টাঙ্গাইল: আজ ১১ ডিসেম্বর, টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের পরাজিত করে টাঙ্গাইলকে মুক্ত করেন দামাল মুক্তিযোদ্ধারা। উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এরপর থেকেই দিনটি টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত দিবস হিসেবে পালন হয়ে আসছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা দেশজুড়ে যেমন আলোড়ন তৈরি করেছিল, তেমনি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের প্রতিরোধযুদ্ধের খ্যাতি। বিশেষ করে আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ভূমিকা রাখে।
২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পর ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টাঙ্গাইল ছিল স্বাধীন। ওই সময়ে টাঙ্গাইলের আইনজীবী নূরুল ইসলামের বাসভবনে স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ গঠিত হয়। আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে কমিটি ঘোষণা করা হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণও শুরু হয়।
২৭ মার্চ বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে টাঙ্গাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ওইদিন রাতেই সার্কিট হাউজে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় দু’জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ১৫০ জন আত্মসমর্পণ করে। এই সাফল্যে মুক্তিযোদ্ধারা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।
৩ এপ্রিল পাকবাহিনী টাঙ্গাইল দখল করলে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে সখীপুরের বহেড়াতৈলে চলে যান। এখানেই পরবর্তীতে ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ নামে শক্তিশালী প্রতিরোধবাহিনী গড়ে ওঠে। এ বাহিনীতে ১৭ হাজার প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা এবং ৭০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক যুক্ত ছিলেন।
৮ ডিসেম্বর প্রায় ৫ হাজার পাকসেনা ও রাজাকার-আলবদর টাঙ্গাইলে অবস্থান নেয়। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কাদেরিয়া বাহিনী টাঙ্গাইলসহ আশপাশের জেলাগুলোতে ধারাবাহিক যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করে। এসব যুদ্ধে তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন।
৮ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ছত্রী সেনা পোলী ব্রিজের পাশে অবতরণ করলে যুদ্ধ শুরু হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল ছেড়ে ঢাকার দিকে পালাতে থাকে। এরপর কাদেরিয়া বাহিনী চারদিক থেকে সাড়াশী আক্রমণ চালিয়ে টাঙ্গাইলকে হানাদারমুক্ত করতে সক্ষম হয়।
১০ ডিসেম্বর রাতে কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক টাঙ্গাইল সদর থানা দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পরে ১১ ডিসেম্বর সকালে বিভিন্ন দিক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করেন এবং তুমুল লড়াইয়ের পর পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে।
জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোলাম মোস্তফা মিয়া বলেন, ‘১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলবাসীর জীবনের এক অমর দিন। শহরের প্রতিটি ইট-পাথরে শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তরুণ প্রজন্মকে এই ইতিহাস জানতে হবে।’
তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ১৭ বছরে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে রাজনৈতিকভাবে ভুয়া তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তির দাবি জানাই।’
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিটের আহ্বায়ক আব্দুল খালেক মন্ডল বলেন, ‘ময়মনসিংহ দিক দিয়ে ঢাকার পথে পালাতে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধে পাকবাহিনী পথ পরিবর্তনে বাধ্য হয়। টাঙ্গাইলের বীরদের নাম চিরকাল ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’
এ দিকে টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত দিবস উদযাপন উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ড ও কাদেরিয়া বাহিনী টাঙ্গাইলে দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সেগুলো হলো শহিদ বেদীতে পুষ্পস্তক অর্পণ, বিজয় র্যালি, সংযাত্রা ও লাঠিখেলা এবং আলোচনা সভা।