নিজেরাই রশি টেনে একপার থেকে অন্য পারে যাচ্ছে। সেখানকার বাসিন্দাদের ভেলায় আনোয়ারা নদী পার হয়ে লালবাজার হয়ে উপজেলা সদরে যেতে হয়। প্রায় তিন হাজার জনসংখ্যার বড় এই মৌলিনগর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আনোয়ারা নদী পেরিয়ে বাজার, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়। হেমন্তে সুপেয় পানির অভাবে নারীদের ভেলায় পার হয়ে পূর্বপাড় যেতে হয় পানি আনতে।
নোয়াগাঁও অষ্টগ্রাম মাদরাসার আলিম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তানিয়া বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমিসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা এই ভেলায় চড়ে বিদ্যালয় এবং মাদরাসায় আসা-যাওয়া করি। ঝড়-বৃষ্টিতে পারাপারের সময় আতঙ্কে থাকি। বৃষ্টি আসলে শিক্ষার্থীদের বই-খাতা ভিজে যায়। বর্ষাকালে বেশি বেশি দুর্ঘটনা হয়। এখানে একটা ব্রিজ হলে দুর্ভোগ কমে যেত।’
মৌলিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. কুতুব উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই আনোয়ারা নদীটি গজারিয়া স্লুইসগেট থেকে কোড়াইল্লা হাওর হয়ে বলাহর ও উজ্জলপুর হয়ে সুরমার সঙ্গে সংযোগ ছিল। বছরের পর বছর ধরে পলি পড়ে এখন মরা নদীতে রূপ নিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে ড্রামের ভেলা করে দেওয়া হয়েছিল। এর পর থেকে গত কয়েক বছর ধরে মৌলিনগর গ্রামের বাসিন্দারা চাঁদা তুলে ভেলা তৈরি করে পারাপার হচ্ছে। প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী প্রতিদিন এই ভেলায় ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছে। সেইসঙ্গে আছে শত শত পথচারীও। তাদের কথা চিন্তা করে এই আনোয়ারা নদীতে একটি সেতু নির্মাণ জরুরি।’
মৌলিনগর গ্রামের প্রবীণ মো. বরকত মিয়া সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘অনেকদিন ধরে শুনে আসছি, আনোয়ারা নদীতে একটি ব্রিজ হবে। কিন্তু কিছুই তো হচ্ছে না। উপায় না দেখে বাচ্চাদের পারাপারের জন্য গ্রামবাসী মিলে ড্রামে ভেলা বানাইয়া দিছি। এই ভেলায় এখন গ্রামের সবাই পারাপার হচ্ছে।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. নেছার আহমদ সারাবাংলাকে জানান, আনোয়ারা নদীর দুই পাশে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার ও কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। পারাপারে ভোগান্তি লাঘবে আনোয়ারা নদীর ওপর একটি বেইলি ব্রিজ কিংবা সেতু দরকার। এতে এই এলাকার কয়েক হাজার মানুষের নিরাপদ যোগাযোগের ব্যবস্থা হতো।
ভীমখালী ইউপি চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আনোয়ারা নদীতে অনুর্ধ্ব ১০০ মিটারের একটি ব্রিজ উপজেলা পরিষদের (এলজিইডির) মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ব্রিজটি চালু হলে নোয়াগাঁও, লালবাজার হয়ে উপজেলা ও জেলা সদরের সঙ্গে যাতায়াতের পথ সুগম হবে। এতে লোকজনের দ্রুততম সময় ও কম খরচে জেলা ও উপজেলা সদরে যাতায়াত করতে পারবে।’
জামালগঞ্জের উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) মো. সানোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে জানান, ১০০ মিটার ব্রিজের প্রস্তাবনা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটি অনুমোদন হয়ে এলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্রিজটির কাজ শুরু হবে।