Saturday 04 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্মৃতির মানসপটে শৈশবের শারদীয় দূর্গাপূজা


১৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:৫১ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:০৮

শৈশব-কৈশোরের অন্যতম উৎসব ছিল শারদীয় দুর্গাপূজা। হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও এটা সর্বজনীন একটা ব্যাপার। ছোটবেলায় দেখতাম মণ্ডপে পূজা-অর্চনা চলছে, ঢাকঢোল বাজছে, নিজেদের উদ্ভাবনী দেখাচ্ছে অনেকেই। এসব অনুষ্ঠান কারও জন্য সীমাবদ্ধ ছিল না। দুর্গাপূজার সময়টাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। শরৎকাল প্রসন্ন সময়। শরতে প্রকৃতির সুন্দর মেজাজ মনযোগ দিয়ে লক্ষ করতাম। অনেক ভালো লাগত। প্রকৃতির শুভ্রতার সঙ্গে মিশে থাকতাম।

বিজ্ঞাপন

নগরলালিত হলেও আজও শরতের রূপ সমানতালে মুগ্ধ করে। বর্ষার উদার দক্ষিণায় সম্পন্না প্রকৃতি তার যৌবনের সবটা লাবণ্য এ সময় ফুটিয়ে তোলে— সে একেবারে আকাশ থেকে পায়ের নিচের ঘাস পর্যন্ত। বর্ষার আচ্ছন্নতা কাটিয়ে প্রচ্ছন্নতার আড়াল ঘুচিয়ে হঠাৎ যেন আকাশ-পৃথিবীজুড়ে আলোর রহস্য বয়ে যায়। প্রকৃতির মহৎ ও নগণ্য প্রতিটি সদস্যই জেগে উঠে যেন সম্ভাষণ জানায়, ভাব বিনিময় করতে চায়।

ছোটবেলার পূজার স্মৃতি আজও মনে পড়ে। দীর্ঘকাল ধরে এ রেশ আছে। কিছু মুহূর্ত আছে যা কালক্রমে কানে বেজে ওঠে। পূজা এলে রামকাকু ও প্রাণকাকু মিলে দিতো একসেট জামা কাপড় এবং বরাবর পূজাতে গীতা পিশি তিনভাইয়ের জন্য আরেক সেট পূজার জামা কাপড় পাঠাত। নতুন জামাকাপড়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম। নতুন জামাকাপড় যথাসাধ্য পরিপাটি করে বন্ধু-বান্ধব মিলে পূজামণ্ডপগুলোতে ঘুরে বেড়াতাম। পূজায় আমাদের বাড়িতে দুধের সন্দেশ, নারিকেলের নাড়ু বানানো হতো। নিজেদের ঘরেও খেতাম আবার পূজো বাড়িতে গেলেও খাওয়া হতো।

পাড়ার পূজাগুলোতে দাপিয়ে বেড়িয়েছি। লক্ষ্মীপূজা অথবা সরস্বতী পূজায় এ বাড়ি, ও বাড়ি ঘুরতাম। আর পূজামণ্ডপগুলোর আশপাশেই থাকতাম। চেয়ে থাকতাম মুগ্ধ চোখে প্রতিমার রূপ, দুর্গা মায়ের ঐশ্বর্য। কীর্তন, শ্যামাসংগীত শুনতাম। প্রাণ ছুঁয়ে যেত। আরতির সময় ঢাক-কাঁসরের তালে তালে নাচ হতো। ঢাকের বিরতির সময় টেপ রেকর্ডারের সর্বোচ্চ ভলিউমে কলকাতার আধুনিক গান চালানো হতো। সন্ধ্যা-হেমন্তদের মিষ্টি রোম্যান্টিকতার ভীড়ে আশা ভোঁসলের চটুল গানও উঁকিঝুকি দিত একটু একটু পর। যখন একটু বড় হলাম তখন সেইগুলোর সাথে যুক্ত হল নতুন নতুন রিলিজ হওয়া হিন্দি গান কারণ সেইটা ছিল তখনকার উড়তি বয়সের ছেলেদের হিটলিস্ট। সারাদিন প্রসাদ বিতরণের দায়িত্ব থাকত আমাদের উপর; আর সন্ধ্যায় পূজা মন্ডপে মন্ডপে আরতি দেখতে বেড়িয়ে পরতাম, বন্ধুদের সাথে ঘুরে এসে নিজেদের মন্দিরে আরতি করতাম সবাই মিলে। যদিও আমি ভালো আরতি করতে পারতাম না, কিন্তু সবার সাথে তাল মিলিয়ে চালিয়ে নিতাম।

বিজ্ঞাপন

পূজার সময় বাবা-মায়ের জন্য খুব কষ্ট হতো, সময় মতো ভাত খাওয়ানো কারন আমাকে শুধু খাবার খাওয়ার জন্য খোঁজা হতো, কেন জানি মায়ের পূজার দিনগুলোতে খিদে থাকতো না বেশি। বিশেষ করে পূজার ছুটিতে সুতপা পিশি, অর্পনা পিশি, সুর্পনা, টুক্কু পিশিরা যখন গ্রামের বাড়িতে পূজা উপলক্ষে বাড়িতে তখন পূজার আনন্দ দিগুণ বেড়ে যেত। প্রতিটা পূজা রাতে চলত আমাদের ঘরোয়া আড্ডা আর দুষ্টুমি। এসব করতে করতেই কিভাবে যে দশমী চলে আসত বুঝতেই পারতাম না। দশমীর পূজা শেষে জীবিকার তাগিদে সবাই চলে যেত যার যার গন্তব্যে। দশমীতে মাকে দুঃখভারাক্রান্ত মনে বিদায় দেওয়া আর মায়ের কাছে একটাই চাওয়া, সবাই যেন ভালো থাকে। আমার বাবা মায়ের দুই চোখ ভরে যেত অশ্রুতে। বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শুরু হয়ে যেত রং এবং সিঁদুর লাগানোর ধুম। মাকে সিঁদুর লাগিয়ে তারা একে অপরকে সিঁদুর লাগিয়ে দিতেন, তারপর চলে আসত সেই কষ্টের মুহূর্ত মায়ের বিসর্জন। এই দশমী তিথি বিজয়াদশমী নামে খ্যাত। মায়ের বিসর্জনের পর গুরুজনদের প্রণাম করার ধুম পড়ে যেত। প্রনাম করলেই পাওয়া যেত টাকা, টাকা পাওয়ার লোভে প্রনাম করার পরিমানটা বেড়ে যেত। পিশি-পিশামশয়দের কাছ সবসময় একটু বেশি টাকা পেতাম।

সময় আসলেই অনেক দ্রুত বদলে যাচ্ছে, মাঝে মধ্যে মনে হয় এই তো সেই দিন পূজাতে আরতি করেছি; কিন্তু কয়েক বছর হয়ে গেল মায়ের চরণে অঞ্জলি দিতে পারছি না। আজ শুধু দূরে বসে স্মৃতিচারণে পুরোনো দিনের অনেকটুকু উত্তাপ অনুভব করে থাকি। যদিও অনেক দূরের অতীত এখনও হয়নি, কিন্তু আগের সেই মানুষগুলো আজ অনেক দূরে চলে গেছে, সবাই আজ আমরা যার যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, কিন্তু আমার মনের মন্দিরের স্মৃতিগুলো সেই রকম অতীত হয়ে যাচ্ছে যা স্মৃতির মানসপটে ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে বিস্মৃতপ্রায় হতে চলেছে। সেইদিন আমার অর্ধাঙ্গিনী বারবার করে বলছিল, পারলে তোমার সুপারভাইজারকে বলে এক সপ্তাহের জন্য চলে আসো না। মনে মনে তখন বললাম আমারও কি মন কম চায় সবাইকে সাথে নিয়ে পূজা করি। নিজের হারানো শৈশবকে একঝলক দেখলাম আজ আবার, আজ আমার অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়; তাই মন চাইলেও ফিরে যেতে পারছি না শৈশবের সেই আনন্দময় দিনগুলোতে, আমার প্রিয় পরিবার এবং আমার সেই প্রিয় কটিয়াদি বণিক পাড়ার মা সংঘের পূজা মন্ডপে।

বর্তমান পৃথিবীতে শুভ-অশুভর যুদ্ধ চলছে প্রতিনিয়ত, কার চেয়ে বেশি কে ক্ষমতাবান হবে, কার কত টাকা হবে এই নিয়ে যুদ্ধ চলছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু আমরা কেউ একবারের জন্যও ভেবে দেখি না, সাধনার মহাযুদ্ধে জয়ী হতে পারলেই মানুষ মহাশক্তি দুর্গার সন্ধান পেয়ে থাকেন। সাধনার দশম স্তরে উন্নীত হতে পারলেই পরমবিদ্যা মহাশক্তির নাগাল পাওয়া যায়। মানুষের এ স্তরে আসতে পারলেই অপরাজিত হন অন্তরাত্মার যুদ্ধে। এ যেন দশমীর মহাদশা যা মানুষ কখনও ভুলতে পারে না। আসুন সবাই মিলে হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে মায়ের নামে সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়জিত রাখি, কারণ এই টাকাপয়সা, পেশী শক্তির ক্ষমতা আজ আছে তো কাল নেই; জগতে এমন কিছু করে যাওয়া উচিত যার জন্য অনন্ত কাল সবাই আপনাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে, মন থেকে ভালোবাসবে।

সকলকে আবারও শারদীয় শুভেচ্ছা।

শারদীয় দুর্গাপূজা ২০২৩