ভ্রমণ নিয়ে ভাবনার কিছু কথা
১৪ জুলাই ২০২৪ ১৭:৩৮
প্রথম পর্ব
ইউরোপ সবার মনকে আন্দোলিত করে কারণ আমরা যারাই কোন না কোন প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, যেকোনো ভাবেই ইউরোপের পরিচয় পর্ব এসেছে, প্রায় সকলেরই মনে ইউরোপের এক স্বপ্নীল চিত্র অঙ্কিত আছে। তাই ইউরোপ দেখার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা কাজ করে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন হলেও তাদের অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য ও শহর বৈচিত্র্যে কোথাও একটা মিল পরিলক্ষিত হয়। তবে, এবার গ্রীসে এসে সেই বৈচিত্রময় মেলবন্ধনের সন্ধান করতে গিয়ে একটু আলাদা অনুভূতির সঞ্চার হয়েছে তার আলোকেই আমি ভূমিকাতে বলতে চাই যে , আমাদের দেশে যারা শিল্পকলা, নগর পরিকল্পনাসহ স্থপতিবিদ্যা তথা পুরোকৌশল, সমাজবিজ্ঞান ও প্রত্নতত্ত্বতে আগ্রহী অর্থাৎ যারা সৃজনশীল এবং সমাজের ও নগরের বিকাশ সাধনে পরিবর্তন, পরিবর্ধন নিয়ে পরিকল্পনা করে ও চর্চা করে, তাদের গ্রীস তথা এথেন্সে একটি শিক্ষা সফরের সুযোগ তৈরী কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেখানে ভাবনার সুযোগ রয়েছে। গ্রীসের অতীত হতে বর্তমানকালে চলমান জীবনের ও সমাজের সঙ্গে তাদের শহরের সম্পর্কের পর্যায়ক্রমে যে পরিবর্তন তা পরখের চেষ্টা ও ভিন্ন ভিন্ন দর্শনে অবুভব করা জরুরী। এথেন্সে যেয়ে এটা আমার মনে হয়েছে কারণ আমাদেরও নাগরিক জীবনের ইতিহাস অনেক পুরাতন যা আমরা জানি কিন্তু যেহেতু এর পূর্ণাঙ্গ কোনো চিত্র নেই, তাই হয়তো, আমাদের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নগরের তথা দেশের পরিবর্তনের বা বিবর্তনের পথে প্রধান অন্তরায় আমরা নিজেরাই; কারণ, যে চিত্র আমাদের সঠিক সিদ্ধান্তের পথ দেখাবে তা যদি অস্পষ্ট হয় সেক্ষেত্রে আমরা স্বভাবতই কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তাই সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো চিত্রকে অনুশীলন করে আমরাও শিখতে পারি কি না যে আমাদের নগরের চিত্র কেমন হওয়া উচিত ছিল বা সে দিকে আদৌ অগ্রসর হওয়া সম্ভব কিনা যাতে আমাদের নগর জীবন পরিবেশ বান্ধব ও দীর্ঘায়ু সম্পন্ন হতে পারে। এটি কার্যে পরিণত হয়তো কষ্টসাধ্য ও সময়ের ব্যাপার কিন্তু এখনই আমাদের এটি উপলব্ধি অতন্তঃ জরুরী যা ছাত্র অবস্থায় আমার অনুধাবনের সুযোগ হয়নি। এক্ষেত্রে, হতে পারে আমাদের শিক্ষালয়ের পদ্ধতিগত কোথাও অথবা পাঠদানের বিষয়বস্তু নির্বাচনে ক্রুটি ছিল; হতে পারে, ছাত্র শিক্ষক নির্বাচনের পদ্ধতিগত সমস্যা; আবার হতে পারে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। ছাত্রাবস্থায়, আমাদের শিক্ষকরা ফ্রান্সের কথা বলেছেন; তাদের অনেকে ফ্রান্স, ইতালী ও স্পেনে ঘুরে এসে অনেক গল্প বলেছেন কিন্তু গ্রীসের কথা শুনিনি। তাই যখন সুযোগ পেয়েছি, ল্যুভ দেখতে ছুটে গিয়েছি, গ্রীসের কথা মনে আসে নাই! প্রকৃতপক্ষে, শিল্পের মহিমাকে অনুভব করতে ও শিল্পের পরিবর্তনের ধারাকে বুঝতে ইউরোপের দেশসমূহসহ পৃথিবীর অনেক দেশে যাওয়া প্রয়োজন। এ ব্যপারে বাংলাদেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক উদার ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। এথেন্সের বিভিন্ন প্রান্তে ও বিভিন্ন মিউজিয়ামে বিভিন্ন দেশের ছাত্র/ছাত্রীদের সমারোহ দেখে মনে হয়েছে যে আমার এ সফর অনেক তাৎপর্যপূর্ণ হতো যদি আমি ছাত্রাবস্থায় এথেন্সে যাওয়ার সুযোগ পেতাম।
আমার গ্রীস ভ্রমণ কোথা থেকে শুরু করবো যেখানে আলোচনাটা তাৎপর্যবহ হবে, তা বিচার করতে গিয়ে পর্যটক হিসাবে অজানা জায়গায় ঘুড়ে বেড়ানোর প্রেক্ষিতে আমার অনুসন্ধিৎসু সরল দৃষ্টিনির্ভর অনুভূতিকে তুলে ধরছি।
এথেন্সে পৌঁছে গাড়িতে বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যেতে, এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় বা এক গলি থেকে অন্য গলিতে যেন time warp এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার হোটেলটি ছিল আক্রোপলিসের অনতিদূরে একটি এলাকাতে যা ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপটে আবাসিক পাড়া-মহল্লা বলা যেতে পারে। যদিও আমরা অনেকে জানি, তথাপি উল্লেখযোগ্য যে ইউরোপের পুরনো শহরগুলো গঠন বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের শহরগুলোর মতো mixed-zone হিসাবে দেখা যায়, অর্থাৎ, আবাসিক এলাকা, দোকান-পাট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বাজার সবই একই জায়গায় বা কাছাকাছি অবস্থান করে। হোটেলটি এমন জায়গায় নিতে পেরেছিলাম যে হেঁটে হেঁটে এথেন্সের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো দেখে নেয়া সম্ভব। অনেক হেঁটেছি, ঘুড়তে ঘুড়তে যেটা মনে হয়েছে— এই নগরবাসী কখনোই তাদের বুনিয়াদ শিক্ষা, শিল্প, দর্শণ ও সমাজ ব্যবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়নি বরং সময়ের সাথে প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন পরিবর্তনকে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে যা অগ্রগতির সহায়ক। বহুযুগের দখলদারিত্ব ও ঔপেনিবেশিকতার প্রভাব হয়তো বস্তুগতভাবে জীবনে প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু সেগুলোকে সঙ্গে নিয়েই এথেন্সবাসী তাদের বৈচিত্রময় জীবনকে ধারবাহিকভাবে নির্বাহ করে এসেছে যেখানে স্বতন্ত্রতার পরিচয় লক্ষ্য করা যায় এবং এটাই আমার অক্ষিপটে এথেন্সের মূল প্রতিবিম্ব। এখন এই প্রতিবিম্বের স্বরূপ এবং আমাদের জন্য এই স্বরূপ এর গুরুত্ব কোথায়, এই বিষয়গুলো আমাকে ভাবিয়েছে যা আমি আমার অনেকটা নিপাট মনস্চক্ষে দৃশ্যমান panorama-এর মতো করে উপস্থাপনার চেষ্টা করবো।
সকালে প্রাত:রাশের উদ্দেশ্যে কোন cafeé এর সন্ধানে হাঁটছি ,তবে হাঁটার দিক নির্ধারণ করেছি হোটেল থেকে বেরহয়ে দূরে দৃশ্যমান পার্থেননের সারিবদ্ধ স্তম্ভগুলোকে লক্ষ্য রেখে। স্তম্ভগুলোকে constellation এর মতো ব্যবহার করেছিলাম যে শহরের কোথায় আছি বা মূল গন্তব্য থেকে কত দূরে। শহরের বিভিন্ন কোণ বা এলাকার বহুদূর থেকে উঁচুতে স্তম্ভগুলো দৃশ্যমান এবং সুউচ্চ ইমারতগুলো সহজে দর্শনীয় স্থানগুলোকে আড়াল করে ফেলেনা। এতে মনে হয়েছে, অতীত হতে এখনও শহর-পরিকল্পনায় যুগে যুগে বৈচিত্রের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিষয়ের গুরুত্ব হয়তো আজো বিদ্যমান। হোটেল থেকে হেঁটে যেতে যেতে, কয়েকটি বাসা অতিক্রম করে দেখলাম, একটি বাসার সম্মুখ ভাগের আঙ্গিনার শানবাঁধানো স্থানের বেশ কিছু অংশ কাঁচ দিয়ে আবৃত কিন্তু কাঁচের উপরিভাগের ধুলোয় জুতোর ছাপ আর মোটর-সাইকেলের চাকার দাগ দেখে বুঝলাম এগুলো tempered-glass। সেই কাঁচের নীচে কিছু পাথুরে জায়গা এবং পাথরের দেয়াল সদৃশ দেখা যাচ্ছিলো; যেতে যেতে আবার রাস্তার ফুটপাতে পায়ের নীচে তেমনি কাঁচে আবৃত প্রাচীন দেয়াল চোখে পড়লো; কিছুদূর পর দেখলাম দুটো বাসার মাঝে ফাঁকা জায়গায় উঁচু পাথরের দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ যা খুবই পরিচ্ছন্ন ; বিষয়টা চোখে পড়ল কারণ এথেন্সে এসে আবাসিক এলাকাতে আমি দুই বাসার মাঝে কোনো ফাঁকা জায়গা দেখিনাই এবং এরকম দেখেছি ঢাকার মোহাম্মদপুরের কিছু কিছু এলাকাতে। একই সরু ফুটপাত দিয়ে আমার মত পর্যটকরা, ছাত্র/ছাত্রী, কর্মজীবী মানুষ সকলে সাচ্ছন্দে যাচ্ছে, কেউ আবার বিভিন্ন ধরনের গাড়ি বা মোটর সাইকেলে পাশ দিয়ে রাস্তায়। সকালের নাস্তা সেরে দেখি দূরের পার্থেনন অনেকটা কাছে চলে এসেছে। আবার পার্থেননের উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে , যেহেতু প্রথমবার, তাই কিছুটা ঘুরানো পথে যেয়ে অ্যাক্রোপলিসে চলে এসেছি যা পার্থেননের পাদদেশে অবস্থিত। অ্যাক্রোপলিস( high city) অর্থ দাঁড়ায় অনেকটা, ‘শহরের প্রাণ কেন্দ্র’। এখানে পাওয়া গিয়েছে classical age এর অনেক নিদর্শন যা আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও ব্যবহার্য সামগ্রী থেকে বোঝা গিয়েছিল যে সেসময়ের শহরের অভিজাত বাড়িগুলো এই জায়গাতে ছিল। এখানে প্রাচীন কালে ঘটে যাওয়া আক্রমণ ও ধ্বংসের ছাপ রয়েছে; এ বিষয়ে জানার অনেক অবকাশ রয়েছে যা এখানে প্রাধান্য পায়নি। এখানে দূর থেকে যা চোখে পড়ে তা অ্যাক্রোপলিসের মিউজিয়াম। মিউজিয়ামটি গড়ে উঠেছে অ্যাক্রোপলিসে পাওয়া ধ্বংসাবশের উপর। যতটা বিস্ময়কর ছিলো অ্যাক্রোপলিসে পাওয়া কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন নিদর্শন যাতে ফুটে উঠেছে সেই সময়ের জীবন বৈচিত্র, রীতিনীতি এবং বিলাসী ও সাধারণ সমাজের চিত্র; তেমনি বিস্ময়কর ছিল বর্তমান যুগে এমন একটি মিউজিয়ামের পরিকল্পনা। উল্লেখযোগ্য যে এই অধুনিক মিউজিয়ামের লাগোয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে পুরাতন একটি ইমারত (Weiler Building), ১৮৩৬ সালে আর্মি হসপিটাল হিসাবে তৈরী হয়েছিল, যা না ভেঙে আধুনিক Museum এর দফতর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে যার বর্তমান নাম Museum Of The Center For Acropolis Studies । আধুনিক এই museum এর চত্বরে ঢুকে মূল দালানে প্রবেশের পথ কাঁচের তৈরী, যাতে করে নীচে অবস্থিত বিষয়বস্তু প্রত্যক্ষ করা যায়। দূর হতে, museum ভবনের বাহ্যিক গঠনের উপরিভাগে দৃশ্যমান গ্রীক শ্বেত-স্তম্ভের আদলে তৈরী প্রতীয়মান হলেও খুব কাছে গেলে বোঝা যায় প্রকৃতপক্ষে ওগুলো চকচকে রূপালী প্রলেপের ধাতব প্যানেল দিয়ে তৈরী oval-shape এর দেয়াল সদৃশ যা কৌণিক দৃষ্টিতে গ্রীক-স্তম্ভের ন্যায় প্রতীয়মান হয়। museum এর প্রধান ফটকের দিকে সেই কাঁচের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা যায় নিচে দৃশ্যমান হাজার বছরের পুরাতন নিদর্শন, যেমন, ছাদ বিহীন দ্বিতল বিশিষ্ট বাসভবন ও তার বিভিন্ন কামড়া, রন্ধনশালা, স্নানাগার, কূপ, জলের আধার, স্নানাগার থেকে বের হয়ে গিয়েছে মাটির তৈরী পাইপ, বিভিন্ন তৈজসপত্র( যেগুলো যেখানে রাখা হয়েছিল সেখানে রাখা আছে), ইত্যাদি; প্রাচীন বাসাগুলোর সামনে যে রাস্তা ছিলো সেখানে পাতা রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মাটির তৈরী পাইপ যা দেখে মনে হয়েছে যে ছোট বেলাতে দেখেছি ঢাকার অলি-গলিতে রাস্তা খুঁড়লে এমন করে পাতা থাকত ধাতুর অথবা কংক্রিটের পাইপ। সেই প্রাচীনের কাছে যেয়ে আরও অনুধাবন যোগ্য করার জন্য, পুরো সভ্যতার উপর দিয়ে বিভিন্ন elevation এ হাঁটার মতো flyover সদৃশ করা হয়েছে যেন অমূল্য classical সভ্যতার এই লীলাভূমিকে কোন রকম বিচলিত না করে বহু কাছে থেকে অবলোকন করা যায়। এ ছিল এক অসাধারণ time warp এর মতো!
লেখক: ঢাকা ইউনিভার্সিটির চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে বি.এফ.এ সম্পন্ন করেছেন। পরবর্তীতে University of California থেকে community development-এ উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের পর জিওগ্রাফিতে PhD সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে, মানুষের সঙ্গে নগরের স্থান কেন্দ্রিক নাগরিক সমাজের যে সম্পর্ক সেই বিষয়ে গবেষণা করছেন।
সারাবাংলা/এসবিডিই
জাহেদুস সাদাত রিজেল বেড়ানো ভ্রমণ নিয়ে ভাবনার কিছু কথা লাইফস্টাইল