Saturday 28 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কুয়াশার অন্ধকারে

ঈমাম হোসাইন
১৬ জুন ২০২৪ ১৫:৫১

বাসস্টপেজে নামলাম বটে কিন্তু বোঝার উপায় নেই যে কোন্ দিকে যাব। চারদিকে মাঘের ঘন কুয়াশা এমন ভাবে বিচরণ করছে যে দুই হাত সামনের কাউকে দেখাও মুশকিল। রাতও অনেক গভীর হয়ে গেছে। জনা কয়েক সহযাত্রী ইতিমধ্যে চলেও গিয়েছেন। গ্রামে জরুরি কাজে আসা। বাস গন্তব্যে পৌঁছতে এত দেরি হবে তা আন্দাজের বাহিরে। একবার ভাবলাম বাসস্ট্যান্ডেই বাকি রাতটুকু যাপন করাই শ্রেয় হবে। কিন্তু এমন কনকনে শীতের দারুণ অত্যাচারের কথা ভেবে বাড়ির পথে রওয়ানা হওয়া সমীচীন মনে হলো।

বিজ্ঞাপন

দাঁড়িয়ে থাকা স্হানটির গুরুত্বও মাথায় ঘুরছে। এটি কেবল বাসস্ট্যান্ড নয়, পবিত্র ভূমিও বটে। একদা এখানে আবুল মামা নামে বিখ্যাত পীর তার আস্তানা গড়ে তোলেন। তিনিও পরলোকগত হয়েছেন বেশ কিছু বছর আগে।ছোট বেলায় তাঁর দেখা পেয়েছি বার কয়েক। তিনি ছুটে চলেছেন অজানা গন্তব্যে।পেছনে তাঁকে অনুসরণ করছেন শত মুরীদেরা।

কিছূ দূরে কারও গলা খাঁকার শুনতে পেলাম। সাহস নিয়ে সামনে গেলাম। বার্ধক্যের ভারে ন্যূজ এক ব্যক্তি তার রিক্সায় বসে ঘুমাচ্ছেন কিংবা ঝিমাচ্ছেন। ‘এ রিকসাওয়ালা’ বলতেই লোকটি হতচকিত হয়ে বললেন, কোথায় যাবেন? ঠিকানা বলার সাথে সাথে উঠুন বলেই টান দিলেন। ভাড়ার দর করার সুযোগও পেলাম না।

রিক্সা চলছে ঘন কুয়াশার দেয়াল ভেদ করে। শীতের কাঁপুনি থেকে বাঁচতে মাথা, মুখ ঢেকে রেখেছি। মাঝে মাঝে লোকটির দীর্ঘ স্বরের কাশি আর দীর্ঘশ্বাস আমার কৌতুহল বাড়িয়ে দিচ্ছে। আপনি এ বয়সে এত রাতে……!

দাসের হাটের ঐ যে বড় গাছটি, যার চারদিকে হাটের দিন শত শত পান দোকানি একত্রিত হতো, তার সমকালে জন্ম আমার। দুইয়ের বয়স প্রায় কাছাকাছি। তবে দুভাগ্য হলো সেই বটবৃক্ষ এখন আর নেই। হাটও এখন আর বসে না। তবে কিছু ঘটনার রাজসাক্ষী এ বটবৃক্ষটি।

যুদ্ধের বছর মহেশচর হয়ে বদু রাজাকারের নেতৃত্বে এক দল রাজাকার আসছিল হাটের দিকে। গাছের মগডালে উঠে আমি সেই দৃশ্য দেখি। সংবাদ পেয়ে সব দোকানি পালালো। আমি স্কুলের পাশে একটি টিনশেড ঘরে লুকিয়ে গেলাম। একের পর এক দোকানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। পুরো বাজার একটা আগুনের কুন্ডলীতে পরিণত হলো। পাশের হিন্দু বাড়িগুলো ফাঁকা হয়ে গেলো। ঘরবাড়ি লুট হলো।লুট হওয়া মহেন্দ্র চৌকিদারের দ্বিতল বাড়ি হলো রাজাকারদের ক্যাম্প। এখানেই রাতের আধারে বাইজী আর মদের আসরে মাতাল হতেন বিহারী মেজর গুল মোহাম্মদ ও তার এ দেশীয় দোসরেরা।

বিজ্ঞাপন

কমান্ডার নাসির আর সদরের শাহজাহান মিলে বাইশজনের একটি দল সংগ্রহ করে চলে গেলেন ত্রিপুরার কল্যাণী ক্যাম্পে। তার আগে কাশমীর বাজারের পাশের একটি শনঘরে নাসির কমান্ডারের সাথে দেখা। বললাম, আমার বয়সতো কম। আপনারা ট্রেনিংয়ে যাবেন, আমি কি করতে পারি? ‘আপাতত ট্রেনিং নিয়ে আসি। তারপর যুদ্ধ হবে, যুদ্ধ। দেশ স্বাধীন করতে সবাইকে লাগবে’।

লোকটির অনর্গল কথা বলা শুনে কিছুটা অবাক, স্তম্ভিত হলাম। এই নিশিতে বুড়োর এমন প্রলাপ আমাকে শুনতেই হবে। না, লোকটির কোনো বিরতি নেই। তার উপর, আরোহী একজন বাধ্যগত শ্রোতা। এক্ষণে আমার স্মৃতি কিছুটা উম্মক্ত হলো। একদা শীতকালে তিনচর পেরিয়ে উপজেলা পৌঁছতাম।

একবার মতিগঞ্জ সিএ অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আমাকে পাঠালেন কমান্ডার। নামটি এখন আর স্পষ্ট মনে নেই। পাকিস্তানি নৌবাহিনীর বাঙালি সদস্য, পালিয়ে এসেছেন। নিজ নামে গড়ে তুলেছেন মুক্তি বাহিনী। আমাকে বললেন, মিলিশিয়া ক্যাম্পে কতজন আছেন, কি পরিমান অস্ত্র, রসদ আছে সব জেনে আমাকে দ্রুত জানাও। আমি দুই ঘন্টায় মধ্যে সব তথ্য জেনে কমান্ডারকে জানালাম। তিন দিন পর রাতের অন্ধকারে সিএ অফিস আক্রমণ হলো। কিছু মুক্তিযোদ্ধা আহত হলেও সেই রাতে পাক বাহিনী জীবিত যেতে পারেনি। স্হানীয় রাজাকারদের কেউ গুলি খেয়ে মারা গেলো আর কেউ মাফ চেয়ে প্রাণে বেঁচে গেলো।

কমান্ডার একদিন ক্যাম্পে আমাকে ভাত আর ডালের পানি খেতে খেতে বলেছিলো, দেশ শত্রুমুক্ত হলে আমরা সবাই মিলে দেশ গড়বো। একদিন খবর পেলাম, বিলোনীয়ার চূড়ান্ত যুদ্ধে কমান্ডার গুলি খেয়েও যুদ্ধ করতে করতে শহিদ হয়েছেন।

থামিয়ে বললাম, আপনার ঘর সংসার নিশ্চয় আছে? ছেলেমেয়েরা কি করে?

অনেকক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। বললেন, কথিত ভাধাদিয়ার পীর সাহেব ফতোয়া দিয়েছেলিন, মুক্তি বাহিনীর স্ত্রীদের নির্যাতন করা, ধর্ষণ করা জায়েজ। কারণ এরা নাকি গনিমতের মাল। ঘরে আমার স্ত্রী আর দুইজন বেটা ছেলে ছিল। দারোগার হাটের মজনু আর মৌলভি ইসমাইল রাজাকার বাড়ি গিয়ে আমার স্ত্রীকে ধর্ষণ আর পুরো পরিবারকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসে। ধর্ষণের হুমকি সইতে না পেরে আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করলো। বক্তারমুন্সী বাজার, নবাবপুর, ভোরবাজারে যেদিন যুদ্ধ হলো, ঐ দিন ফতেহপুরে আমাদের সজল সওদাগর বাড়িতে হামলা হলো, আমার একপুত্রকে ধরে নিয়ে গেলো। আর কোনোদিন পুত্রের সন্ধান পেলাম না। সুখ একটাই, ভোর বাজার যুদ্ধে বিহারী মেজর গুল মোহাম্মদকে চোখের সামনে গুলি খেয়ে মরতে দেখেছি।

আপনি এই বয়সে রিক্সা চালান কেনো? তারপর এ কনকনে শীতের রাতে এ শরীরে রিকশা চালাচ্ছেন!

বাবা, আমার একজন পুত্র বেঁচে আছে। এটাই সম্বল। আঠার বছর আগে মানসিক ব্যাধি আক্রান্ত পুত্রের জন্য আমাকে আজও রাস্তায় থাকতে হচ্ছে। কমান্ডারদের কেউ কেউ আফসোস করেন।

চাচা, আমার বাড়ির রাস্তায় এসে গেছি। শেষ মাথায় নামিয়ে দিলে চলবে। মনে মনে তার জন্য কোনো সান্ত্বনার বাক্য তৈরি করতে পারলাম না। শুধু বললাম, এ নিন আপনার টাকা। দুই খানা বিশ টাকার নোট গুছে নিয়ে আবার রিকশা টান দিলেন। পেছনে ফিরে দেখি, না, কেউ নেই। তিনি মিশে গেছেন কুয়াশার অন্ধকারে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈমাম হোসাইন কুয়াশার অন্ধকারে গল্প সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর