Sunday 28 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধন
একই আঙিনায় মসজিদ-মন্দির, ৬৩ বছর ধরে চলছে ধর্ম চর্চা

মহিউদ্দিন সুমন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:১১ | আপডেট: ১ অক্টোবর ২০২৫ ১০:০৮

নাগরপুরের চৌধুরী বাড়ির একই আঙিনায় মসজিদ ও মন্দির। ছবি: সংগৃহীত

টাঙ্গাইল: জেলার নাগরপুরের চৌধুরী বাড়ি। এই বাড়ি একই আঙিনায় কোনো সাম্প্রদায়িক হানাহানি ছাড়াই চলছে নামাজ ও দূর্গাপূজাসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। দুটি ধর্মের অনুসারীরা সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নিজ নিজ ধর্ম চর্চা করে আসছে দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে। উভয়ধর্মের অনুসারীরা একে অপরের ধর্মচর্চায় সহযোগিতার মাধ্যমে নিজ নিজ ধর্ম পালনে সারাদেশে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

জানা যায়, টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার চৌধুরী বাড়িতে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে ওঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন শ্রী পরেশ চন্দ্র ও শৈলেশ চন্দ্র দাসয়ো। এর পর থেকে প্রতিবছর ধুমধাম করে দুর্গাপূজা উদযাপন করে এলাকার সনাতনধর্মীর লোকজন। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর বাড়ির আঙিনার অপরপাশে (পশ্চিমাংশে) ১৯৬২ সালে নির্মাণ করা হয় নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। একই মাঠের পশ্চিমাংশে মসজিদ আর পূর্বাংশে মন্দির নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে কখনও ধর্মীয় কোনো দ্বন্দ্ব বা সাম্প্রদায়িক হানাহানি হয়নি।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে নাগরপুর ওঁঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির পূজামণ্ডপে গিয়ে দেখা যায়, পূজা-অর্চনা, উলুধ্বনি ও ঢাকের বাজনাও চলছে। দর্শনার্থীরা প্রতিমা দেখতে ভিড় করছেন। আজানের আগে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করা হলো, আজান ও নামাজের পর আবার পূজার কার্যক্রম শুরু হবে। ঠিক নির্ধারিত সময়ে আজান শুরু হতেই থেমে গেল ঢাক-ঢোল-কাঁসর, মাইক ও উচ্চশব্দের বক্সের বাজনা। আজানের পর মুসল্লিরা মসজিদে এসে নামাজ আদায় করছেন। নামাজ শেষ হওয়ার বেশ কিছু সময় পর আবার বেজে ওঠে মন্দিরের ঢাক-ঢোল-কাঁসর আর উচ্চশব্দের বাজনা। এভাবেই নামাজের ওয়াক্তের আজানের শুরুতেই থেমে যায় শঙ্খ ও ঢাক-ঢোলের শব্দ এবং নীরব থাকে নামাজ আদায় শেষ না হওয়া পর্যন্ত।

ঠিক তেমনি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যখন পূজা অর্চনায় মেতে ওঠেন তখন নামাজ ছাড়া কোনো ধরনের ইসলাম ধর্মীয় চর্চা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকেন মুসল্লিরা। এছাড়াও, প্রতিমা দর্শনে আগতরা বেশিরভাগ সময়ে অবস্থান নেন মসজিদের আঙিনায়। রোজা, নামাজ, পূজা একইসঙ্গে একই আঙিনায় পালন করেন দুটি ধর্মের অনুসারীরা। এলাকার হিন্দু-মুসলিম সবাই একে অপরের মসজিদ মন্দিরের সুরক্ষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুগের পর যুগ ধরে রেখেছে বন্ধন। এর আগে কোনো সহিংসতা তো দূরের কথা, কোনোদিন বাক-বিতণ্ডার নজির নেই এখানে। উভয়ধর্মের অনুসারীরা এ সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকিয়ে রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

মসজিদে নামাজে আসা মুসল্লিদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তারা জানান, এই এলাকার মানুষ অত্যন্ত শান্তি প্রিয়। দুই ধর্মের লোকদের মাঝে ধর্ম পালন নিয়ে কোনোদিন কোনো বিরোধিতা সৃষ্টি হয়নি। ইসলাম ধর্মের মানুষ তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে। তারাও নামাজ ও আজানের সময় পূজা বন্ধ রাখেন। এটা কাউকে বলে দিতে হয় না।

অন্যদিকে মন্দির পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে আসা ভক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ মন্দিরের নামকরণ করা হয় নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি ওঁঝা ঠাকুর কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর এখানকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মন্দিরের পাশেই প্রতিষ্ঠা করেন নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। এর পর থেকেই পাশাপাশি চলছে দুই ধর্মের মসজিদ-মন্দিরের কার্যক্রম। এতে ধর্ম পালনে কোনোদিন কোনো ঝামেলা হয়নি। তাদের প্রত্যাশা, যুগ যুগ ধরে চলতে থাকবে এই সম্প্রীতি।

নাগরপুর উপজেলা পূজা উদযাপন ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক ঝুটন কুমার সাহা সারাবাংলাকে জানান, এ বছর নাগরপুর উপজেলায় ১২টি ইউনিয়নে ১২৬টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপন হচ্ছে। এর মধ্যে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে নাগরপুর চৌধুরী বাড়িতে ওঁঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গামন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা করে আছে। মন্দিরের আঙিনার পাশেই ১৯৬৩ থেকে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও ঈদগাহ মাঠ স্থাপনের পর থেকেই একই আঙিনায় মন্দির-মসজিদে পাশাপাশি দুটি ধর্মের অনুসারীরা ভ্রাতৃত্বের সঙ্গে ধর্ম চর্চা করে আসছে, যা বাংলাদেশ এক বিরল দৃষ্টান্ত।

নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান সোহেল সারাবাংলাকে জানান, তিনি প্রজন্ম ধরে একই বাড়ির আঙিনায় মসজিদ ও মন্দির দেখছেন। পূর্বাংশের মন্দিরে সনাতন ধর্মের লোকজন পূজা-অর্চনা করেন। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। নামাজের আজানের সময় হলে বন্ধ হয়ে যায় পূজার কাজ। সারা বছর এলাকার হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই হিসেবে মিলেমিশে বসবাস করছে। এখন পর্যন্ত দুই ধর্মের মানুষদের মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি বলে জানান তিনি।

নাগরপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো হাবিবুর রহমান হবি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবছরের ন্যায় এবারও নাগরপুরে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে ওঁঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির ছোট পরিসরে হলেও পূজার আয়োজন করেছে। এর একটি ঐতিহ্য রয়েছে। সেটা হলো দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে একই আঙিনায় মসজিদ-মন্দিরে চলছে ধর্ম চর্চা।’

পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে এসে জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে নাগরপুরে মসজিদ-মন্দিরে প্রত্যেক ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে ধর্ম পালন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করে দেখতে পেলাম একই স্থানে নামাজ হচ্ছে, আবার পাশেই শান্তিপূর্ণভাবে পূজা চলছে। এই এলাকার মানুষের মধ্যে সামাজিক ও সম্প্রীতির বন্ধন অতুলনীয়। এই দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এমন বাংলাদেশ আমরা সবাই প্রত্যাশা করি।’

তিনি জানান, জেলার ১২ উপজেলায় ১ হাজার ২৫১টি পূজামণ্ডপে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশের পাশাপাশি, র‌্যাব, ডিবি ও আনসার সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন। সেইসঙ্গে মোবাইল টিম ও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন।