Saturday 13 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা
যে উপন্যাস প্রেম, স্বাধীনতা ও বাস্তববোধের অনন্ত সংলাপ

আজহার মাহমুদ
১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:৩৬

বাংলা সাহিত্যের প্রেমধর্মী উপন্যাসগুলোর ধারায় এক অভিনব সৃষ্টিকর্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা। যেখানে প্রেমকে পরিণতি নয়, বরং একটি উপলব্ধি, একটি বোধে রূপান্তরিত করে চিত্রিত করা হয়েছে। এই উপন্যাসটি প্রথম পাঠে মনে হয়, অমিত ও লাবণ্যকে ঘিরে একটি রোমান্টিক প্রেমকাহিনি রচিত হচ্ছে, কিন্তু পাঠ যত এগোয়, দেখা যায় গল্পের বাহ্যিক প্রেমই আসল নয়, আসল হলো প্রেমকে উপলব্ধি করার দৃষ্টিভঙ্গি, স্বাধীনতার মূল্যবোধ, এবং মানুষের মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্মরূপ। এ উপন্যাসে প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, কাব্যিক ছন্দময়তার পাশাপাশি হাস্যরসও আছে।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অমিত রায় এমন এক মানুষ, যিনি স্বাধীন চিন্তার শক্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। তার দৃষ্টিতে প্রেম কোনো বাঁধাধরা নিয়মে চলতে পারে না। প্রেমকে তিনি দেখেন নন্দনবোধ, বুদ্ধিবৃত্তি ও আত্মতৃপ্তির আলোকে। তার কথায়, হাসিতে, সংলাপে একদিকে যেমন ইংরেজি সাহিত্যচেতনার প্রভাব, তেমনি বাঙালি অভিজাত বুদ্ধিজীবীদের প্রতি তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গও পাওয়া যায়। অমিতের এই মুক্তমনই লাবণ্যকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে। কিন্তু একই সঙ্গে লাবণ্য উপলব্ধি করেন, অমিতের এই উচ্ছৃঙ্খল স্বাধীনতা জীবনের বাস্তব পথে তাকে স্থির করে রাখবে না।

বিজ্ঞাপন

লাবণ্য চরিত্রটি শেষের কবিতার সবচেয়ে পরিণত ও সংযমী অংশ। তিনি প্রেমকে গভীরভাবে অনুভব করেন। কিন্তু প্রেমকে আবেগের অতলে নিমজ্জিত হতে দেন না। তিনি জানেন প্রেমের আনন্দ যেমন আছে, তেমনি এর পৃথিবীব্যাপী বাস্তবতারও গুরুত্ব রয়েছে। প্রেমের কাছে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে তিনি নারাজ। তাই তিনি বুঝে ওঠেন, অমিতের সঙ্গে তার প্রেম সত্য হলেও, তা সংসারের বাস্তবতায় টিকবে না। এই উপলব্ধির জায়গাটি রবীন্দ্রনাথ চমৎকারভাবে আঁকেন। প্রেমকে তিনি এখানে কোনো ব্যর্থ রূপ দেননি, বরং এটিকে চরিত্রের পরিণতি হিসেবে দেখিয়েছেন। প্রেমের গভীরতা তাদের জীবনের দু’জনকে আরও সুন্দর করে তোলে, যদিও তারা একসঙ্গে চলতে পারে না।

অমিত ও লাবণ্যের এই দূরত্বের মধ্যেই উপন্যাসের দার্শনিক শক্তি। সাধারণ প্রেমের কাহিনি মিলনে শেষ হয়। রবীন্দ্রনাথ বরং দেখালেন, বিচ্ছেদও প্রেমের একটি সূক্ষ্ম রূপ হতে পারে। মিলন সবসময় শ্রেষ্ঠ নয়, কখনো বিচ্ছেদই সত্যিকারের উপলব্ধির জন্ম দেয়। দুই মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসলেও, তাদের ব্যক্তিত্ব ও জীবনের গতি আলাদা হতে পারে। আর সেই ভিন্নতার প্রতি যত্নশীল হওয়াই প্রেমের পরিপক্বতা।

উপন্যাসের পরবর্তী অংশে কেতকীর সঙ্গে অমিতের সম্পর্ক এই দর্শনকেই অন্য দৃষ্টিতে প্রমাণ করে। এখানে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, জীবনে সবকিছু নন্দনতত্ত্ব দিয়ে মাপা যায় না। মানুষ যখন সংসার, পরিবার, দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন অধিক বাস্তববোধ জরুরি হয়ে ওঠে। কেতকী সেই বাস্তবতার প্রতীক। অমিত তার কাছে খুঁজে পান এক পৃথিবীমুখী দৃঢ়তা, যা লাবণ্যর ক্ষেত্রে ছিল না। ফলে উপন্যাসটি দুটি ভিন্ন নারীর ভিন্ন জীবনদর্শনকে মুখোমুখি দাঁড় করায়, এবং তাতেই এর গভীরতা তৈরি হয়।

শেষের কবিতার ভাষা নিজেই একটি স্বতন্ত্র শিল্প। রবীন্দ্রনাথ এখানে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ এবং মৃদু রসিকতা ব্যবহার করেছেন, যা পুরো উপন্যাসকে অত্যন্ত প্রাণবন্ত করে তোলে। অমিতের সংলাপ যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতায় ভরা, তেমনি লাবণ্যের কথায় রয়েছে এক গভীর উপলব্ধি। ভাষার এই প্রবাহমান সৌন্দর্য পাঠককে কখনো দার্শনিক মননে ডুবিয়ে দেয়, কখনো আবার হাস্যরসের হালকা ছোঁয়ায় আরাম দেয়।

শেষের কবিতায় বিশেষ কিছু লাইন হৃদয়কে দারুণ স্পর্শ করে। যেমন- পুরুষ আধিপত্য ছেড়ে দিলেই মেয়ে আধিপত্য শুরু করবে। দুর্বলের আধিপত্য অতি ভয়ংকর। যে পক্ষের দখলে শিকল আছে সে শিকল দিয়েই পাখিকে বাঁধে, অর্থাৎ জোর দিয়ে। শিকল নেই যার সে বাঁধে আফিম খাইয়ে, অর্থাৎ মায়া দিয়ে। শিকলওয়ালা বাঁধে বটে কিন্তু ভোলায় না, আফিমওয়ালী বাঁধেও বটে ভোলায়ও। মেয়েদের কৌটো আফিমে ভরা, প্রকৃতি-শয়তানী তার জোগান দেয়। পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোক পাওয়া যায়, তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না। মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া, এই দুইয়ের তফাৎ আছে। যা আমার ভাল লাগে তাই আর একজনের ভাল লাগে না, এই নিয়েই পৃথিবীতে যত রক্তপাত। ভালোবাসায় ট্রাজেডি সেখানেই ঘটে যেখানে পরস্পরকে স্বতন্ত্র জেনে মানুষ সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি।

সবশেষে, উপন্যাসের নাম শেষের কবিতা হলেও এর ‘শেষ’ কোনো শেষ নয়। বরং এটি এমন এক উপলব্ধির দরজা খুলে দেয়, যেখানে প্রেমকে পাওয়া ও হারানোর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকে নতুনভাবে চিনে নেয়। প্রেমের অর্থ শুধু এক হওয়ার আকাক্সক্ষায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং কখনো আলাদা হতে শেখাতেও প্রেম সাহায্য করে। অমিত ও লাবণ্য দুজনেই প্রেমে পরাজিত হয়নি, বরং তারা প্রেমকে উপলব্ধির উচ্চতায় উন্নীত করেছে।

এইভাবেই শেষের কবিতা প্রেমকে বইয়ের পাতায় স্থির করে রাখে না, প্রেমকে মানুষের স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা ও স্বতন্ত্র সত্তার সঙ্গে মিলিয়ে এক অনন্য মানবিক অভিজ্ঞতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। তাই এটি কেবল একটি প্রেমের উপন্যাস নয়, এটি প্রেমের উপলব্ধি নিয়ে লেখা একটি দার্শনিক গ্রন্থ- যেখানে প্রেম মিলনের নয়, পরিপূর্ণতার পথ খুঁজে পায় বিচ্ছেদের মধ্যেই।

লেখক: সাংবাদিকতা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর