Saturday 27 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তাজিক-আফগান সীমান্তে উত্তেজনা
চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে হামলা, উদ্বিগ্ন বেইজিং

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:১৭ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:০৫

আফগান-তাজিক সীমান্তের পাঞ্জ নদীর ওপর একটি ব্রিজের চূড়ায় তালেবানের পতাকা উড়তে দেখা যাচ্ছে। ছবি: আল-জাজিরা

মধ্য এশিয়ার দেশ তাজিকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে গত এক মাস ধরে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। তাজিক সরকারের দাবি অনুযায়ী, এই মাসে একাধিক সশস্ত্র অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে, যা আফগানিস্তানের বর্তমান শাসক তালেবানের সঙ্গে দেশটির এমনিতেই নড়বড়ে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটিয়েছে।

তবে তাদের মধ্যে চলমান এই উত্তেজনা প্রতিবেশী দেশ চীন কেউ চিন্তিত করে তুলছে। চীনা নাগরিকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা এবং সীমান্তে সশস্ত্র অনুপ্রবেশের ঘটনা বেইজিংয়ের বিশাল বিনিয়োগ ও জিনজিয়াং প্রদেশের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে।

সীমান্তে আসলে কী ঘটছে?

তাজিকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৩৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এই মধ্যে অনেকটাই দুর্গম পাহাড় ও নদীবেষ্টিত। তাজিক কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ‘সন্ত্রাসীদের’ সঙ্গে তাজিক বাহিনীর লড়াইয়ে ইতিমধ্যে ডজনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

সর্বশেষ চলতি সপ্তাহে তাজিকিস্তানের শামসিদ্দিন শোকিন জেলায় এক সংঘর্ষে ৩ জন অনুপ্রবেশকারীসহ মোট ৫ জন নিহত হন।

তাজিকিস্তান স্পষ্ট জানিয়েছে, আফগানিস্তানের বাদাকশান প্রদেশ থেকে গত এক মাসে তিনটি বড় ধরনের হামলা চালানো হয়েছে। তাজিক সরকার একে তালেবানের ‘চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা রক্ষায় তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

এই সংঘাতে চীন চিন্তিত কেন?

বেইজিং (চীন) বর্তমানে তাজিকিস্তানের বৃহত্তম ঋণদাতা এবং দেশটির অন্যতম প্রভাবশালী অর্থনৈতিক অংশীদার; অবকাঠামো নির্মাণ, খনি শিল্প এবং সীমান্ত সংলগ্ন প্রকল্পগুলোতে চীনের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে।

চীন ও তাজিকিস্তানের মধ্যে ৪৭৭ কিলোমিটারের (২৯৬ মাইল) একটি সাধারণ সীমানা রয়েছে, যা পূর্ব তাজিকিস্তানের সুউচ্চ পামির পর্বতমালা হয়ে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত।

গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে তাজিকিস্তানে কর্মরত চীনা কোম্পানি এবং নাগরিকদের লক্ষ্য করে দুটি পৃথক হামলা চালানো হয়। ২৬ নভেম্বর তাজিক-আফগান সীমান্তের দুর্গম খাতলোন অঞ্চলে ‘শোহিন এসএম’ নামক একটি বেসরকারি চীনা স্বর্ণ খনি কোম্পানির কম্পাউন্ডে বিস্ফোরকবাহী ড্রোনের সাহায্যে হামলা চালানো হয়, এতে তিন চীনা নাগরিক নিহত হন। দ্বিতীয় হামলায় ৩০ নভেম্বর একদল সশস্ত্র বন্দুকধারী তাজিকিস্তানের দারভোজ জেলায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ কর্পোরেশন’-এর কর্মীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে, এতে অন্তত দুইজন নিহত হন।

তাজিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই হামলাগুলো আফগানিস্তানের বাদাখশান প্রদেশের গ্রামগুলো থেকে পরিচালিত হয়েছে। তবে তারা এই হামলার পেছনে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা কারণের কথা উল্লেখ করেননি।

একই সময়ে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ এবং আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকাতেও চীনা নাগরিকরা বারবার হামলার শিকার হয়েছেন।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুশানবেতে অবস্থিত চীনা দূতাবাস সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও কর্মীদের সীমান্ত এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। একইসঙ্গে চীনা কর্মকর্তারা তাজিকিস্তান সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়ে বলেছেন, তারা যেন তাজিকিস্তানে কর্মরত চীনা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

হামলার নেপথ্যে কারা?

এখনো কোনো গোষ্ঠী সুনির্দিষ্টভাবে দায় স্বীকার না করলেও বিশ্লেষকদের আঙুল আইএস খোরাসান (ISKP)-এর দিকে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ইব্রাহিম বাহিস মনে করেন, আইএস মূলত তালেবানের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। তারা দেখাতে চায়, তালেবান সরকার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ এবং তাদের সঙ্গে আঞ্চলিক দেশগুলোর সম্পর্ক রাখা ঝুঁকিপূর্ণ।

তালেবানের অবস্থান কী?

তালেবান সরকার চীনা নাগরিকদের নিহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছে। তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানি দাবি করেছেন, আফগানিস্তান অন্য কোনো দেশের জন্য হুমকি নয় এবং তারা আলোচনার মাধ্যমে সব ভুল বোঝাবুঝি মেটাতে চায়। তবে তাদের এই দাবি সত্ত্বেও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা তাদের প্রশাসনিক দুর্বলতাকেই ফুটিয়ে তুলছে।

তাজিকিস্তান-তালেবান সম্পর্কের টানাপোড়েন

২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাজিকিস্তানই ছিল তাদের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক। ঐতিহাসিকভাবেই তাজিকিস্তান আফগানিস্তানের তালেবানবিরোধী ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’-এর সমর্থক ছিল। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রয়োজনে কিছুটা নমনীয়তা দেখা গিয়েছিল, কিন্তু নতুন করে এই সীমান্ত সংঘর্ষ এবং মাদক চোরাচালান ইস্যু দেশ দুটির বৈরিতা আবার উসকে দিয়েছে।

আঞ্চলিক প্রভাব ও সংকট

২০২১ সালে তালেবান পুনরায় আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে তাদের কিছু প্রতিবেশী দেশ কৌশলগত ব্যবসায়িক ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখলেও অন্যরা তা পারেনি। বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। তারা একসময় তালেবানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত ছিল।

ইসলামাবাদ (পাকিস্তান সরকার) অভিযোগ করে আসছে, কাবুল বর্তমানে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) বা পাকিস্তানি তালেবানের যোদ্ধাদের আশ্রয় দিচ্ছে।

গত নভেম্বরে এই উত্তজনা চরমে পৌঁছায় যখন পাকিস্তান আফগানিস্তানের কাবুল, খোস্ত এবং অন্যান্য প্রদেশে বিমান হামলা চালায়। যার জবাবে তালেবান বাহিনীও সীমান্ত চৌকিগুলোতে পাল্টা হামলা শুরু করে। কাতার এবং তুরস্কের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছানোর আগেই এই সংঘাতগুলোতে কয়েক ডজন মানুষ প্রাণ হারান।

তবে এরপরও উভয় পক্ষই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং এই নড়বড়ে যুদ্ধবিরতি ভাঙার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছে। তালেবান বরাবরই ইসলামাবাদের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে এবং উল্টো পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যর্থতাকে দায়ী করছে।

এরই মধ্যে তালেবান পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপনে মনোযোগ দিয়েছে। যার অংশ হিসেবে তাদের প্রতিনিধি দল বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত আলোচনার জন্য ভারতের বিভিন্ন শহর সফর করছে।

একসময় নয়া দিল্লি তালেবান-বিরোধী জোটে থাকলেও, পাকিস্তান ও তালেবানের মধ্যে বর্তমান তিক্ত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে ভারত এখন তাদের আগের অবস্থান পরিবর্তন করেছে।

সূত্র: আল-জাজিরা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর