তরুণ লেখক প্রকল্প ও সাহিত্যিক হওয়ার কসরত
১১ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:০৯ | আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:১১
তরুণ লেখক প্রকল্প নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ২০০০ সালের পরপরই- চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন তখন ‘পুরোনো’ জায়গা বটতলীতে; নিউমার্কেটের পাশে এসে পৌঁছায়নি। শহরের ব্যস্ততম জায়গা এই নিউমার্কেট। চারদিকে চলে গেছে চারটা বড় রাস্তা; নিউমার্কেট মোড় থেকে যে রাস্তাটা চলে গেছে টাইগার পাসের দিকে তার বাম অংশ থেকে ছাড়ে বহদ্দারহাট, পতেঙ্গা ও কর্নেলহাট-ভাটিয়ালি রুটের গাড়ি। বাসস্ট্যান্ডের কাছ ঘেঁষে চওড়া ফুটপাত। অস্থায়ী ব্যবসায়ীরা পশরা সাজিয়ে বসে এখানে। বলতে গেলে পত্রপত্রিকার স্বর্ণযুগ তখন। কত ধরনের ম্যাগাজিনও যে প্রকাশিত হতো! মূল পত্রিকার পাশাপাশি ষোলশহর দুই নম্বর গেট, নিউমার্কেটসহ আরও কোনও কোনও পত্রিকা স্টলে ছিল সচিত্র-বিচিত্র পিনআপ বইয়ের ছড়াছড়ি। রসময় গুপ্ত এসব বইয়ের বাজার কাটতি লেখক। তার লেখার ধার (! ) যতটা না, তারচেয়ে কম আকর্ষণীয় ছিল না প্রচ্ছদে কোনও স্বদেশি বা বিদেশিনীর লাস্যময়ী আলোকচিত্র। কোনও কোনও বইয়ের ভেতরে থাকত বাংলাদেশি জনপ্রিয় কোনও নায়িকার ‘গলাকাটা’ ছবি। ফটোশপের মাধ্যমে বিদেশিনীর মাথা কেটে ফেলে সেখানে বসিয়ে দেওয়া হতো বাজার চলতি কোনও নায়িকার ছবি। বলাবাহুল্য, ঊর্ধ্বাংশ ও নিন্মাংশ থাকত পুরো দিগম্বর। রসময় বাবু ও তার সতীর্থ অন্যান্য লেখকের (! ) সঙ্গে পাল্লা দিতেই বোধহয় তখন ঢাকাই সিনেমায় অশ্লীলতার বসন্ত নেমে এসেছিল! বাংলা সিনেমার স্বল্পবসনা নায়িকাদের ‘গাওয়া’ উত্তেজক গানগুলোর সংকলনভুক্ত রূপ ‘গরম মশলা’ নামক সিডি। প্রযুক্তি তখনো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য ছিল দূর আকাশের চাঁদ! সিডি ও ডিভিডির পার্থক্য বুঝতেই কেটে গিয়েছিল অনেক বছর।
অবসন্ন বিকেলগুলোতে প্রায়ই চলে যেতাম নিউমার্কেটে। নতুন-পুরাতন পত্রিকা পড়ার নেশা পেয়ে বসেছিল। স্টেশন রোডস্থ নূপুর মার্কেটে ছিল পুরোনো বইয়ের বিশাল ভাণ্ডার। পৃথকভাবে ছিল এক নামে পরিচিত ‘অমর বই ঘর’। তারও আগে এই এলাকাতেই ছিল ষাটের দশকের সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা ‘বইঘর’। প্রকাশক ছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ শফী। চট্টগ্রাম থেকেই ঢাকাসহ দুই বাংলার অনেক খ্যাতিমান লেখকের বইটি প্রকাশ করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিল প্রতিষ্ঠানটি। যদিও শেষপর্যন্ত প্রকাশক এটাকে টিকিয়ে রাখতে পারেননি। এই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সেলিনা হোসেনের একটি উপন্যাস কিনেছিলাম ফুটপাত থেকে।
জলসা সিনেমা ভবনের নিচতলায় নামকরা বই ও পত্রিকা বিপণি কারেন্ট বুক সেন্টার। জিপিওর সামনেও মাঝে-মধ্যে কেউ কেউ পুরোনো বইয়ের পশরা খুলে বসত। নানামুখী আয়োজনগুলো দেখেই তৃপ্ত থাকতাম, কিনতে পারতাম কমই।
নিউমার্কেট মোড়ে একদিন দেখা হয়ে গেল কয়েকটি বিশেষ বইয়ের সঙ্গে। ‘বিশেষ’ বলতে হচ্ছে এই জন্য- বইগুলো অপরাপর বই থেকে কিছুটা আলাদা। পাকা ফুটপাতের উপর ফিনফিনে পাতলা পলিথিন বিছিয়ে সেটার উপর নানা ধরনের বই সাজিয়ে রেখেছে বিক্রেতা। নাতিদীর্ঘ কিছু বইয়ের মলাটে ডাক বিভাগের সিল-ছাপ্পরের আদলে গোল করে লেখা- ‘তরুণ লেখক প্রকল্প/ বাংলা একাডেমী’। মলাটের ডান পাশে দুই লাইনের লেখার মাঝখানে প্রতীক হিসেবে সারিবদ্ধ কিছু বইয়ের ছবি দেওয়া। দৈনিক ভোরের কাগজ ও প্রথম আলো পড়ে জাফর আহমদ রাশেদ নামটির সঙ্গে ততদিনে পরিচয় ঘটে গেছে। তার লেখা বইটিই হাতে তুলে নেড়েচেড়ে দেলাম। বাংলা একাডেমির মহাঁপরিচালক ও প্রকল্প পরিচালকের লেখা ভূমিকা-বক্তব্যও দৃষ্টি কাড়ল।
তারপর তো কতকিছুই পরিবর্তন হলো। সময় গড়াল। বাংলা একাডেমি বানানে আধুনিকায়ন হলো; দীর্ঘ ই-কারের বদলে স্থান নিল হ্রস্ব ই-কার। আমিও লেখক হওয়ার উদগ্র বাসনা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে থিতু হওয়ার চেষ্টা করলাম। টিকে থাকার জন্য কত সংগ্রাম, জীবনযুদ্ধ দিকে দিকে! ঢাকা-বাসের এক দুই তিন চার বছর পেরিয়ে এল ২০১১ খ্রিস্টাব্দ। কস্মিনকালেও কি ভাবতে পেরেছি- এই সময়ে বাংলা একাডেমির বিশেষ একটি প্রকল্পের সঙ্গে আমার নামটিও জড়িয়ে যাবে! তরুণ লেখক প্রকল্পে সুযোগ পেলাম; নবপর্যায়ে পঞ্চম ব্যাচে। নামেও কিছু পরিবর্তন এসেছে- তরুণ লেখক প্রশিক্ষণ কোর্স। এতদিনে তরুণ লেখক কার্যক্রমের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিধি সম্বন্ধে অবগত হয়েছি। তৎকালীন উজ্জ্বল কতিপয় শিক্ষার্থীর সঙ্গেও পরিচয় ঘটেছে। অবশ্য চতুর্থ ব্যাচেও আবেদন করেছিলাম, সেবার ভাগ্য প্রসন্ন হয়নি। প্রচুর মেধাবী ও অমেধাবী প্রতিযোগীর ভিড়ে ছিটকে পড়েছিলাম।
সম্ভবত কোনও জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়েছিল। লেখক প্রকল্পে অংশগ্রহণেচ্ছুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। চতুর্থ ব্যাচে আবেদন করলাম। আবেদনপত্রর সঙ্গে জমা দিতে হলো বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু লেখাজোকার ফটোকপি। আমার আবেদন সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ কাড়তে পারেনি। নির্দিষ্ট সময় পর ফের বিজ্ঞাপন দেখে পঞ্চম ব্যাচের জন্য আবেদন করলাম। নতুন লেখাজোকা তো এই ফাঁকে প্রকাশিত হয়নি। একটি প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করতাম, কাজের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা। লেখক প্রকল্পে আবেদনের দ্বিতীয়বার বুদ্ধি করে প্রকাশিত লেখার কপির সঙ্গে একটি লিটল ম্যাগাজিনও জমা দিলাম। গল্পবিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতাম- ‘প্রকাশ’। প্রতি সংখ্যায় একজন গল্পকারের সাক্ষাৎকার ও গল্প প্রকাশিত হতো। ওই সংখ্যায় ছিল মনি হায়দারের সাক্ষাৎকার।
এবার ডাক পেলাম ইন্টারভিউ বোর্ডে। বাংলা একাডেমির মহাঁপরিচালক শামসুজ্জামান খান ছিলেন সেখানে; তার সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন। একপাশে আমাকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হলো। সামনে পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লেখক খোন্দকার আশরাফ হোসেন (প্রয়াত) ও বিশ্বজিৎ ঘোষকে। ওপাশে আমার সনদ, লেখার কাটিং, আবেদনপত্র, লিটল ম্যাগাজিন- তাবত আমলনামা বিশ্বজিৎ ঘোষের হাতে। সোহরাওয়ার্দী কলেজে বিএসএস পড়ার তথ্য ছিল আবেদনপত্রে। সেই কারণেই বোধকরি বিশ্বজিৎ ঘোষ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্বন্ধে একটি প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নটি আমার মাথার উপর দিয়ে গেল। ভাগ্য বোধহয় সহায়কই হলো, খোন্দকার আশরাফ হোসেন বিশ্বজিৎ স্যারকে শুধরে দিলেন। মানে দাঁড়াল- প্রশ্নটি যথাযথ হয়নি। কিন্তু বিশ্বজিৎ ঘোষ আমাকে এত সহজে ছাড়বেন কেন! সনদপত্র উল্টেপাল্টে প্রশ্ন করলেন- ‘পড়াশোনার এমন বেহাল দশা কেন? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছ নাকি মাস্তানি-রংবাজি করেছ?’
আমি আর দীর্ঘশ্বাস চেপে কী করব! সচ্ছল পরিবারের অনেক মা সুযোগ পেলেই খেদোক্তি ঝাড়েন- ‘আমার বাচ্চাটা কিচ্ছু খায় না!’ অন্যদিকে দরিদ্র মায়ের সন্তানেরা ‘মা, খিদা লাগছে’ বলে কানা ঝালাপালা করে ছাড়ে। দুই মাকে কখনওই কি সমানভাবে বিচার করা যাবে? এর কিছুদিন পরে বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন (কিংবা আলতাফ হোসেন লাভলু) কল করে জানালেন- আমি তরুণ লেখক প্রকল্পে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি।
বলাবাহুল্য, দিনটা আনন্দের ছিল। নবপর্যায়ে তরুণ লেখক প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন মোহাম্মদ আবদুল হাই। তখন তার মূল দায়িত্ব ছিল- পরিচালক, মুদ্রণ ও প্রকাশনা শাখা, বাংলা একাডেমি।
নির্দিষ্ট সময়ে ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরু হলো। সবার সঙ্গে জানাশোনা ও পরিচিত হওয়ার পালা। নির্বাচিত সব শিক্ষার্থী বসেছি কনফারেন্স রুমে। আমাদের মধ্যমণি শামসুজ্জামান খান স্যার। এক এক করে সব শিক্ষার্থীর নাম-ধাম জানছেন তিনি। আমার পালা এলে প্রশ্ন করলেন, ‘বর্তমান সময়ের কোন লেখকের লেখা তোমার পছন্দ?’
বেশি কিছু না ভেবেই বললাম, ‘মনি হায়দার।’
‘কেন ভাল লাগে?’
স্যারের প্রশ্নের জবাবে এবার কোনও কথাই বলতে পারলাম না। প্রশ্নটা যে খুব কঠিন তাও নয়। আদতে এত বড় একজন মানুষ প্রশ্ন করছেন, আমি ‘কাঠগড়া’য় তার মুখোমুখি। অবচেতন মন হয়তো সেটা মেনে নিতে পারেনি! এরপর তো দীর্ঘ ছয় মাস স্যারের স্নেহের ছায়াতলে ছিলাম। তার স্নিগ্ধ প্রাণবন্ত মনের সাক্ষাৎ পেয়েছি বারবার। তিনি বাংলা একাডেমির কার্যক্রম কতটা নিষ্ঠার সঙ্গে পরিচালনা করতেন- কোনও কোনও সময় সেসব অবলোকনের সুযোগ পেয়েছি। দীর্ঘ ছয় মাসে একটু একটু করে জানার-বোঝার সুযোগ হয়েছে তাকে। লেখক প্রকল্পে বোধকরি আমরাই একমাত্র ব্যাচ- যারা পরপর তিনবার শিক্ষাভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি। প্রথম ভ্রমণের শুরুতে চুয়াডাঙ্গায় আঞ্চলিক সাহিত্য সম্মেলন ছিল বাংলা একাডেমির। এরপর সেখান থেকে গিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের কুঠিবাড়ি, লালনের আখড়া, মেহেরপুরের আটকবর, ঐতিহাসিক মুজিবনগরে। যাত্রাপথে একবার চুয়াডাঙ্গার মদ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোম্পানির কারখানা পরিদর্শনও করা গেল। দ্বিতীয় ভ্রমণটিও ছিল বর্ণাঢ্য। তৃতীয় ভ্রমণটা অপ্রত্যাশিতভাবে জুড়ে গিয়েছিল কপালে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর সেমিনার হবে। সেখানে সারা দেশ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কয়েকজন আলোচক যোগ দেবেন। বাংলা একাডেমি থেকে যাবেন শামসুজ্জামান খান, আমিনুর রহমান সুলতানসহ আরও কয়েকজন। প্রথম ভ্রমণটির অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিলাম সেবা প্রকাশনীর মাসিক প্রকাশনা রহস্যপত্রিকায়। পরে লেখাটি স্থান পেয়েছিল আমার লেখা ভ্রমণবই ‘দেখি বাংলার মুখ’-এ।
রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ে ফোকলোরবিষয়ক সেমিনার হবে; ক্লাস নেওয়ার সময় ডিজি স্যার বিষয়টা শেয়ার করলেন আমাদের সঙ্গে। বললেন, ‘তোমরাও চল। অনেক কিছু শিখতে পারবে।’ এটা যেহেতু কম সময়ের ও ‘আনঅফিসিয়াল’ প্রোগ্রাম, সবার যাওয়ার সুযোগ ছিল না তেমন। বিগত দুইটি ভ্রমণের মতো বাংলা একাডেমির গাড়ি ছিল না। আবাসনের ব্যবস্থাও সেই অর্থে ছিল না। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলে ছিলাম। একেকজন একেকটি কক্ষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, সেখানকার ছাত্রদের সঙ্গে সহাবস্থান করেছি। তদুপরি সেই সফরে ছিল না বাংলা একাডেমির কোনও কর্মকর্তার সার্বক্ষণিক দেখভাল তথা নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ।
অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা শামসুজ্জামান খান স্যার বলেই তো খালাস, এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এধরনের বিপদেই পড়লেন। পরে আমিনুর রহমান সুলতানের কাছ থেকে জেনেছি- আমাদের যাতায়াত করার মতো কোনও ফান্ড ছিল না। শেষে তারা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলেই আমাদের হাতে রাহাখরচ তুলে দিয়েছিলেন। এই সেমিনারে যোগ দিয়েছিলাম পাঁচজন- আমি (শফিক হাসান), অরবিন্দ চক্রবর্তী, মামুন সারওয়ার, রণজিৎ সরকার ও শোয়েব সর্বনাম।
শুরুর দিকে আমাদের ক্লাস হতো বাংলা একাডেমির পুরোনো ভবনের দোতলায়- যেটা প্রেস বিল্ডিং নামে পরিচিত। মহাঁপরিচালকের সুপ্রশস্ত রুমের পাশে ছিল ছোট একটি সেমিনার রুম। সেখানে অনায়াসে আমরা বিশজন শিক্ষার্থী বসতে পারতাম। রুমের পাশে হওয়ায় স্যারের জন্য সুবিধা ছিল। প্রশাসনিক কার্যক্রমেও খুব একটা ছেদ পড়ত না। অমর একুশে বইমেলার সময়ে দেখেছি, স্টল বরাদ্দ না পাওয়া প্রকাশক ও বিভিন্ন সংগঠনের কর্তা-ব্যক্তিরা তদবির নিয়ে দোতলায় ডিজি কার্যালয়ে আসতেন। তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্যারকে উঠতে হতো। দ্বিতীয় তলার শেষপ্রান্তে বিশাল একটি সেমিনার রুম। সেখানেও ক্লাস হতো। তবে আমাদের অধিকাংশ ক্লাস পরবর্তী সময়ে হয়েছিল বাংলা একাডেরি গেটের পাশের ভবনটিতে। নিরাপত্তাকর্মীদের অফিস কক্ষের পাশে ছোট অথচ নান্দনিক ভবনে। আমাদের ক্লাসে প্রায়ই একজন ‘বহিরাগত’ উপস্থিত থাকতেন। তিনি দীলতাজ রহমান। বরেণ্য লেখকদের কাছ থেকে তিনিও লেখালেখির টেকনিকগুলো শিখে নিতে যারপরনাই আগ্রহী। সৈয়দ শামসুল হক এক ক্লাসে বলেছিলেন প্রবাদতুল্য বাক্য ‘চকচক করলেই সোনা হয় না’ কথাটি এসেছে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের রচনা থেকে। এটা জেনে দীলতাজ রহমান ভীষণ বিস্মিত ও মোহিত হয়েছিলেন।
শামসুজ্জামান খান স্যার ক্লাস নেওয়ার সময়ে কয়েকদিন বলেছেন তার শিক্ষক জনৈক অজিত স্যারের কথা। (বোধকরি সেই শিক্ষকের ভাল নাম অজিত কুমার গুহ)। যে শিক্ষক পড়াশোনা না করে এসে ক্লাস নেওয়ার কথা ভাবতেই পারতেন না। এমন স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের সামনে নিরন্তর পড়াশোনা ও অধ্যবসায়ের গুরুত্ব তুলে ধরতেন। ‘স্নাতক’ শব্দের তাৎপর্যপূর্ণ একটি ব্যাখ্যাও শুনিয়েছিলেন। আগেকার দিনে গুরুগৃহে শিক্ষা অর্জন করতে হতো। শিক্ষা গ্রহণ শেষে স্নান করে এসে নিতে হতো গুরুর আশীর্বাদ। স্নান থেকেই স্নাতক শব্দের উৎপত্তি। তো স্নাতক এক শিক্ষার্থীকে তার গুরু আশীর্বাদ শেষে বললেন, ‘এবার অন্তত পড়াশোনাটা করো!’
যতদূর মনে পড়ে, পঞ্চম ব্যাচে আমার অন্য আরও সতীর্থ ছিলেন- কুমার অরবিন্দ, অরবিন্দ চক্রবর্তী, ফরহাদ ইলাহী, রনি অধিকারী, তাহিয়া পাপড়ি, সোহেল নওরোজ, তানিম ইশতিয়াক, সৈকত ধারা, মনির মহম্মদ, রঞ্জন শুভ্র, মোস্তফা আবু রায়হান, কিং সউদ, কিশোর মাহমুদ, আল আমিন হক অহন, গোঁসাই পাহলভী, কাজী বর্ণাঢ্য, শোয়েব সর্বনাম, কুমার অরবিন্দ।
আমাদের ব্যাচের আগে ও পরের ব্যাচে ছিলেন এমন কারও কারও নাম স্মরণে আসে- অনন্যা গোস্বামী, মেহেরুবা নিশা, মাসুদ রানা, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, ফারহান ইশরাক, রাবেয়া বেবী, জব্বার আল নাঈম, সুমন মাহমুদ, মনোজিৎ মিত্র, মাসুম আওয়াল, আরিফুন নেছা সুখী, গাজী মুনছুর আজিজ, অজয় কুমার রায়, হিরণ¥য় হিমাংশু, সাবিত্রী গাইন নীলিমা, অচিন্ত্য চয়ন, সামিনা বিপাশা, সালমান তারেক শাকিল, নাদিম মজিদ, জোনাক আহমেদ। কখনওসখনো চতুর্থ ও পঞ্চম ব্যাচ মিলিয়ে যৌথ ক্লাস হতো। মাস শেষে ভাতা হিসেবে আমাদের দেওয়া হতো সাড়ে চার হাজার টাকা। কেউ অনুপস্থিত থাকলে হাজিরা তালিকা দেখে টাকা কর্তন করা হতো। টাকাগুলো অনেকের জন্যই সহায়ক হতো। আমার জন্য তো বটেই, তখন ছোট একটা চাকরি করতাম। সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা বেতনে। তরুণ লেখক প্রকল্পে চান্স পেয়েছি, সকাল দশটা থেকে একটা পর্যন্ত ক্লাস। তাই কর্মস্থলে সপ্তাহে পাঁচদিন দশটা-পাঁচটার পরিবর্তে একটা-আটটা পর্যন্ত অফিস করার প্রস্তাব দিলাম। তিন ঘণ্টা আগু-পিছু হবে- বড় কোনও ব্যত্যয় ঘটবে না। কিন্তু এমন সিদ্ধান্তে বস রুষ্ট হয়ে বললেন, ‘ওরা (বাংলা একাডেমি) তোমাকে কোন ছাতা-মাতা শেখাবে!’
অবশ্য শুরুর দিকে আমারও এমনটাই ধারণা ছিল। কিন্তু দিন যত যেতে লাগল, ধারণা পাল্টাতে সময় লাগল না। আমি যে আদতে কিছুই জানতাম না ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার হতে থাকল। সমতাহীন অফিস সময় দেখে অফিস বসের মুখ গোমরা হতে থাকল প্রায়ই। একসময় চাকরিটা ছেড়েই দিলাম। আমার সম্বল বাংলা একাডেমি থেকে প্রাপ্ত মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা। আর এখান-ওখান থেকে পাওয়া যৎকিঞ্চিত লেখার বিল। কোর্সের আগে ও কোর্স চলাকালীন বাংলা একাডেমির সাহিত্যপত্র ‘উত্তরাধিকার’-এ দুইটা লেখা প্রকাশিত হয়। উত্তরাধিকার’র নির্বাহী সম্পাদক কবি সরকার আমিনের মাধ্যমে। আমার লেখক নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। দুইবারই আমিন ভাইয়ের শরণাপন্ন হয়েছি। তিনি অ্যাকাউন্ট পে চেকের বিপরীত পাশে স্বাক্ষর করে দিলে নগদ টাকা তোলার সুযোগ পেয়েছি।
‘তরুণ লেখক প্রশিক্ষণ কোর্স’ চলাকালীন কথাসাহিত্যিক নূর কামরুন নাহার কল আমাকে নতুন একটি কোর্সে অংশগ্রহণ করতে বলেন। তার পরামর্শটা গ্রহণ করি। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে শুরু হবে ‘পা-ুলিপি সম্পাদনা ও প্রুফ রিডিং কোর্স’। এক সপ্তাহের এই প্রকল্পে অংশগ্রহণ করি, কাউকে কিছু না জানিয়ে। লেখক প্রকল্পের ক্লাস শেষ হওয়া মাত্রই চলে যেতাম গুলিস্তানস্থ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে। অবশ্য এ জন্য বাংলা একাডেমির দুই-একটি ক্লাসও বাদ দিতে হয়েছিল। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মহাঁপরিচালক তখন কবি রফিক আজাদ। কোর্সের সুবাদে কবিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। এই প্রকল্পেও কিঞ্চিৎ অর্থযোগ ছিল। সংগ্রামমুখর দিনে লেখক প্রকল্পে থাকাকালীন ‘তিক্ত’ অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে এখন। একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কিছু লেখার বিল বাকি ছিল। হাতটান চলছে, ক্লাস শেষে হেঁটেই গেলাম কার্যালয়ে। অ্যাকাউনটেন্ট ভদ্রলোক খাতাপত্র দেখে বললেন, আপনার কোনও বিল তো বাকি নেই। নিজেই হয়তো তুলে নিয়ে গেছেন!
আমি কবে নিলাম, মনে করতে পারলাম না। এত বড় ভুলও করব! চাকরিটা যেহেতু ছেড়ে দিয়েছি, শুরু হলো নানাবিধ সংকটের জীবন। আদতে প্রায় সব সংকটই মূলত একমুখী- অর্থকেন্দ্রিক!
ঢাকা শহরে লেখক হতেই তো এসেছিলাম, বাংলা একাডেমিতে আসাও অভিন্ন উদ্দেশ্যেই। কিন্তু লেখক হতে পারছি কই? কোনও সম্ভাবনাও তো দেখছি না! আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে, দিন দিনই মিইয়ে যাচ্ছি। সপ্তাহে পাঁচদিন নিয়ম করে ক্লাসে যাই, দেশসেরা লেখকরা লেখালেখির নানামুখী পাঠ দেন; তাদের জীবন-ঘষা অভিজ্ঞতার নির্যাস-বক্তব্য শোনান আমাদের। লেখক হওয়ার ইচ্ছে একটু একটু করে অনুজ্জ্বল হতে থাকে। লেখালেখিরও এত ব্যাকরণ, নেপথ্যে সচেতনভাবে রেখে দিতে হয় এত সব ‘ক্লু’, মাথা চক্কর না খেয়ে উপায় আছে! অথচ এদ্দিন আমরা কত সহজভাবেই না নিয়েছিলাম লেখাজোকাকে। মন চাইলে লিখলাম, তারপর ছাপার উদ্দেশে পাঠিয়ে দিলাম সম্পাদক বরাবর! কোনও ‘প্যাঁচগোচ’ ছিল না এসব চর্চায়।
গ্রাফিক্স শিখব বলে ২০১০ সালে আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি প্রতিষ্ঠানে গেলাম। প্রতিষ্ঠানপ্রধান বললেন, ‘এমএস ওয়ার্ডটা ভালভাবে শিখে আসুন। নইলে তাল মেলাতে পারবেন না।’ সেটা তো আমি পারি- কত্ত সহজ! কিন্তু তার এক কথা- যেনতেনভাবে পারলে হবে না; ভালভাবে পারতে হবে। বাধ্য হয়ে ওয়ার্ড কোর্সে ভর্তি হলাম। এক সপ্তাহের মধ্যেই বুঝে গেলাম, আদতে কিছুই পারতাম না। বাংলা-ইংরেজি কম্পোজ করতে পারা কোনও হিসাবের মধ্যেই পড়ে না! একই অভিজ্ঞতা হলো লেখক প্রকল্পে এসেও। নিজেকে নীরব ধিক্কার দিতে থাকলাম, কত কম জেনে-বুঝে এত বড় একটা কাজে হাত দিয়েছিলাম। লেখক হওয়া আর কাগজে লেখার সঙ্গে নাম ছাপা হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
মনে পড়ছে ক্লাসে বলা ভীষ্মদেব চৌধুরীর কথা। লেখালেখির বিপদ সম্বন্ধে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন- ‘লিখব কবিতা হয়ে যাবে পদ্য, লিখব গল্প হয়ে যাবে আখ্যান!’ মানে চাইলেই কবিতা লেখা যায় না, গল্প লেখা যায় না- শিল্পবোধ শিল্পমূল্যের দিকে দিতে হয় তীক্ষè নজর। বোধকরি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁইমাচা’ গল্পের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ভীষ্মদেব চৌধুরী বলেছিলেন ‘অদ্ভুত’ একটি কথা। পুঁইশাকের লাল বীজ ও পাতার সঙ্গে নববিবাহিতা বালিকা-কনের লাল শাড়ির প্রান্ত মাটি স্পর্শ করেছিল- দুয়ের মধ্যে অলিখিত সাদৃশ্য উপস্থাপন করেছিলেন স্যার! মানে পাঠকেরও থাকতে হয় যোগ্যতা, যে যোগ্যতাবলে একটি ভাল রচনার অন্তর্নিহিত শক্তি আবিষ্কার করা যাবে।
‘শিল্পের বড়াই’ করা কোনও বামনের সাজে না। তাই সব ‘আমিত্ব’ উড়িয়ে দিয়েছিলাম এক ফুৎকারেই। বাংলা একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে পেয়েছি অনেক গুণী লেখককে। মনে করতে পারছি কয়েকজনের নাম- সৈয়দ শামসুল হক, আবুবকর সিদ্দিক, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, দ্বিজেন শর্মা, খায়রুল আলম সবুজ, আবুল আহসান চৌধুরী, আনিসুল হক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, বিশ্বজিৎ ঘোষ, অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, নাসির আহমেদ, লুৎফর রহমান রিটন, বদিউদ্দিন নাজির, (বাংলা একাডেমির সচিব) আলতাফ হোসেন, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, জাকিউল হক, (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক- যার নামে প্রতিষ্ঠিত আমিন চত্বর) আমিনুল ইসলাম, হায়াৎ মামুদ, সাইদুর রহমান বয়াতী, আনোয়ারা সৈয়দ হক, জাকির তালুকদার, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেন, আহমাদ মাযহার, শামীম আজাদ, আসাদ চৌধুরী, আহমদ কবির, খালেক বিন জয়েনউদ্দীন, অসীম সাহা, খালেদ হোসাইন প্রমুখ। দীর্ঘ ছয় মাসে সতীর্থদের সঙ্গে যেমন অম্লমধুর স্মৃতি জমা হয়েছে, তেমনি বরেণ্য লেখকদের সঙ্গেও।
প্রেস বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় পেয়েছিলাম সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে। তিনি আসবেন জেনে ফরহাদ ইলাহী সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তার লেখা ‘গল্পের কলকব্জা ও মার্জিনে মন্তব্য’। টেবিলের উপরে বইটা দেখে যেই-না হাত বাড়িয়েছি, ধমকে উঠলেন সব্যসাচী- ‘বই রাখো! বই পাবে, আমাকে পাবে না।’ কী রূঢ় বাস্তবতা, এখনও আমার সংগ্রহে বইটা আছে। কিন্তু নেই সৈয়দ শামসুল হক! কেঁদেও পাব না তারে।
আরেকটি পরামর্শও দিয়েছিলেন সৈয়দ হক। বলেছিলেন, ‘লেখার সময় নিজেকে সম্রাট ভাববে। পাঠকের উদ্দেশে মনে মনে বলবে- আমি যা দেখাব, সেটাই দেখবে। যেভাবে দেখাব, সেভাবেই দেখবে। যা শোনাব, সেটাই শুনবে!’
ঢাকায় আসার পর খালেক বিন জয়েনউদ্দীন থাকতেন কমলাপুরে- দীনহীনভাবে, প্রাতকৃত্য সারতে তাকে পাড়ি দিতে হতো কয়েক কিলোমিটার পথ। আবার সাইদুর রহমান বয়াতীর একটি অভিজ্ঞতাও মনে দাগ কেটে আছে। আমাদের আগের ব্যাচগুলোতেও ক্লাস নিয়েছেন তিনি। কী একটা কাজে গিয়েছিলেন কোনও এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে। সেখানকার এক কর্মী তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে উষ্ণ আতিথেয়তা দিলেন। এই তুচ্ছ ও স্বাভাবিক ঘটনাতেই অভিভূত হয়ে গেলেন সাইদুর রহমান বয়াতী। ক্লাসে আমাদের সঙ্গে ভাললাগার অভিজ্ঞতাটি শেয়ারও করেছিলেন। এটার ব্যাখ্যা হতে পারে এমন- টেলিভিশন চ্যানেল অনেকের জন্যই স্বপ্নের জায়গা। সেখানে যদি অপ্রত্যাশিতভাবে এমন গুণগ্রাহী ছাত্র পাওয়া যায়- সেটা মানিকগঞ্জে অবস্থানকারী সাইদুর রহমান বয়াতীর জন্য নতুন বার্তাই হয়তো বয়ে এনেছিল।
তিনজন প্রশিক্ষকের কথা বললাম। এর বাইরে এই প্রকল্পের আরও অন্তত তিনজন প্রশিক্ষকের কাছে আমি অপরাধী হয়ে আছি। প্রথমজনের কথা অন্য কোথাও ‘নিরাপদ সময়ে’ বিশেষভাবে লিখতে হবে।
অন্য দুজন শিক্ষক দ্বিজেন শর্মা ও আবুবকর সিদ্দিক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাড়ম্বরে আমাদের গাছ চেনাতে নিয়ে যাওয়া হলো। নেতৃত্বে আছেন দ্বিজেন শর্মা; সঙ্গে এনেছেন তার এক ছাত্রকে (বয়সী সেই ছাত্রও একজন অধ্যাপক)। গাছ চেনানো শুরু হয়েছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে ধীরে ধীরে আমি পিছু হটে ভাগলাম। দেশের বড় একটি প্রকাশনা সংস্থায় প্রথম পা-ুলিপি জমা দিয়েছিলাম। গল্পগ্রন্থের। সেখানে সাক্ষাতের জন্য প্রকাশক ডেকেছেন। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপছিলাম আমি। দ্বিজেন শর্মাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলাম বটে, বোধহয় সেই পাপে বইটি আর প্রকাশিত হলো না। প্রকাশক মহোদয়ও আমাকে নিয়ে এতভাবে খেলিয়েছেন, প্রচুর লাল-সাদা মুলা প্রদর্শন করেছিলেন- শেষপর্যন্ত অশ্বডিম্বই মিলল!
আরেকজন লেখক আবুবকর সিদ্দিক। কী কারণে যেন ক্লাসের তেমন কেউই তার বক্তব্যে মনোযোগ দিচ্ছিল না কিংবা মনোযোগ বসাতে পারছিল না। বিষয়টা বুঝতে পেরে তিনি উষ্মা প্রকাশও করেছিলেন। এসময় আমার জরুরি একটা কল আসে। যেতে হবে শাহবাগে। স্যারের সামনে গিয়ে জানালাম ছুটি চাই। একদিকে ক্লাসে ‘ফাঁকিবাজ’দের অমনোযোগ, অন্যদিকে আমার ছুটি প্রার্থনা- তিনি মূক হয়ে তাকিয়েছিলেন আমার দিকে। আমিও বুঝে গেলাম পরিস্থিতি অনুকূলে নেই। তাই অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ছুটলাম। এসব অপরাধের জন্য এখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। নীরব দহনে জ্বলি-পুড়ি। অক্ষমতার অন্তর্জ্বালাও ভেতরে ভেতরে কাজ স্মৃতি বাতায়নে দোলা খেলে।
লেখক হব বলেই তো এই ইটপাথর তথা দূষিত শহর ঢাকায় এসেছিলাম। তরুণ লেখক প্রকল্পে অংশগ্রহণ সেই প্রচেষ্টারই অংশ। কিন্তু তেমন লেখকইবা হতে পারলাম কই! অথচ কল্পনার চোখে যদি নব্বই দশকের দিকে তাকাই কত খ্যাতিমান লেখক, উজ্জ্বল সব নাম দেখ পাই। তারাই ধরে রেখেছেন লেখক প্রকল্পের নাম ও মান। জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা এই প্রকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা। সে সময়ের যেসব লেখক-প্রশিক্ষণার্থীর নাম মনে পড়ছে- শোয়াইব জিবরান, তপন বাগচী, আশিক আকবর, আকমল হোসেন খোকন, শেফু জামাল, প্রণয় পলিকার্প রোজারিও, রতনতনু ঘোষ, ফাহমিদুল হক, আশরাফ পিন্টু, সৈয়দা নাজমুন নাহার, আলমগীর রনজু, মতিন রায়হান, বায়তুল্লাহ কাদেরী, বদরুল হায়দার, প্রত্যয় জসীম, মজিদ মাহমুদ, টোকন ঠাকুর, মুজিব ইরম, চঞ্চল আশরাফ, রাজীব নূর, অলকা নন্দিতা, সৌমিত্র দেব, রাখাল রাহা প্রমুখ।
কুণ্ঠা ও হীনম্মন্যতা নিয়েই বলছি- এতসব উজ্জ্বল-চকচকে নামের ভিড়ে আমাদের (বিশেষ করে আমার) অবস্থান কোথায়! দূর বা অদূর ভবিষ্যতে তেমন কোনও আলোর ঝলকানিও দেখার মতো দৃষ্টিশক্তি খুঁজে পাই না। এই ২০২৪ সালে তৃতীয়বারের শুরু হতে যাচ্ছে লেখক প্রকল্প। এবার অবশ্য সপ্তাহে দুইদিন করে ক্লাস। জানি না, ভবিষ্যতের কোর্সগুলোর আউটপুট কেমন হবে! চিন্তাশীল লেখক কিংবা কথাসাহিত্যিকদের আগমনধ্বনি ‘নেতিবাচক চিন্তায় অভ্যস্ত’ আমি শুনছি না; খুঁজেও পাই না। চারদিকে কবিতালেখকের ছড়াছড়িই তো দেখি। কিংবা আসতেও পারে ভাল কিছু, পরিস্থিতি তো যেকোনও সময়ে যে কোনওভাবে বদলাতেই পারে!
প্রথম দফায় (নব্বইয়ের দশকে) যারা কোর্স করেছিলেন, প্রায় সবারই ক্ষেত্র অনুসারে বই প্রকাশিত হয়েছিল। আমাদের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল হাইয়ের উদ্যোগে একটি যৌথ প্রকাশনা (চতুর্থ ও পঞ্চম ব্যাচ মিলিয়ে) হওয়ার কথা থাকলেও শেষপর্যন্ত হয়নি।
বোধকরি ষষ্ঠ ব্যাচ থেকেই সমাপ্তি ঘটে নবপর্যায়ে লেখক প্রকল্পের। শুনেছিলাম, সম্ভাবনাময় লেখক পাওয়া যাচ্ছিল না আর। শুধু আবেগের বুদ্বুদ-ওঠানো কচি-কাঁচা কবিতালেখক দিয়ে এমন একটি প্রকল্প (যে প্রকল্পের নামের সঙ্গে যুক্ত ‘লেখক’ শব্দটি) চালানো সমীচিন মনে করেননি সংশ্লিষ্টরা। তরুণ লেখক প্রকল্প আমাকে যা দিয়েছে, তার তুলনা নেই। ধনাত্মক হিসাবের খাতায় সবই তো সঞ্চয়। এত এত আলোকোজ্জ্বল মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, কাছ থেকে তাদের লেখক হওয়ার অভিজ্ঞতা শুনেছি, জেনেছি তাদের শিল্প-দর্শন- লেখক প্রকল্প ছাড়া এমন চমৎকার সুযোগগুলো আর কোথায় মিলত!
স্মৃতি সরোবরে ভাসতে ভাসতে একটি গানের কথা মনে আসছে বারবার। যেটা লেখক প্রকল্পের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা বোঝানোর জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক- আমি অকৃতী অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি/ যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাওনি।
তবুও থেকে যায় কিছু প্রশ্ন। কী পেলাম আর কী দিলাম, কী দিতে পারব!
শিক্ষা কী? একজন মনীষীর ব্যাখ্যা ছিল, দীর্ঘ পাঠশেষে ভুলে যাওয়ার পর যতটুকু মনে থাকে, সেটাই শিক্ষা। ওইভাবে হিসাব করলে সত্যিই আমি কুলাঙ্গার ছাত্র। বিশ্বজিৎ ঘোষ স্যারের আশঙ্কাই হয়তো ঠিক। এত বড় শিক্ষায়তন থেকে তেমন কিছুই গ্রহণ করতে পারিনি। আমার হাতে লণ্ঠন ঠনঠনে অবস্থা দেখে একবার কথাসাহিত্যিক সোলায়মান সুমন বলেছিলেন, ‘তরুণ লেখক প্রকল্প থেকে কোর্স করে অনেক লেখকই তো ঝলসে উঠেছিলেন। তোমার অবস্থা এত করুণ কেন?’
আদতেই করুণ। এই করুণ অবস্থার মধ্যেও শেষ বেঞ্চের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি কোনও কোনও শিক্ষকের আকর্ষণীয় কিছু মন্তব্য ও দর্শন মনে রেখেছি। সেসবের কিছুটা শেয়ার করছি। মন্তব্যগুলো কারও কারও ভাল লাগতেও পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম নিজ দর্শনকে আখ্যায়িত করেছেন ‘আমিনীয় দর্শন’ হিসেবে। তার দুটি দর্শন হচ্ছে- ১. কাদা থাকবে, কাদা ছোড়াছুড়ি থাকবে না। ২. সম্প্রদায় থাকবে, সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না।
জাকির তালুকদার পরামর্শ দিয়েছেন, ‘উত্তমপুরুষে লেখা যাবে না। তাতে লেখা দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’ কথাটা হয়তো সত্য। তবে লেখক দক্ষ হলে নিশ্চয়ই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হন। কেউ যখন বেশি ‘আমি আমি’ করতে থাকে, সবকিছু হয়ে পড়ে ‘আমিময়’। এই বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের একটি অভিজ্ঞতার কথাও একান্ত আলাপে আমাকে বলেছিলেন ২০২৩ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, অনুবাদক ও শিক্ষক সালেহা চৌধুরী। সালেহা চৌধুরীর একটি গল্প পড়ে হুমায়ূন আহমেদ পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘উত্তমপুরুষে লিখবেন না। চরিত্র নারী নাকি পুরুষ বুঝতে অনেক সময় লেগে যায়!’ এক্ষেত্রে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। দক্ষ লেখকের কাজ হচ্ছে রহস্য সৃষ্টি করা, পাঠককে বিভ্রমে রাখা, ধূম্রজালের মাধ্যমে ধরে রাখা। সবকিছু যদি লেখক শুরুতে খোলাসা করে দেন, তাহলে রহস্য বা আবছায়া থাকে কোথায়!
এক ক্লাসে দেরি করে এসেছিলাম আমি ও ছড়াকার মামুন সারওয়ার। তখন পাঠ দিচ্ছিলেন অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী। মামুন সারওয়ার চট করে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার, আপনার পরিচয়টা…?’
আবুল আহসান চৌধুরী রুষ্ট হলেন এমন প্রশ্নে। বললেন, ‘সেটা বাংলা একাডেমির কাছ থেকেই তোমাদের জেনে নেওয়া উচিত ছিল।’ পরে ক্লাসের শেষ দিকে তিনি পরিচয় খোলাসা করেছিলেন- ‘আবুল আহসান চৌধুরী নামের মানুষটি আমি।’ এভাবে আর কখনও কাউকে পরিচয় দিতে দেখিনি! মামুনও ক্ষেপেছিল আরও- ‘কী আজব মানুষ, নিজের পরিচয় দিলে ক্ষতি কী!’
শোয়েব সর্বনাম ছিলেন একটু কুচুটে প্রকৃতির মানুষ। সবকিছুতেই তিনি প্যাঁচ লাগিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন। লুৎফর রহমান রিটন ক্লাস নিচ্ছিলেন, এসময় তিনি উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করলে রিটন ভাই হালকা ঝাড়ি দিয়ে বললেন, ‘তুমি কিন্তু কুতর্ক করছ, মিয়া!’ আল মাহমুদের মতের সঙ্গে না মিললে তাকে অস্বীকার করা যায় না। স্বৈরাচারবিরোধী একটি ছড়ার প্রশংসা করলেন লুৎফর রহমান রিটন। ভাল বই খারাপ বই বিতর্ক শুরু হলে তিনি একজনকে বললেন, ‘আমার বইটা খারাপ হলে তুমিও তো বাসায় রাখবা না, মিয়া!’
একজন লেখক সমকালে মূল্যায়িত না-ও হতে পারেন কিংবা হতে পারেন অতি মূল্যায়িতও। বিষয়টি উল্লেখ করে আহমাদ মাযহার বললেন, ‘শফিক হাসান কী লিখেছেন, কেমন লিখেছেন সেটা বোঝা যাবে আজ থেকে দুইশ’ বছর পরে। যখন তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, চেনা-জানা কেউই থাকবে না।’ তিনি ক্লাস নিয়েছিলেন প্রাবন্ধিক আবদুল হককে নিয়ে।
লেখক ও অভিনেতা খায়রুল আলম সবুজ ক্লাসে এসে বললেন, ‘তোমাদের যার যা মন চায়, লেখো। লেখার অর্থ থাকতেই হবে এমন নয়। উন্মুক্ত লেখা।’ সবাই যার যার লেখা দেখালে তিনি ‘প্রমাণ’ করে দিলেন ‘কোনও লেখাই অর্থহীন নয়। সব লেখাই কোনও না কোনও অর্থ বহন করে।’
আনোয়ারা সৈয়দ হক পেশাগত জীবনে মনোচিকিৎসক। মনোস্তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে তিনি একদিন বললেন, ‘কোনও মানুষ যদি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠে, ঘুরে-ফিরে সে আবার তেমন একটি জীবনই বেছে নেয়।’ উদাহরণ টানলেন সংসারের। কোনও মেয়ে যদি বাবা-মায়ের দাম্পত্য-কলহ দেখতে দেখতে বড় হয়, বিয়ের সময় সেও এমন একটি অস্বস্তিকর জায়গাই বেছে নেয়। কারণ তার ‘মেন্টাল সেটআপ’ সচরাচর এর বাইরে যায় না।
খালেদ হোসাইন বলেছেন, ‘মুখের কথা আর মনের কথা সবসময় এক হয় না।’ কোনও ছেলে হয়তো পছন্দের মেয়েটিকে প্রস্তাব দিল। আর মেয়েটি যদি ‘যাহ’ বলে উঠে, এতে ছেলেটি মনে করে সে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে তাহলে প্রেমিকের ভাবনায় ভাষার ‘বিকৃতি’ ঘটে গেছে। কারণ কোনও কোনও ‘না’ মূলত ‘হ্যাঁ’!
যাত্রাকালে কেউ কেউ গাড়িতে চড়ে শুধু, আর কিছু না। তাই নির্জীব থাকে। খালেদ হোসাইনের পরামর্শ- জানালায় চোখ রেখে সবকিছু দেখবে। গাছ দেখবে, মানুষ দেখবে, পাখি দেখবে। জীবনকে উপভোগ ও উপলব্ধির চেষ্টা করবে।
ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) পাণ্ডুলিপি সম্পাদক বদিউদ্দিন নাজির। নিজের লেখালেখির সম্ভাবনা বুঝতে পেরে হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে অধ্যাপনার চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে এটাই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত।
প্রশ্ন রাখেন বদিউদ্দিন নাজির, ‘হুমায়ূন আহমেদ বাজারি লেখক, কে বলল?’
ইউপিএল কোনও কবিতার বই প্রকাশ করে না। পিয়াস মজিদের একটি কবিতার বই প্রকাশ করার কথা থাকলেও শেষপর্যন্ত সেটাও বাতিল হয়ে যায়। বইয়ের বিক্রি, কবিতার পাঠক নেই, বিশ্ববাজারে বইয়ের বিপণন- এসব বিষয়ে কথা বলেছিলেন তিনি।
আনিসুল হক ক্লাসে বসেই ফুরফুরে মেজাজে কবিতা আবৃত্তি করেছেন। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ সব কবিতাও তার মুখস্থ! কিছুক্ষণ পর এই মুখস্থের হদিস বের করতে পারলাম। আমাদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘একশ’টা ভাল কবিতা মুখস্থ করেন, আপনি কবি হয়ে যাবেন!’ লেখালেখির প্রস্তুতির বিষয়ে আলোকপাত করেন তিনি। একটি লেখা পড়ে কেন আমরা হাসি বা কাঁদি? অনুভূতিতে মোচড়-লাগা অংশটি আবার পড়ার পরামর্শ দেন তিনি। কোনও কোনও লেখক লিখে সন্তুষ্ট হতে পারেন না। মনে হয়, এই শব্দের বদলে অমুক শব্দ ব্যবহার করলেই বুঝি ভাল হতো! উদাহরণ টেনে আনিসুল হক বললেন, দূরের কোনও জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কোনও কবি প্রথম আলোতে একটি কবিতা পাঠালেন, ডাক বিভাগের খামে। কিন্তু কবিতাটি পোস্ট করার পর তার মনে হলো একটি শব্দের ব্যবহার ঠিক হয়নি। এই শব্দের বদলে অন্য আরেকটি শব্দ ব্যবহার করলে অধিকতর যুৎসই হয়। খাম যেহেতু রওনা দিয়েছে, ঠেকানোর উপায় নেই। তরুণ কবি প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক বরাবর কল করে বললেন, ‘আমি একটি কবিতা পাঠিয়েছি। কবিতাটা যদি না ছাপেন, সমস্যা নেই। আর যদি ছাপেন এই শব্দটা পাল্টে অমুক শব্দটা দেবেন।’
একজন কবির মধ্যে এমন তাড়না কেন আসে, তিনি সততই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান- এজন্যই কি! বিষয়টা খুব চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন আনিসুল হক।
লেখালেখির জন্য বানান জানা, বানান সচেতনতা খুব জরুরি বিষয়। এমনটাই বললেন কবি নাসির আহমেদ। একজন লেখক বারবার ভুল বানানে লেখা পাঠান, সম্পাদক প্রতিবারই সেসব শুধরে দেন। একদিন সম্পাদক সেই লেখককে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, আপনার কি বানান নিয়ে খটকা জাগে না?’
‘না। আমার মনে কোনও খটকা জাগে না!’ নির্বিকারভাবে বললেন ভুল বানানে লেখা সেই লেখক।
আরেকটি বড় গল্পও বলেছিলেন নাসির আহমেদ। নামকরা একজন কবি-অধ্যাপকের খোঁজে এলেন একজন পাঠক। সেই কবি ভীষণ রকম প্রচারবিমুখ। নিজেকে প্রকাশ করতে চান না। তো সেই পাঠক যখন বিদায় নেন, কিছু একটা মনে পড়লে তাকে খুঁজে বের করতে পথে নামেন সেই কবি। খুঁজে পেয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘কাউকে বলবেন না আমার কবিতার কথা!’ অথচ তিনি ভীষণ খ্যাতিমান কবি। আর বর্তমান বাস্তবতায় কেউ ভুলভাল দুই-চারটা গদ্যপদ্য লিখেই হাঁকডাকে চারপাশ প্রকম্পিত করে তোলেন।
পরপর কয়েকদিন ক্লাস নিয়েছিলেন হায়াৎ মামুদ। একদিন বললেন, ‘তোমরা সবাই কিছু না কিছু লিখে আনবে। তোমাদের লেখা পড়ব। তবে কবিতা আনবে না, কবিতার কিচ্ছু বোঝা যায় না!’
প্রথম জীবনে হায়াৎ মামুদ নিজ উদ্যোগেই দুইটা কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন। নিজের নামটিও ধার করেছেন মধ্যযুগের একজন কবির নাম থেকে। সেই তিনিই কবিতা নিয়ে এমন একটি সত্য ভাষণ দিয়ে দিলেন। বিষয়টিতে আমরা প্রভূত মজা পেয়েছিলাম।
সুন্দরের সংজ্ঞা কী, সুন্দর আদতে কেমন? এ বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন মুহম্মদ নূরুল হুদা। টেবিলের উপরে রাখা তার দোমড়ানো-মোচড়ানো খাতাটির দিকে আমাদের একজন সতীর্থের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘আমার খাতাটা কি অসুন্দর? আর তোমার পাশের ছেলেটি (আমি শফিক হাসান) সেও কি অসুন্দর!’
বস্তুত দেখতে জানলে সবকিছুই সুন্দর। আবার ভয়ঙ্কর সুন্দরও আছে। বেদেনী যখন খোঁপায় বেঁধে নেয় জ্যান্ত সাপ- সেটাই তো ভয়ঙ্কর সুন্দর! আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার দেশের মুখ্যমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সাবধান করে দিয়ে কবিতা লেখেন ‘ইন্দিরার প্রতি’। গুজরাটে যখন ভয়ানক বন্যা, হেলিকপ্টারে চড়ে সেই দেখনে যেন ইন্দিরা গান্ধী না যান। দিগন্তবিস্তৃত পানি দেখে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ ফসকে বেরিয়ে আসতে পারে- ‘বাহ, কী সুন্দর!’ এমন আশঙ্কা থেকেই সুনীল সতর্ক করেছিলেন প্রিয় ইন্দিরাকে।
এখনকার তরুণরা কী চমৎকার সব কাজ করছে, সেসব উল্লেখ করেছেন সেলিনা হোসেন। মৌলভীবাজার, কমলগঞ্জের শুভাশিস সিনহার কথাও বললেন। মণিপুরী লোকসংস্কৃতি নিয়ে মুগ্ধতার কথাও বললেন। এমন আরও কয়েকজনের কথা বলে অকাতরে প্রশংসা করলেন। একবার যাত্রাপথে কয়েকজন কিশোরের উদ্দাম সাঁতার দেখে গাড়ি থামালেন তিনি। মুগ্ধ হয়ে দেখলেন তাদের সাঁতার। এর মধ্যেই এক কিশোর আরেকজনকে গালি দিল- তোর মারে চুদি!
কী অবলীলায় স্ল্যাংটি উচ্চারণ করলেন সেলিনা হোসেন। মুগ্ধ চোখে দেখি একজন আলোকিত কথাসাহিত্যিককে। আমি পুরুষ হয়েও কখনও প্রকাশ্যে শব্দটি উচ্চারণ করিনি। আর তিনি ক্লাসেই বলে দিলেন, এতগুলো তরুণ-তরুণীর সামনে! কিশোরদের গল্প শেষে সেলিনা হোসেন বললেন, ‘গালি দেওয়া ছেলেটি আমি কাছে ডাকলাম। বিস্কুট খাওয়ার জন্য টাকাও দিলাম। আদর করলাম। কিন্তু আমি ছেলেটিকে বলতে পারলাম না, এভাবে কথা বোলো না! কারণ ভাষার নদীর মতো প্রবহমান।’
কী চমৎকার উদাহরণ, কী দারুণ জীবনবোধ।
এই গল্পের সঙ্গে মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘সৌন্দর্য তত্ত্ব’রও কেমন যে সাযুজ্য খুঁজে পাই।
এত জ্ঞানীগুণী মানুষকে কাছ থেকে দেখেছি, তাদের বোধ ও বোধির গল্প শুনেছি। এসব নিশ্চয়ই কম পাওয়া নয়। এর বাইরে আমি যদি লেখক হতে পারি তো ভাল; না পারলেও নিশ্চয়ই কোনওভাবে এক চিমটি ক্ষতি হবে না কারও! বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের কাছে আমি ঋণী। এই ঋণের বোঝা দিনদিন বেড়ে চলবে নিশ্চয়ই!
শফিক হাসান : কথাসাহিত্যিক ও ছোটকাগজকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা তরুণ লেখক প্রকল্প ও সাহিত্যিক হওয়ার কসরত শফিক হাসান স্মৃতিকথা