ঢাকা: ড. মো. নুরুল হুদা ভুঁইয়া কানন। ১৯ বছর ধরে চাকরি করছেন রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর)। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরি করেছেন বীরদর্পে। তার বিরুদ্ধে নানা প্রকার অনিয়ম, দুর্নীতি, অবৈধ কাজ ও অর্থ লোপাটের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তবে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ বাবার ভুয়া সনদ ব্যবহার করে চাকরি নেওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন করে আলোড়ন তুলেছে।
সম্প্রতি বিসিএসআইআর’র অচল অবস্থা নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে নুরুল হুদা ভুঁইয়ার এসব অপকর্মের চিত্র উঠে আসে। তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের যাবতীয় কাগজপত্র ও তথ্যপ্রমাণ সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
বাবার মুক্তিযোদ্ধার সনদ ভুয়া
নুরুল হুদা ভুঁইয়ার বাবার নাম মরহুম আবুল হাসেম ভুঁইয়া। তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ৭১৮। তিনি নাকি ফেনী জেলার ছাগল নাইয়া উপজেলার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সনদটি ভুয়া শনাক্ত করেছে মন্ত্রণালয়। কারণ, বীর মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে যেখানে যেখানে নাম লিপিবদ্ধ থাকা দরকার সেখানে সেই নাম নেই। লাল মুক্তিবার্তার কোনো সংখ্যাতেই আবুল হাসেম ভুঁইয়ার নাম নেই। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকাতেও নেই তার নাম।
নুরুল হুদা ভুঁইয়া কানন বাবার সেই মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ ব্যবহার করেই কোটায় চাকরি নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। চাকরি নেওয়ার পর তিনি বীরদর্পে দীর্ঘ ১৯ বছর চাকরিতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তবে তদন্তে উঠে এসেছে তার নিয়োগে গুরুতর জালিয়াতির ঘটনা।
সংশ্লিষ্ট নথি থেকে জানা যায়, গত ২৭ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (প্রশাসন-১) নুসরাত জাহানের সই করা নোটিশ (যার স্মারক নং-৪৮.০০.০০০০.০০১.৯৯.০১৩.২০২২.৩২৫, তারিখ ২৯ আগস্ট ২০২৪ খ্রি.) এর মাধ্যমে দ্বিতীয় ধাপে ১০টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের মধ্যে একটি মন্ত্রণালয়/বিভাগের তথ্য সঠিক বলে উল্লেখ করা হলেও বাকি নয়টি মন্ত্রণালয়ের মোট ১৩৮ জনের চাওয়া তথ্য না থাকা অথবা গড়মিল থাকার কারণে পরিবীক্ষণ করা সম্ভব হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়। তার মধ্যে বিসিএসআইআর সাইন্টিফিক অফিসার নুরুল হুদা ভূঁইয়ার নাম তৃতীয় নম্বরে রয়েছে।
একাধিক সূত্রের দাবি, নুরুল হুদা ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে যাতে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয় ও বিষয়টিকে কীভাবে ধামা-চাপা দেওয়া যায়, সে বিষয়ে জোর তদবির চালাচ্ছেন।
দুদকের তদন্ত চলছে
এ ছাড়াও, গত ৭ নভেম্বর নুরুল হুদা ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে নানা প্রকার অনিয়ম, দুর্নীতি, অবৈধ কাজ ও অর্থ লোপাটের অভিযোগ তদন্তের জন্য দূর্নীতি দমন কমিশন থেকে বিসিএসআইআরের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে।। দুদক থেকে জানানো হয়েছে, নুরুল হুদার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ, অর্থ লোপাটসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালনের নেতৃত্বে নুরুল হুদা
বিগত ১৫ বছর একক আধিপত্যের পাশাপাশি সরকারের উচ্চ পর্যায়কে কীভাবে খুশি রাখা যায়, সেজন্য নানারকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। শেখ রাসেল দিবস থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালনসহ নামে-বেনামে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন তিনি। একদিকে প্রতিষ্ঠানের টাকা লুটপাট, অন্যদিকে নিজেকে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেন।
সূত্রে জানায়, নুরুল হুদা ভূঁইয়ার প্রভাব এতটাই বেশি যে, বিসিএসআইআরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিম্নস্তরের অনেক কর্মচারীও তার ভয়ে তটস্থ থাকেন। তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও তিনি অস্বাভাবিক হস্তক্ষেপ করেন। নুরুল হুদা ২০০৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটাতে বিসিএসআইআর–এ যোগদান করেন। জুনিয়র হয়েও বিসিএসআইআর আরসি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। কেনাকাটাসহ বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থেকে বিসিএসআইআর এ বৈষম্য তৈরি করছেন।
টেন্ডারের আগেই গোপন বৈঠকে কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা
সূত্র জানায়, বিসিএসআইআর’র দরপত্র জমা দেওয়ার আগেই নির্দিষ্ট চারটি প্রতিষ্ঠানকে গোপনে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। তার বিনিময়ে হাতবদল হয় মোটা অংকের টাকা। গত ২৩ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির ঠিকাদারের বিষয়ে মূল্যায়ন কমিটির চূড়ান্ত সভা হয়। অথচ ওই মূল্যায়ন কমিটির গোপন বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবে তার এক মাস আগেই হয়েছিল। ধানমন্ডির ‘অ্যামব্রোসিয়া রেস্তোরাঁয়’ এক বৈঠকে সিদ্ধান্তগুলো হয়। সেই গোপন বৈঠকে চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অগ্রিম সুবিধা হিসেবে ৬০ লাখ টাকা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ব্যক্তি। পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও সম্পন্ন করতে চুক্তি করা হয়েছিল। যেখান থেকে প্রায় এক কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারার পরিকল্পনাও হয়।
বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ সূত্র বলছে, গোপন সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন টেন্ডার কমিটির সদস্য সচিব ও গবেষণা সমন্বয়কারী ড. মো. নুরুল হুদা ভূঁইয়া, ঢাকা গবেষণাগারের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. মো. হোসেন সোহরাব, ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার অ্যানালিটিক্যাল রিসার্চ (ইনারস)-এর পরিচালক ড. মো. সেলিম খান, সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার সত্যজিৎ রায় রনি, উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. বেনজির আহমেদ এবং কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি কাজী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কৌশলের ওস্তাদ নুরুল হুদা
উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে আরও জানা যায়, বিসিএসআইআর’র টেন্ডার হয় আটটি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কিন্তু যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশন এমনভাবে বানানো হয়েছিল যে, যাতে নির্ধারিত চারটি কোম্পানি ছাড়া আর কেউ টেকনিক্যাল যোগ্যতা অর্জন করতে না পারে। এটিই টেন্ডার কারচুপির পরিচিত কৌশল ‘সুবিধাভোগী বান্ধব শর্ত সংযোজন’, যেখানে দরপত্রের শর্তপত্র এমনভাবে লেখা হয়- যেন নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কেউ অংশ নিতে না পারে।
শুধু তাই নয়, পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের মদদপুষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘ দিন ধরে নিয়োগ বাণিজ্য, ঠিকাদারিসহ বিভিন্ন সেক্টরকে জিম্মি করে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটিপতি বনে গেছেন। সেই চক্রটি এখনো বহাল রয়েছে। আর এই চক্রেরই হোতা হিসেবে উঠে এসেছে নুরুল হুদাসহ তিনজনের নাম।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
এসব বিষয়ে বিসিএসআইআর’র সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি। অভিযোগটি যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তখন এটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগবিধি ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থার অপব্যবহারসংক্রান্ত গুরুতর অনিয়ম হিসেবে গণ্য হবে বলে জানিয়ে কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, এমন অভিযোগের ক্ষেত্রে সরকারি পরিসরে সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন, যাতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার মর্যাদা রক্ষা পায় এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সুশাসন নিশ্চিত হয়।
নুরুল হুদা যা বলেন
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিএসআইআর গবেষণা সমন্বয়কারী ড. মো. নুরুল হুদা ভূঁইয়া বলেন, ‘সব অভিযোগ ভুয়া । আমার একটি প্রতিপক্ষ গ্রুপ আছে, তারা এসব করছে।’ প্রতিবেদকের কাছে এ সংক্রান্ত ডকুমেন্টস আছে উল্লেখ করলে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।