ঢাকা: খালেদা জিয়া এবং জিয়াউর রহমান উভয়েই মাতৃকূলের দিক দিয়ে মীর জুমলার বংশধর। খালেদা জিয়া ছিলেন জিয়াউর রহমানের দূর সম্পর্কীয় খালাতো বোন। জিয়া তার মকবুল নানার কাছে প্রথম শুনেছিলেন খালেদা জিয়ার কথা। শুনেছিলেন তার সেই খালাতো বোনটি দেখতে রাজকন্যার মতো। মকবুল নানা জিয়াকে তার ঐ বোনটি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ওকে অন্ধকার রাতে দেখলে মনে হবে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।’ জিয়া তার ছবি মামার কাছেও খালেদা জিয়ার একই প্রশংসা শুনেছিলেন। জিয়ার খুব ইচ্ছে হলো সেই বোনটিকে এক নজর দেখতে। একদিন দিনাজপুর যাওয়ার সুযোগ হলো। সেই সুবাদেই জিয়া দেখতে পেলেন খালেদা জিয়াকে। খালেদা জিয়া তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। তাকে দেখে জিয়া তার নানা ও মামার দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে মিল খুঁজে পেলেন।
পুতুল। খালেদা খানম। ছেলেবেলায় খালেদা জিয়া ছিলেন খুব লাজুক। খুব কম কথা বলতেন। জিয়া খালেদার উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা ও সৌন্দর্যে বিমোহিত হলেন। তখন থেকেই জিয়া তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। তার এই স্বপ্নের কথা তিনি তার মামাকেও জানিয়েছিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর একবার মামির কাছে লেখা চিঠিতেও তিনি লিখেছিলেন, ‘সেই দিদিমণিটি কেমন আছে?’
খালেদা জিয়ার বিয়ের ঘটনা সম্পর্কে ১৯৯১ সালে তার বড় বোন সাবেক মন্ত্রী মরহুমা খুরশীদ জাহান হক তার বনানীর বাসায় একান্ত আলাপচারিতায় বলেন :
জিয়া তখন ছিল সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ডিএফআই’র অফিসার হিসেবে তার পোস্টিং হলো দিনাজপুরে। আমরা থাকতাম দিনাজপুরের ঈদগাঁ বস্তি এলাকায় ভাড়াটে বাসায়। দিনাজপুরের চাকরির সময় জিয়া মাঝে-মধ্যে আমাদের বাসায় আসত। জিয়ার একটা অসম্ভব গুণ ছিল, সে সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতো। পুতুল মেট্রিক পাশ করার পর জিয়া একদিন আমাদের বাসায় এলো। আম্মার কাছে গিয়ে বললো, ‘খালা আমি আপনার জামাই হতে চাই।’ আম্মা হেসে ফেললেন, তখন কিছুই বললেন না। আব্বা বাসায় এলে তাকে বলা হলো জিয়ার কথা। আব্বা বললেন, মন্দ কী? তবে পুতুলের বয়স তো খুব কম। আম্মা এ ঘটনাটি আমার স্বামীকে জানালেন। তিনি সদ্য আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। কারণ তার যুক্তি ছিল, পুতুলের বয়স খুব কম। মাত্র ম্যাট্রিক পাশ করেছে। ডিগ্রি পাশ না করা পর্যন্ত বিয়ে কি করে হয়? অন্যদিকে জিয়া সেনাবাহিনীর লোক। এটা নিয়েও আমরা ভাবলাম। প্রথমে প্রায় সবারই অমত ছিল। তবে জিয়াকে আমরা সবাই পছন্দ করতাম। এদিকে জিয়াও বার বার খবর নিতে থাকলেন। অবশেষে আমরা বিয়েতে সম্মত হই।
খালেদা জিয়ার মা বেগম তৈয়বা মজুমদার জানান, তার মকবুল চাচা (জিয়ার নানা) আনুষ্ঠানিকভাবে জিয়ার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে মুদিপাড়ার বাসায় জিয়া ও পুতুলের বিয়ে হয়। বিয়ে হয়েছিল অনেকটা তাড়াহুড়ো করে। প্রথমে আক্দ হয়েছিল। এক বছর পর ঢাকার শাহবাগ হোটেলে (বর্তমান পিজি হাসপাতাল) তাদের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা দেয়া হয়।
বিয়ের স্মৃতি বর্ণনা করে মেজো বোন সেলিমা ইসলাম বিউটি জানান, ১৯৬০ সালে আমার বিয়ের কয়েক মাস পরে আগস্ট মাসে পুতুলের বিয়ে ঠিক হয়। আম্মা হঠাৎ খবর দেন যে, তোমরা একটু আস। বিয়েতে আড়ম্বর হয়নি। আমিই পুতুলকে গায়ে হলুদ দিয়েছি এবং মেহেদি মেখে দিয়েছি। জিয়ার সঙ্গে ওকে বেশ মানিয়েছিল।
বিয়ের পর জিয়া অবসর পেলেই খালেদা জিয়াকে নিয়ে বেড়াতেন। একবার তারা বড় বোন খুরশীদ জাহান হকের খালিশপুরের বাসায় বেড়াতে যান। খুরশীদ জাহানের স্বামী জনাব মোজাম্মেল হক খালিশপুর নিউজপ্রিন্ট মিলের প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
১৯৬৫ সালে জিয়া খালেদা জিয়াকে নিয়ে পাকিস্তান চলে যান। সেখানে তার পোস্টিং হয়। সে সময় পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানেই ছিলেন। জিয়া যুদ্ধে অংশও নিয়েছিলেন। তিনি খেমকারান রণাঙ্গনের ‘বেদীয়ান’-এ যুদ্ধরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাট্যালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। তার কোম্পানির নাম ছিল আলফা কোম্পানি। সে যুদ্ধে জিয়া বীরত্ব দেখিয়েছিলেন এবং পদকও পেয়েছিলেন। যুদ্ধের কথা জানিয়ে বেগম খুরশীদ জাহান হক আলাপচারিতায় বলেন, ‘ঐ সময় পুতুল এবং জিয়ার খবর নেয়ার জন্য আমরা প্রায়ই পাকিস্তানে ফোন করতাম। পুতুল তাদের কুশলাদি জানাত। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করতাম কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি-না। কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই সে ছিল দৃঢ় মনের। বলত, তোমরা অযথা ভেবো না। পাকিস্তানের বান্নো এলাকায় পুতুল থাকত। সেখানেই ১৯৬৬ সালের ২০ নভেম্বর পিনোর জন্ম হয়।’
পাকিস্তান থেকে ফেরার স্মৃতি বর্ণনা করে বেগম তৈয়বা মজুমদার একান্ত আলাপচারিতায় জানান, ‘পুতুল ওর শ্বশুরের খুব প্রশংসা করতো। বলতো ওর শ্বশুর ওকে খুব আদর করত। এটা কিনে দিত, ওটা কিনে দিত। ওর শাশুড়ি যে বেতারে গান করতেন তা বলত। জিয়া ও পুতুল ছিল মধুর দম্পতি। ওরা কেউ কারো সম্পর্কে কোনোদিন অভিযোগ করেনি।’