রংপুর: উত্তরাঞ্চলে ক্রমেই বাড়ছে শীতের প্রকোপ। রংপুর বিভাগের নীলফামারীর ডিমলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। এই তীব্র ঠান্ডা, হিমেল হাওয়া এবং কুয়াশার কারণে জ্বর, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া এবং শ্বাসকষ্টের মতো শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যার ফলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভাগের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রোগীর চাপ অসহনীয় হয়ে উঠেছে। একই সাথে, শীতের এই দাপটকে ঘিরে নগরী এবং গ্রামীণ এলাকায় গরম কাপড়, জুতা এবং অন্যান্য শীতকালীন পণ্যের কেনা-বেচা জমজমাট হয়ে উঠেছে।
সামগ্রিকভাবে, শীতের এই মৌসুম স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং কৃষি উৎপাদনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। সরকারি স্তরে শীতার্তদের জন্য কম্বল বিতরণ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা ক্যাম্পেইন জোরদার করার দাবি উঠেছে স্থানীয়দের কাছ থেকে।
রংপুরের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল থেকে শহরের অলিগলি পর্যন্ত শীতের কবলে পড়েছে সবাই। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার তীব্রতাও বাড়ছে, যা সকাল ১১টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকছে। গত ৪ দিন ধরে সূর্যের মুখ অল্প সময়ের জন্য দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে হিমেল বাতাসে সন্ধ্যার পর থেকে শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে এলাকা, যার ফলে দৃষ্টিসীমা কমে গিয়ে সড়কে যানবাহন চলাচল করছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হচ্ছে না, চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে। দোকানপাট এবং হাটবাজার দেরিতে খুলছে। শ্রমজীবী মানুষজন, যারা দিনমজুরি বা কৃষিকাজ করে সংসার চালায়, তারা সবচেয়ে বেশি বিপাকে। খড়কুটো বা কাঠ জ্বালিয়ে শরীর গরম করার চেষ্টা করলেও, তীব্র হাওয়ার দাপটে তা যেন সামান্য সান্ত্বনা মাত্র।

শীতের করণে গরম কাপড় বিক্রি বেড়েছে
আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস অনুসারে, তাপমাত্রা এখন প্রতিদিনই কমবে। বছরের শেষ কয়েকটা দিনে শীতের তীব্রতা আরও কমবে। সেই সঙ্গে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই শীতের মৌসুমে রংপুর বিভাগের আট জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট এবং গাইবান্ধা জুড়ে তাপমাত্রার পারদ ক্রমাগত নিচে নামছে।
শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, রংপুর বিভাগের নীলফামারীর ডিমলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। এ ছাড়াও রংপুরে ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ১১ ডিগ্রি, নীলফামারীর সৈয়দপুরে ১১ দশমিক ৪ ডিগ্রি, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ১১ দশমিক ৪ ডিগ্রি, দিনাজপুরে ১২ ডিগ্রি, ঠাকুরগাঁয়ে ১১ দশমিক ১ ডিগ্রি, লালমনিরহাটে ১২ ডিগ্রি ও গাইবান্ধায় ১২ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করছে। দিনের বেলায় রোদের উষ্ণতা থাকলেও রাত এবং ভোরের দিকে হিমেল বাতাসের কারণে কনকনে ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে, হিমালয়ের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে।
স্থানীয় আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আগামী কয়েকদিনে কুয়াশা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা তাপমাত্রাকে আরও কমাতে পারে। জানুয়ারির ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত রংপুর, রাজশাহী, খুলনা এবং ঢাকা বিভাগে মৃদু শৈত্যপ্রবাহের প্রভাব বাড়তে পারে, যা দৈনন্দিন জীবন, পরিবহন এবং কৃষিকে প্রভাবিত করবে।
এদিকে শীতের এই তীব্রতা স্বাস্থ্য খাতে বড় চাপ সৃষ্টি করেছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন এবং শিশু বিভাগে রোগীর সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে, পা ফেলার জায়গা নেই। ঘরে ঘরে সর্দি, কাশি, জ্বর, কোল্ড ডায়রিয়া এবং শ্বাসকষ্টে ভুগছেন শিশু, বয়স্ক এবং নিম্ন আয়ের মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনে গরম এবং রাতে ঠান্ডার তারতম্যের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুসারে, রংপুর বিভাগে ঠান্ডাজনিত রোগের কারণে হাসপাতালে ভর্তির হার সবচেয়ে বেশি। রংপুরে ঠান্ডাজনিত মৃত্যুর হারও উল্লেখযোগ্য।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. জামাল উদ্দিনের পরামর্শ, শীতজনিত রোগ থেকে বাঁচতে গরম কাপড় পরা, পুষ্টিকর খাবার, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল খেতে হবে, পর্যাপ্ত পানি পান এবং মাস্ক ব্যবহার অপরিহার্য। দীর্ঘদিনের কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নেওয়ার উপদেশ দিয়েছেন তিনি।
এদিকে, শীতের এই প্রকোপ স্থানীয় বাজারকে সক্রিয় করে তুলেছে। রংপুর নগরীর অভিজাত শপিংমল থেকে ফুটপাতের দোকানগুলোতে গরম কাপড়, সোয়েটার, জ্যাকেট, মোজা এবং জুতার বিক্রি বেড়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষেরা পুরাতন গরম কাপড়ের দোকানে ভিড় করছেন।
জাহাজ কোম্পানি মোড়ের একটি জুতার শো-রুমের বিক্রয়কর্মী শাহরিয়ার আহমেদ জানান, কয়েকদিন ধরে জুতার বিক্রি বেড়েছে, এবং শিশু থেকে বয়স্ক সবাই কিনছেন। আশা করা যাচ্ছে, চলতি শীতে ভালো ব্যাবসা হবে।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের দফতর সূত্রে জানা গেছে, বিভাগের ৮ জেলায় শীতার্ত মানুষদের মাঝে বিতরণের জন্য শীতবস্ত্র এসেছে এবং বিতরণ শুরু হয়েছে।