Saturday 13 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভাসমান পেয়ারার হাটে জমজমাট বেচাকেনা, চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৯ আগস্ট ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ৯ আগস্ট ২০২৫ ১৩:৩৮

ভাসমান পেয়ারার হাট

বরিশাল: ঝালকাঠির কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের ভিমরুলিতে খালের জলে বসে এক ব্যতিক্রমী ভাসমান পেয়ারার হাট। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সারি সারি নৌকায় চলে টাটকা পেয়ারা বেচাকেনা, যা পুরো এলাকাকে জমজমাট রাখে।

বিশেষ করে বর্ষাকালে এই হাটের প্রাণ ফিরে আসে। এসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক এই ভাসমান হাট এবং এর চারপাশের পেয়ারা বাগান দেখতে আসেন। ভিমরুলির এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিদেশি পর্যটকদের কাছেও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এতে চাঙ্গা হয়ে উঠছে গ্রামীণ অর্থনীতি।

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, আলজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও পর্যটকরা এই ব্যতিক্রমী হাট পরিদর্শন করেছেন।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্ষায় ভাসমান পেয়ারার হাট পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে। দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুরা এই হাটে এসে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠছেন।

পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হাটের পাশে গড়ে উঠেছে পার্ক, খাবারের দোকানসহ নানা ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এই উদ্যোগগুলো স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। হাজার হাজার মানুষের কাছে এই পেয়ারা চাষ এবং পেয়ারা কেন্দ্রিক ব্যবসা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও জীবিকার প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেয়ারার এই বিপুল সমারোহ কেবল চাষীদেরই নয়, স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

ভিমরুলিসহ আশপাশের ২০টির বেশি গ্রামে প্রায় ২০০ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি মণ পেয়ারা ৭৫০-৭৮০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত পেয়ারার ভরা মৌসুম থাকে।

পেয়ারা চাষের পাশাপাশি এই অঞ্চলে আমড়া, লেবু, কলা এবং বিভিন্ন রবি শস্যেরও আবাদ হয়। স্থানীয় নারী ও পুরুষ চাষীরা নৌকায় করে পেয়ারা সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে আসেন।

ভিমরুলির খাল পাড়ের বাগানগুলো পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। পর্যটকরা ট্রলারে করে এসব বাগান ঘুরে দেখতে পারেন এবং তাদের জন্য নির্ধারিত ভাড়ায় নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে।

তবে, পেয়ারা পচনশীল হওয়ায় চাষীরা অনেক সময় তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পান না। এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে চাষিরা আরও লাভবান হতে পারবেন।

পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে আসা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পেয়ারার ভাসমান হাটের কথা এত বছর ধরে শুনেছি, কিন্তু দেখতে পারিনি। এ বছর সময় ও সুযোগ করে সপরিবারে ঘুরতে এলাম। অনেক ভালো লেগেছে। নৌকা ভাড়া করে বাগানে গিয়ে পেয়ারা গাছে উঠে নিজ হাতে পেয়ারা নিয়ে খেতে পেরেছি। এতেই আমাদের ভ্রমণ সফল হয়েছে।’

বরিশালের আমানতগঞ্জের বাসিন্দা শারমিন সুমি পেয়ারার হাট ভ্রমণ করে মুগ্ধ। তিনি বলেন, ‘এমন ভাসমান বাজার দেশে আর নেই। এখানে ঘুরতে এসে কী যে ভালো লাগছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। বিশেষ করে পেয়ারা পার্কে নিজের হাতে পেয়ারা ছিঁড়ে খেতে পারাটা ছিল দারুণ আনন্দের।’

রগুনার আমতলীতে ঘুরতে আসা যুবকদের মতে, এখানকার পর্যটন ব্যবস্থার প্রধান সমস্যাগুলো হলো আবাসন ও গাড়ি পার্কিংয়ের অভাব। এছাড়াও, ভ্রমণের জন্য ডিঙি নৌকার সংকট রয়েছে, যা পর্যটকদের চলাচলে সমস্যা তৈরি করে। তাদের দাবি, পর্যটন উন্নয়নে এই সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত।

 

ভোলার কয়েকজন শিক্ষার্থী সম্প্রতি ভীমরুলীতে শিক্ষা সফরে এসে সেখানকার আবাসন ও শৌচাগার ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এখানে উন্নত শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। যে কারণে এখানে ঘুরতে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকরা নেতিবাচক ধারণা নিয়ে ফিরে যান।’

তাদের মতে, দক্ষিণাঞ্চলের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকাটির আরও উন্নয়ন প্রয়োজন। আধুনিক আবাসন ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নির্মাণ হলে পর্যটকদের অভিজ্ঞতা যেমন উন্নত হবে, তেমনি এলাকার অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে।

পেয়ারা চাষী কমল ও আশুতোষ জানান, তাদের বাবা-দাদারাও পেয়ারা চাষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন তারা নিজেরাই চাষ করছেন এবং আয়ও ভালো হচ্ছে। তবে এ বছর পেয়ারার ফলন কম হলেও দাম মোটামুটি ভালো পাচ্ছেন।

আফজাল হোসেন নামের এক পেয়ারা পাইকার জানান, ‘আমরা এখান থেকে পেয়ারা কিনে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করি। এখানকার পেয়ারা খেতে সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।’

ঝালকাঠি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘ঝালকাঠি জেলায় পেয়ারা চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি খাত। এ জেলায় ৫৬২ হেক্টর জমিতে পেয়ারার আবাদ হয়েছে। এই অঞ্চলের উৎপাদিত পেয়ারা স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’

ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক আশরাফুর রহমান বলেন, ‘ভিমরুলি ভাসমান বাজারের পাশে পর্যটকদের সুবিধার জন্য ওয়াশ ব্লক, বসার জায়গা, গোসলের স্থান এবং একটি ট্যুরিজম বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও, নদীতে একটি ঘাটলা নির্মাণ করা হয়েছে।’

তিনি আরও উল্লেখ করেন যে আইসিটি অধিদফতরের সহায়তায় একটি ফ্রি ওয়াই-ফাই জোন তৈরি করা হয়েছে। আরও কিছু উন্নয়নমূলক কাজের পরিকল্পনা রয়েছে।’

তিনি পেয়ারা বাগানে উচ্চমাত্রার সাউন্ড বক্স বাজিয়ে পরিবেশ দূষণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানান।

সারাবাংলা/এসআর
বিজ্ঞাপন

আরো