মীর মশাররফ হোসেনের ‘সঙ্গীত লহরী’: নতুন পাঠ
২৭ নভেম্বর ২০১৭ ১২:০১ | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৭ ১২:১২
তপন বাগচী
কলকাতার ‘ভারতমিহির’ যন্ত্রে ছাপা হলেও মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৭৪-১৯১১) ‘সঙ্গীত লহরী’ ১ম খ- বেরিয়েছিল কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া থেকে, ১৮৮৭ সালে। এর আগে ১৮৮১ সালে একই নামে কলকাতা আরেকটি গ্রন্থ বেরিয়েছিল কুমার মহেন্দ্রলাল খান (১৮৪৩-১৮৯৯) রচিত। কাছাকাছি সময়ে নওয়াব ফয়জুননেছা চৌধুরাণীও (১৮৩৪-১৯০৩) একই নামে গ্রন্থ রচনা করেন। মশাররফের গানের বইয়ের নামকরণের ক্ষেত্রে তাঁর পূর্বসূরী দুই লেখকের পূর্বপ্রকাশিত বইয়ের প্রভাব থাকতে পারে বলে এই তথ্যটুকু উল্লেখ করা যায়।
মশারফের গদ্যকার পরিচয় বেশি উচ্চকিত হলেও পদ্যকার পরিচয় একেবারে কম গুরুত্বের নয়। তাঁর ‘গোরাই ব্রীজ অথবা গৌরী সেতু’ (১৮৭৩) কাব্যকে সমালোচকরা উচ্চমূল্য দিতে কুণ্ঠিত হলেও মীর মশাররফের রচনা বলে তার ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কেউ অস্বীকার করেননি। তবে ‘সঙ্গীত-লহরী’কে অনেকেই পদ্যগ্রন্থ হিসেবে গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সাহিত্য-সাধক চরিতমালা’য় মশাররফ-জীবনীতে এই গ্রন্থের প্রকাশতথ্যের পাশাপাশি রচনা-নিদর্শন হিসেবে ‘আর বাঁচি না প্রাণ সই রে’, ‘রবে না দিন চিরদিন, সুদিন কুদিন’, ‘চল মন স্টেশনে টিকেট কিনে একবার তারে দেখে আসি’, ‘ওরে ভারত জাগ জাগ দিন যে গেল’ এই চারটি গান তুলে ধরেছেন। ব্রজেন্দ্রনাথের বিবেচনায় এই গ্রন্থের এই চারটি গান গুরুত্ব পেয়েছে।
‘সঙ্গীত লহরী’ গ্রন্থটি দীর্ঘদিন দুষ্প্রাপ্য ছিল। মশারফ-রচনাবলীতে থাকলেও পৃথক গ্রন্থ মশাররফ-গবেষণার শ্রেষ্ঠ পুরুষ প্রফেসর আবুল আহসান চৌধুরীর সম্পাদনায় এটি ১৯৭৬ সালে কুষ্টিয়ার গণলোক প্রকাশনীর পক্ষে প্রকাশ করেন নাট্যকার কল্যাণ মিত্র। ‘সঙ্গীত লহরী’ এই কপিটি সম্পাদক পেয়েছিলেন এম. আশরাফুল হক সাহেবের সৌজন্যে। আবুল আহসান চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের আবাসিক ছাত্র। এই গ্রন্থে প্রকাশের ব্যাপারে তিনি সৈয়দ মুর্তাজা আলী, আলী আহমদ, শামসুজ্জামান খান, কায়সুল হক প্রমুখের উৎসাহ-সহযোগিতা পেয়েছেন। কিন্তু ছাত্রবয়সেই যে তিনি সম্পাদনার পক্ব হাত নিয়ে মাঠে নেমেছেন এই গ্রন্থ দেখলেই তা বোঝা যায়। ১৮ পৃষ্ঠার ভূমিকা রচনাই তো বড় এক গবেষণার কাজ। এই গ্রন্থের কেবল পরিচয় প্রদান নয়, যোগ্য সম্পাদক হিসেবে তিনি আরও যে সকল দায়িত্ব পালন করেছেন, তা হল :
১. মুদ্রণ প্রমাদ চিহ্নিত করে শুদ্ধ পাঠ নির্ণয়
২. অন্যের নামে চালানো গানকে মীরের বলে প্রমাণ করা
৩. একই গান একাধিকবার ছাপার দোষ অপনোদন
৪. এক গানের খণ্ডাংশ অন্য গানে যুক্ত হওয়ার ত্রুটিবিচ্যুতি খুঁজে বের করে মূল পাঠ নির্ণয়
৫. মীরের অন্য গ্রন্থে প্রাপ্য গান সংগ্রহ করে এই গ্রন্থে পরিশিষ্টে তা সংযুক্ত করা
৬. গানের শ্রেণী-বিন্যাসকরণ
৭. গানের বিষয় ও ভাব বিশ্লেষণ
৮. কাঙাল হরিনাথ কিংবা রাজা রামমোহনের গানের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ
৯. প্রথম সংস্করণের মূল আখ্যানপত্র উদ্ধার ও মুদ্রণের মাধ্যমে দলিলীকারণ
১০. সঙ্গীত লহরী গ্রন্থের বিজ্ঞাপন উদ্ধার ও মুদ্রণের মাধ্যমে দলিলীকারণ
১১. গানগুলো বিশ্লেষণ করে তথ্যবহুল এক ভূমিকা রচনা
গ্রন্থ সম্পাদনার একটি প্রামাণ্য নিদর্শন হতে পারে আবুল আহসান চৌধুরীর এই কাজটি। পরবর্তীকালে তিনি এই ধারায় আরও কাজ করেছেন, অনেক দুষ্প্রাপ্য ও অগ্রন্থিত দলিল উদ্ধার করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের নতুন নতুন উপকরণ প্রস্তুত করেছেন। তার এইসব কাজ এখনো যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে বলে মনে হয় না। কাজের গুরুত্ব বিবেচনা করলে আবুল আহসান চৌধুরী অবমূল্যায়নের শিকার বলেই আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। আমরা সেই বিবেচনায় যাব না এখন।
‘সঙ্গীত লহরী’র প্রতিটি গানে রাগ, রাগিণী ও তাল নির্দেশ করা আছে। এ থেকে বোঝা যায় যে গানগুলো সুরারোপিত হয়েছে এবং গীত হয়েছে। আর সংগীত বিষয়ে যে মশারফরের অধিকার ও প্রজ্ঞা জন্মেছিল এই ভাবে রাগ-তাল নির্দেশনাই তার প্রমাণবহ। এই গ্রন্থের মাধ্যমে মশাররফকে কেবল গীতিকার হিসেবে মূল্য দিয়ে আমরা দায়িত্ব শেষ করতে চাই না। মশাররফ পুরোদস্তুও এক সংগীতজ্ঞ, এই ঘোষণা দিতে আমার অকুণ্ঠ হতে পারি।
বসন্তবাহার রাগিণী আর আড়া তালে রচিত প্রথম গানটি ‘ফুটিল বসন্ত ফুল, মোহন কাননে’ পাঠ করে অক্ষরবৃত্তের নিখুঁত চাল আবিষ্কার করতে পারি। অন্ত্যানা-প্রাসের কোনো বিচ্যুত নেই। অর্থাৎ কবিতার ছন্দ-মাত্রা-মিল জাতীয় কলাকৌশল তাঁর আয়ত্তে ছিল। কোথাও অর্ধমিল কিংবা একমাত্রার দুর্বল মিল দেওয়ার ‘অপচেষ্টা’ও তিনি করেননি, তাঁর সময়ের গানে এই ধরনের দুর্বলতা-শিথিলতা দুর্নিরীক্ষ্য নয়। কিন্তু মশাররফ তা থেকে ব্যতিক্রম। তিনি সব গানে যে এমন কলাকৌশল বজায় রাখতে পেরেছেন, তা হয়তো নয়। কিন্তু তিনি যে জানতেন এসব প্রকরণ, তার প্রমাণ মেলে প্রথম গানেই। ৮+৬/৪+৪ ধারায় অক্ষরবৃত্তে কবিতা আছে কিন্তু গানের দেখা মেলা ভার। মশাররফ সেই ক্ষেত্রেও মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। একটু উদাহরণ না দিয়ে পারা যাচ্ছে না-
‘ফুটিল বসন্ত ফুল, মোহন কাননে (সই)
দহিছে বিরহী প্রাণ, বিচ্ছেদ দহনে॥
পিকবঁধূ শাখী পরে
কুহরে পঞ্চম স্বরে
শুনে প্রাণ হুহু করে
বিয়োগী মরে জীবনে॥’
কবিতা হিসেবে এটি সার্থক। তবে, হ্যাঁ, এর স্বাভাবিক উচ্চারণ হিসাব করে একটি ভিন্নপাঠও তৈরি করা যায়-
‘ফুটিল বসন্ত ফুল, মোহন কাননে (সই)‘ফুটিল বসন্ত ফুল, মোহন কাননে (সই)দহিছে বিরহী প্রাণ, বিচ্ছেদ দহনে॥
পিকবঁধূ শাখী পরেকুহরে পঞ্চম স্বরেশুনে প্রাণ হুহু করে বিয়োগী মরে জীবনে॥’কবিতা হিসেবে এটি সার্থক। তবে, হ্যাঁ, এর স্বাভাবিক উচ্চারণ হিসাব করে একটি ভিন্নপাঠও তৈরি করা যায়-
রমণী যতনে বিধি সযতনে
নিরজনে গড়িয়াছে।
তাই যত ধনী, হয়ে অভিমানী
মানের গুমানে এত বাড়িয়েছে॥
এই পর্যন্ত পাঠ করলে সবাই একে ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত হিসেবে মনে করবে এবং আমার মূর্খতাকে আবিষ্কার করে তৃপ্ত হবে। কিন্তু পরের অন্তরায় যখন পড়বেনÑ
মুনিঋষি রত, যে শিব সাধনে
তিনিও আশ্রিত, রমণী চরণে
ব্রজে কোলে সোনা, নিকুঞ্জ কাননে
রমণীর পায় পড়িয়াছে॥
তখন বুঝবেন যে এটি শেষতক অক্ষরবৃত্তই। ‘আশ্রিত’ এবং ‘নিকুঞ্জ’ মাত্রাবৃত্তে ৪ মাত্রার মূল্য পায়। আর তাতে মাত্রাসমতা রক্ষিত হয় না। কিন্তু অক্ষরবৃত্ত হিসাব করলে পুরো গানটিই মাত্রাসমতা ধারণ করে। ছন্দ বিবেচনায় মশাররফ এতটাই দক্ষ ছিলেন যে অক্ষরবৃত্তের গায়ে ৬ মাত্রা ছাড়িয়ে দিয়েছেন। এই প্রশংসা তো কবি মশাররফের জন্য। কিন্তু গীত¯্রষ্ট মশাররফ যেভাবে শব্দ দুটি প্রয়োগ করেছেন, তাতে যথাস্থানে তার উচ্চারণ মৃদু হয়। ‘আশ্রিত’ আর ‘নিকুঞ্জ’কে সুরে গাওয়ার সময়ে একমাত্রা শুষে নেওয়া যায়। মশাররফের কৃতিত্ব এখানেই যে, তাঁর বাণী কবিতা এবং গান হিসেবে যুগপৎ সমান উপযোগী।
সুরট রাগিণীতে কাওয়ালী তালে তিনি যে বিচ্ছেদী গান রচনা করেছেন ‘তুমি দেখা দিয়ে রাখ মোর প্রাণ/ যায় যায় যায় প্রাণ।/ সহে না সহে না আর তব অদর্শন বাণ॥’, তা-ও দেখছি অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। তবে জনান্তিকে বলে রাখা যায় যে, ‘প্রাণো’, ‘যায়ও’ এ রকম সুরেলা উচ্চারণে স্বরবৃত্তের চালও গ্রহণ করে। বড় অদ্ভুত ব্যাপার!
আমরা জানি যে, বাউল গান ও বিচ্ছেদী গান যাঁরা রচনা করেন, তাঁরা স্বসুরেই পরিবেশন করেন। সুরের প্রতি তাঁদের যতটা মাত্রাজ্ঞান থাকে, গায়কীর প্রতি যতটা দরদ থাকে, কাব্যছন্দ নিয়ে তাঁদের ততটা চুলচেরা বিশ্লেষণী জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। তাই হয়তো আমরা বিখ্যাত মহাজনী পদের ছন্দবিশ্লেষণ করতে গিয়ে খেই হারাতে পারি। কিন্তু মীর মশাররফকে ব্যক্তিক্রম মনে হচ্ছে। তাঁর গানের বাণীর সাথে রবীন্দ্রনাথের বাণীর শুদ্ধতার তুলনা করা যেতে পারে। তবে তিনি তো কাব্যসাধনা অগ্রাধিকার দেন নি, তাই হয়তো সব-সময় টানটান ঋজুতায় ধরে রাখতে পারেনি এই ছন্দের সংহতি। কিন্তু যেটুকু দেখিয়েছেন এই গ্রন্থে, তাতেই তাঁর কবিত্ব শক্তি এবং সংগীত-প্রকরণ-ঋদ্ধি অনুমান করে বিস্ময় মানি!
যে বাণী পড়তে ছন্দচ্যুত মনে হয়, তাতে ভাল সুর বসার সুযোগ থাকে না। আমরা যেহেতু মশাররফের গানের বাণী কানে শুনততে পাইনি, তাই পাঠের ভেতর থেকেই তাঁর গীতসুধা আহরণ করতে চাই। এই কারণেই আলোচনার শুরতে এই ছন্দবিশ্লেষণ করতে মন সায় দিলেও আর আপত্তি করিনি। আমরা দেখছি কেবল অক্ষরবৃত্ত নয়, অন্যান্য ছন্দেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন।
এবার স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা একটা গানের কবিতার উদাহরণ দিতে চাই। মশাররফ স্বাভাবিক উচ্চারণকে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন-
(তুমি) কোন গুণেতে/ গুণমণি/ কর অভি/মান ৪+৪+৪+১(তুমি) কোন গুণেতে/ গুণমণি/ কর অভি/মান ৪+৪+৪+১সুন্দরী কি/ নাইকো ভবে/ তোমারই স/মান॥ ৪+৪+৪+১
বনের(ও)/ মাখাল ফল(ও) ৩+৪জলের(ও)/ কমল দল(ও) ৩+৪এ দু’য়ের/ কোনটি ভাল ৩+৪বল ওরে/ প্রাণ॥ ৪+১
কোকিলের/ কুহু স্বরে ৩+৪কেন প্রাণ/ আকুল করে ৩+৪কাকের রবে/ মাথা ধরে ৩+৪পাতা যায় না/ কান॥ ৪+১
দু’টি অন্তরাতেই পরপর তিন চরণে অন্ত্যানুপ্রাস রয়েছে। এটা ত্রিপদীর ঢং। শেষের অন্তরায় যেমন স্বরে/করে/ধরে অনুপ্রাস, তেমনি প্রথম অন্তরায় ভাল যেহেতু ও-কারান্ত উচ্চারণে ‘ভালো’ তাই ফল/দল এর উচ্চারণও ও-কারান্ত দাবি করে। আর তখনই মাত্রাসমতা রক্ষিত হয়। একইবাবে বনের/জলের শব্দদ্বয়ও ও-কারান্ত উচ্চারণ চলে আসে। এভাবেই সুরের উপযোগ বিবেচনা করে মশাররফ যে কবিতা রচনা করেছেন, তা হয়ে উঠেছে ‘সঙ্গীত লহরী’।
সম্পাদকীয় ভূমিকায় গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী বলেছেন,
‘সঙ্গীত লহরী-তে মীর মশাররফ হোসেনের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে তাঁকে কবি বা গীতিকার না বলে পদ্যকার বললেই ভাল হয়। মীর নিষ্ঠাবান কবিকর্মী ছিলেন না। গদ্যই ছিল তাঁর বিচরণের স্বচ্ছন্দ ও যথার্থ ক্ষেত্র। তাঁর কোনো কাব্যগ্রন্থেই তাঁর কবিতাপ্রতিভার উল্লেখযোগ্য পরিচয় পাওয়া যায় না। বিষয়বস্তু, ভাষা ও প্রকাশভঙ্গীর দিক দিয়ে মীরের কাব্য বৈচিত্র্যহীন ও গতানুগতিক। যুগচেতনার সঙ্গে তার যথার্থ পরিচয় ও সংযুক্তি ছিল না। তবে মীর মশাররফের অন্যঅন্য পদ্যরচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে ‘সঙ্গীত লহরী’র একটি স্বতন্ত্র মূল্য আবিষ্কার করা যায়। ধর্মীয় গ-িবদ্ধতা থেকে এটি মুক্ত। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচিত গানগুলির মধ্যে কিছুটা বৈচিত্র্যের স্বাদ পাওয়া যায়। মীরের পদ্যরচনার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই ‘সঙ্গীত লহরী’।
আমরা এই মন্তব্যে পূর্ণ সমর্থন জানাতে পারছি না বলে দুঃখ প্রকাশ করতে পারি। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছন্দোস্বাচ্ছন্দ্যই কবিপ্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র’ সূত্রানুযায়ী মশাররফকে কবি বলতে এবং এই গ্রন্থকে কাব্য বলতে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়, কারণ আমরা দেখতে পেয়েছি সাংগীতিক কিছু শিথিলতা সত্ত্বেও মশাররফ ছন্দের বিচারে মশাররফ উত্তীর্ণ। আমাদের বিবেচনায় গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন তাঁর সময়ের বিবেচনায় একজন বড় কবিও বটে!
আবুল আহসান চৌধুরীর কাছ থেকেই আমরা জানি যে, মশাররফের ‘সংগীতপ্রিয় পিতা একজন বিশিষ্ট বাজনাদার ছিলেন।’ (আবুল আহসান চৌধুরী, মীর মশাররফ হোসেন : সাহিত্যকর্ম ও সমাজ চিন্তা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃ. ৩৩৭)।
আমরা তাঁর কাছ থেকেই আরও জানি যে মীর-বঁধূ বিবি কুলসুম গান ভালবাসতেন। গ্রামোফোনে গান শুনতেন তিনি। গান শুনে তাঁর চোখে জল ঝরত। গবেষক ধারণা করছেন যে মীরের গান রচনার পশ্চাতে বিবি কুলসুমের সংগীতপ্রীতির প্রভাব থাকতে পারে। মশাররফেরও অভ্যাস ছিল গান করার। তিনি লিখেছেন, ‘গান বাজনা শনিতে আমার স্বভাবজাত বাসনা। গানবাজনার আওয়াজ শুনিলেই মন নাচিয়া ওঠে। সে স্থানে উড়িয়ো যাইতে ইচ্ছে হয়। যৌবনের অঙ্কুরে, বয়সদোষে নূপুর অথবা জোড়ামলে ঝনঝনী, মতিচুরের কনকনি শনিলেই দুই কান পাতিয়া শুনিতে ইচ্ছা করে। সে আওয়াজ আমার কানে যেন মধুমিষ্টি সহিত মিশ্রীর শিরে ঢালিয়ে দেয়।’ (পাক্ষিক, হিতকরী, উদ্ধৃতি, আবুল আহসান চৌধুরী, প্রাগুক্ত পৃ. ১৪৩) মশাররফের সংগীতপ্রীতি যে তাঁকে দিয়ে গান লিখিয়ে ছেড়েছে, তা সহজেই অনুমেয়।
মশাররফের গানগুলোকে আবুল আহসান চৌধুরীর নিজ বিবেচনায় ছয় ভাগে ভাগ করেছেন। তা এ রকমÑ
১. প্রেম-বিরহমূলক গীতিগুচ্ছ
২. স্বাদেশিকতায় প্রোজ্জ্বল জাতীয় উদ্দীপনামূলক সংগীত
৩. হাস্যরসাত্মক, রঙ্গব্যঙ্গমূলক গীতিগুচ্ছ
৪. রাজপ্রীতিজাত প্রশস্তিগীতি
৫. আধ্যাত্মভাবসমৃদ্ধ বাউলগান
৬. মিশ্রভাবের গান
আবুল আহসান চৌধুরীর এই বিভাজনই গ্রহণ করেছেন ডক্টর সেলিম জাহাঙ্গীর। শুধু ৫ নম্বর আর ৬ নম্বর নাম দুটি আগুপিছু করেছেন। কিন্তু সংগীতের শ্রেণীকরণ যেহেতু মৌলিক কাজ, সেহেতু এখানে উদ্ধৃতি দেওয়ার দরকার ছিল। না হলে পাঠক মনে করতে পারে যে এটি বুঝি সেলিম জাহাঙ্গীরের কৃতিত্ব। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত আবুল আহসান চৌধুরীর এই বক্তব্য ১৯৯৩ সালে উদ্ধৃতি ব্যতিরেকে প্রচার করলে ভুল বোঝার অবকাশ তৈরি হতেই পারে। কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত আবুল আহসান চৌধুরীর সম্পাদিত গ্রন্থটি পাঠকের নজর এড়িয়ে যেতে পারে। দু’টি বই হাতে নিয়ে বুঝতে পারি সে সেলিম জাহাঙ্গীরের পিএইচডি অভিসন্দর্ভে বর্ণিত শ্রেণীবিন্যাস আসলে আবুল আহসান চৌধুরীর করা। স্বীকৃতি ছাড়াই তা ব্যবহার করেছেন সেলিম জাহাঙ্গীর। মশাররফের গান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘এর মধ্যে প্রেম-বিরহমূলক গীতিগুচ্ছের সংখ্যাই অধিক। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ গানই এই জাতীয়।’ (সেলিমা জাহাঙ্গীর, মীর মশাররফ হোসেন: জীবন ও সাহিত্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ. ২২২)। এই হিসাব দিয়েছেন আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর সম্পাদিত ‘সঙ্গীত লহরী’ গ্রন্থের ভূমিকা-য় (গণলোক প্রকাশনী, কুষ্টিয়া, ১৯৭৬, পৃ. এগার)। এখানেই সেলিম জাহাঙ্গীর নিয়েছেন আবুল আহসান চৌধুরীর গ্রন্থ থেকে কোনোরূপ ঋণস্বীকার ছাড়াই।
সেলিম জাহাঙ্গীর আরো লিখেছে, ‘এর অধিকাংশই বিরহজনিত হাহাকারে পূর্ণ’ (সেলিম জাহাঙ্গীর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২২)। ‘মীরের বাউল জাতীয় গানগুলিই সঙ্গীত লহরীর শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী সম্পদ। অধ্যাত্মভাবে সমৃদ্ধ ১৫টি বাউল গান এতে সংকলতি হয়েছে। বাউলভাবের এই গানগুলি অনবদ্য ও শিল্পসুষমাম-িত।’ (সেলিম জাহাঙ্গীর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩১) এ রকম বাক্য হুবহু রয়েছে আবুল আহসানের ‘সঙ্গীত লহরী’ গ্রন্থে (পৃ. ষোল ও সতের)। বলা যেতে পারে আবুল আহসান চৌধুরীর ভূমিকার বক্তব্যই সেলিম জাহাঙ্গীর এমনভাবে ব্যবহার করেছেন, যাতে তার নিজের বলে মনে হয়। কিন্তু গবেষণার ক্ষেত্রে তো এমনটি হওয়ার কথা নয়। স্বীকৃতি না দিলে তো এক সময় ধরা পড়ে যায়। দুটি গ্রন্থ পাশাপাশি পড়তে গিয়ে আমার এই কথাগুলো মনে হল। সেলিম জাহাঙ্গীরের গ্রন্থটি আমি আগে পড়েছি, পত্রিকায় আলোচনাও করেছি, কিন্তু তখন আবুল আহসান চৌধুরীর গ্রন্থটি হাতের কাছে ছিল না বলে এই দোষ আমার চোখে পড়েনি। এখন চোখে পড়ায় একজন অনুজ লেখক হিসেবে আমি তো লজ্জা পাচ্ছি।
‘সংগীত লহরী’ নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা (কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলী, চতুর্থ খ-, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ. ১৬৫-১৫৭) লিখেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। তুলনামূলক আলোচনা করে তিনি সমকালীন মুসলিম গীতিকারদের চেয়ে মীরের শ্রেষ্ঠত্বের সন্ধান করেছেন। তিনি অকপটে বলেছেন,
‘একথা নিশ্চয়ই বলা যায় যে, মোটের উপর ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সংগীতের চেয়ে মীর মশাররফের সংগীত অবশ্যই উচ্চ ধরনের। মোজাম্মেল হক (বা বুলবুলে বাংলা)-র সম্বন্ধেও একথা খাটে। তবু উদ্ধৃত গানগুলোর মধ্যেও কোনকোনটি খাপছাড়া বা অস্পষ্ট লাগে (নং ১১, ৫৯)। তবে কতকগুলো যে বেশ ভালোÑ তাও স্বীকার করতে হবে।’
এরপর তিনি হিন্দু ও মুসলিম রচিত বাংলা গানের মধ্যেও তুলনা করে মীরের বিশিষ্টতা নির্দেশ করেছেন। কাজী মোতাহার হোসেনের মূল্যায়নে আমরা মীর মশাররফ হোসেনের সংগীতপ্রতিভাকে চিনে নিতে পারি। মীরের গান তবু আলোচনার বাইরে থাকার কারণ হল এগুলো অগীত থেকে যাওয়া।
আমরা মীরের গানের প্রসঙ্গে আসি। তাঁর ‘মরি দুর্বল প্রজার পরে অত্যাচার’ গানটি প্রজাপীড়নে বিরুদ্ধে চমৎকার এক প্রতিবাদী গান। এটি জমিদার দর্পণে ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে এই গ্রন্থে স্থান পায়। অধ্যাত্মভাবের গান ‘রবে না দিন চিরদিন, সুদিন কুদিন একদিন দিনের সন্ধ্যা হবে’ গানটি কাঙাল হরিনাথের মনে করা হলেও এটি যে মশারফের রচনা, আবুল আহসান তা নিশ্চিত করেছেন। এটি একটি উৎকৃষ্ট গান। ওই গানে ‘হলে সব লীলা সাঙ্গ, সোনার অঙ্গ, ধূলায় গড়াগড়ি যাবে’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীচৈতন্যের ভাবান্দোলনের কথা মনে পড়ে যায়। মশারররফ তো বৃহত্তর অর্থে সেই নদীয়ারই সন্তান! চেতনাগতভাবে শ্রীচৈতন্যের উত্তরাধিকার বললেও কি ভুল বলা হয়! ‘সঙ্গীত লহরী’র বেশ কিছু গানে বৈষ্ণব ভাববান্দোলনের প্রভাব পাওয়া যেতে পারে। জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে-ওঠা মুসলিম সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের একটি গান এখানে উল্লেখ করা যায়Ñ
‘মিছে ভাই জাতের বিচার, আচার ব্যাভার,
মিছে রে এই দুনিয়াদারী॥
***
দেখ কৃষ্ণ, বিষ্ণু, মুসা, ইসা
নানক, নিতাই জটাধারী
আরে ভাই অন্নপূর্ণ বিবি ফাতেমা
মোহাম্মদ পয়দা তারি॥
এই গানটি বিশ্লেষণ করে বোঝাতে হয় না যে মশাররফ কতটা পরধর্মমতসহিষ্ণুতা অর্জন করেছিলেন। মীরের আসল পরিচয় লুকিয়ে আছে এই গানে। মশাররফের বাউলগানগুলো সত্যিই অসাধারণ। কয়েকটি গানের উল্লেখ করা যায়-
১. ভোলা মন, ঘোলায় পড়ে,সুপথ ছেড়ে করলে এ কি কারখানা
২. কেনে আর মিছে ঘোর, ভেবে মরপরের বোঝা মাথায় করে॥
৩. চল মন স্টেশনে, টিকেট কিনেএকবকার তারে দেখে আসি॥
৪. এ ভবের ভাব দেখি ভাই চমৎকার
৫. তারি লীলে বুঝে ওঠা ভার॥
মীর মশাররফের গানগুলো পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, উল্লিখিত রাগ ও তাল ধরে আবার এগুলোকে কণ্ঠে ধারণ করা যেতে পারে। আজকে বাউল গানের জনপ্রিয়তকার সুযোগ যেখানে লালনের নামে জাল-গান তৈরি করা হচ্ছে, প্রতিবছর গানের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে, সেখানে কাঙালি হরিনাথ এবং মীর মশাররফের গানগুলো আমাদের সংগীতক্ষেত্রকে নতনুরূপে উজ্জীবিত করতে পারে। ‘সঙ্গীত লহরী’ বাংলা সংগীতের জগতেই অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
তপন বাগচী : কবি-গীতিকার। উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা