Sunday 29 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বন্ধু চল…

আজাহারুল ইসলাম
২ অক্টোবর ২০২২ ১৮:০৩ | আপডেট: ২ অক্টোবর ২০২২ ১৮:০৭

পরীক্ষা শেষ। কয়েকদিন ক্লাস ছুটি। মন গেয়ে উঠলো রবীন্দ্রনাথের ছুটি কবিতার একটি লাইন ‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি।’ ছুটি পেয়ে কয়েকজন বন্ধু বাড়িও ফিরেছে। স্বল্প ছুটি আর বেশি দূরত্বের কারণে আর বাড়ি ফেরা হয়নি। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে দিতে বন্ধু ফাহাদ বললো, ‘বন্ধু চল আশপাশের কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে স্থান নির্বাচন হলো ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার কিছু দর্শনীয় স্থান। সেদিন রাতে প্রাথমিক সম্মতি দিলেও দোটানায় ছিলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফাহাদকে ক্ষুদেবার্তায় জানালাম, ‘সবাইরে কল দে, ঘুরে আসি।’ যেই কথা সেই কাজ। বন্ধু মামুনের টিউশনি থাকায় সে আগেই ঝিনাইদহ শহরের দিকে গেল। আর আমরা ফাহাদ, তরঙ্গ আর তিনজন জুনিয়র রিয়াদ, ইমরান, রুবায়েত সহ মোট ছয়জন ১১টার দিকে বেড়িয়ে পড়লাম ঝিনাইদহের দিকে।

বিজ্ঞাপন

শহরে পৌঁছানোর পর টিউশনি শেষে যুক্ত হলো মামুন। তাকে নিয়ে আমরা সাতজন রওনা হলাম এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহত বটগাছ দেখতে। কিছুক্ষণ বাসে যাওয়ার পর কালিগঞ্জ বাজারে পৌঁছে অটোরিকশা নিয়ে চললাম বিখ্যাত সেই স্মারক বটবৃক্ষ দেখতে। বøুটুথ স্পিকারে গানের তালে সর্পির সরু পাকা রাস্তা ধরে চলছিল অটোরিকশা। দুইদিকে দিগন্তজোড়া মাঠ, পুকুর, গাছপালার দৃশ্যও ছিল মনোরম। যেন নিপুন কোনো শিল্পীর হাতে গড়া। সেই সরু পথ একেবারে ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ থানার সুইতলা মল্লিকপুর গ্রামের বটগাছের কোলে এসে থেমেছে। নেমেই দেখা মিললো অ্যামেরিকা থেকে আসা কয়েকজন পর্যটকের। তবে তারা সূদুর থেকে আসলেও বাঙালি সংস্কৃতির পোশাক ধারণ করেছে দেখে ভালো লাগলো। বাচ্চারাও যেন ৮/১০টা বাঙ্গালি শিশুর মত ছিল দূরন্তপনা। গাছেল এ ডাল থেকে ও ডাল, এ জায়গা থেকে ও যায়গা ছুটছে।

বিজ্ঞাপন

জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটারের দূরত্ব। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এশিয়া এশিয়া মহাদেশের ‘সর্ববৃহৎ বটবৃক্ষ’। ১৯৮৪ সালে সর্ববৃহৎ তকমা জুড়ে দিয়েছে বিবিসি জরিপ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ পাহাড়। পুরো গাছটি এক দৃষ্টিতে আনা অসম্ভব। বন বিভাগ ও স্থানীয়দের ভাষ্য, জায়গাটি বহু আগে কুমার স¤প্রদায়ের বসতির জন্য বিখ্যাত ছিল। সেই সময় কুমার স¤প্রদায়ের লোকেরা পাতকুয়া ব্যবহার করতো, সেন বংশীয় কুমার পরিবারের কোনো একজনের পাত কুয়োর উপর একদিন একটি গাছ জন্মে। তা প্রায় ৩১৫ বছর আগের কথা। মূল গাছটি মারা গেলেও এটি ৪৫ এটি ভিন্ন ভিন্ন গাছে প্রায় ২ দশমিক ০৮ একর জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। যার উচ্চতা প্রায় আড়াইশ থেকে ৩শ ফুট। এর ৩৪৫টি বায়বীয় মূল মাটিতে প্রবেশ করেছে এবং ৩৮টি মূল ঝুলন্ত অবস্থায় বিদ্যমান।

বটগাছ শুধু বটগাছই নয়। আঁকাবাঁকা বিভিন্ন আকৃত্তির ডালপালা, বসার জন্য জায়গা, গোল ঘর, পাখির কলতান, দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনা এর সৌন্দর্যকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। চারপাশে বটগাছ, ছায়াঘেরা শীতল হাওয়া যে কারো মনে অন্যরকম প্রশান্তি জোগাবে। জার্নি করে যাওয়ার পর বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ বসলেই প্রশান্তির ঘুম চলে আসবে। ডানেবামে সামনে পেছনে যেদিকে তাকাবেন শুধুই বটগাছ। গাছটির প্রাকৃতিক কারুকার্যে যে কেউ বিমোহিত হতে বাধ্য। এছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটকদের ক্লিকে ক্লিকে তৈরি হয় অন্যরকম এক ফটো অ্যালবাম। আমারাও সেই অ্যালবাম তৈরি করতে ভুলে যাইনি।

কথিত আছে, একবার গাছ কাটতে গিয়ে কুদরত উল্লাহ নামের একজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। কুদরত উল্লাহর স্ত্রী গাছ ধরে কান্নাকাটি করে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনেন। প্রচলিত এই কথার জের ধরে মনের আশা পূরণের জন্যে অনেকে গাছের শাখা জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। তবে অযতœ আর অবহেলার কারণে কিছু ঝুরি পোকায় নষ্ট করে দিয়েছে। অনেক ডালপালাও ভেঙ্গে পরেছে। ঝড়ে উপড়ে গেছে অনেক ঝুরির শেকড়। এরই মধ্যে বেশ কথটি ঝুরির গাছ পৃথক হয়ে গেছে। ফলে গাছটি এখন আর এক নেই।

বটগাছ দেখা শেষ করে আবার যাত্রা শুরু করলাম কালিগঞ্জ উপজেলার বারো বাজারের গাজী-কালু-চম্পাবতির মাজারে। এটি ঝিনাইদহ শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার ও বারোবাজার থেকে মাত্র এক কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। সেখানে গিয়ে দেখি আরেক এলহী কান্ড। মাজারের গা ঘেঁষে আছে ৬টি ছোট বড় বটবৃক্ষ। মনের আশা পূরণ করতে সব ধর্মের অনেকেই গাছের সাথে সুতা, পলিথিন, প্লাস্টিক, কাগজসহ বিভিন্ন জিনিস বেঁধে রেখেছে।

ইতিহাসবেত্তাদের ভাষ্যমতে, বারোবাজারে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসা আধ্যাত্মিক সাধকের মধ্যে গাজী, কালু ও চম্পাবতী ছিলেন অন্যতম। বিরাট নগরের শাসক দরবেশ শাহ্‌ সিকান্দারের পুত্র বরখান গাজী ও কালু ছিলেন সিকান্দারের পালক পুত্র। গাজীর সাথে ছাপাইনগরের সামন্ত রাজা রামচন্দ্রের মেয়ে চম্পাবতীর প্রেমের সম্পর্কে নানা চড়াই উৎসাই পেরিয়ে বিয়ে হয়। পরবর্তীতে গাজী অনুসারীদের সাথে রাজা রামচন্দ্রের বহু যুদ্ধের পর গাজী চম্পাবতীকে উদ্ধার করে বারোবাজারে ফিরে আসেন এবং বারোবাজারে তারা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। শ্রীরাম রাজার বেড় দীঘির দক্ষিণ পাড়ের আট ফুট লম্বা তিনটি মাজারের মধ্যে মাঝেখানেরটি গাজীর, পশ্চিমের কালুর ও পূর্ব দিকের কবরটি চম্পাবতীর।

মাজারে হালকা বিরতি নিয়ে চললাম গোড়ার মসজিদের দিকে। এটিও বারোবাজারেই অবস্থিত। এটি পঞ্চদশ শতাব্দির রাজধানীখ্যাত শাহ মোহাম্মদাবাদে সুলতানী শানামলের স্থাপত্য শিল্পের অনন্য নিদর্শন। পূর্বদিকে রয়েছে পুকুর ও ওযু করার সুব্যস্থা। একটি বড় ও তিনটি ছোট গম্বুজ এবং বারান্দাসহ মসজিদটি বর্গাকৃতির। প্রতœতত্ত বিভাগ ১৯৮৩ সালে খননের পর গম্বুজের কেন্দ্রস্থল ২ ফুটের মত ভাঙ্গা দেখতে পান। একইসাথে মসজিদের পাশে একটি কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এটি গোরাই নামের এক দরবেশের মাজার বলে অনেকের ধারণা। তাঁর নামানুসারে এ মসজিদকে গোড়ার মসজিদ নামকরণ কয়। মসজিদে পাঁচ ফুট প্রশস্ত দেয়াল, পূর্বদিকে তিনটি প্রবেশদ্বার এবং উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালে দুইটি বড় ও দুইটি ছোট মোট চারটি প্রবেশ পথ এখন জানালা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পশ্চিমের দেয়ালে তিনটি মেহরাব আছে। পশ্চিম দেয়ালে ৭/৮ ফুট লম্বা দুইটি এবং উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালে দুইটি মোট চারটি কালো পাথরের স্তম্ভ আছে। মসজিদের দেয়ালে পোড়মাটির পত্র-পুষ্পে শোভিত শিকল, ঘন্টাসহ বিভিন্ন নকশা আছে। বাইরের দেয়াল পুরোটাই পোড়ামাটির কারুকার্যে অলংকৃত। যা দেখে অন্তরতৃষ্ণা আরো বহুগুনে বেড়ে গেছে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। সকলেই ক্ষুধার্ত। তবুও যেন ভ্রমণতৃষ্ণা মেটেনি। গেলাম আরেক দৃষ্টিনন্দন মসজিদে। যেটি কালীগঞ্জ উপজেলার বেলাট গ্রামে নির্মিত। তিনতলা বিশিষ্ট এ মসজিদটি দুই একর জমির ওপর ২০১৯ সালের শেষের দিকে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে উদ্বোধন করা হয়। প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেছে যশোরের আদ-দ্বীন ফাউন্ডেশন। মসজিদের তৃতীয় তলায় এতিমখানা ও হাফেজিয়া মাদরাসা রয়েছে।

মসজিদের রং করা হয়েছে আকাশের রঙে। সাদা ও হালকা আকাশি রঙের সংমিশ্রণে নির্মিত মসজিদটিতে রয়েছে আধুনিক দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ। মসজিদটির চারপাশের প্রাচীরেও রয়েছে ব্যতিক্রমী নকশা। মসজিদে ঢুকেই ডানে রয়েছে বিশাল গোরস্থান ও বামে রয়েছে বিভিন্ন ফুলের বাগান। নারী-পুরুষের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা মসজিদটিতে পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা ওযু ও নামাজের সুব্যবস্থা রয়েছে। বারোবাজারের পুরোনো ঐতিহ্যগুলোর পাশাপাশি এখানেও প্রতিনিয়ন আসছেন পর্যটকরা।

এদিকে ঢলে পরেছে সূর্য। সাথে বেজে উঠেছে ফেরার সুর। ফেরার পথে ঢুঁ মারলাম কালিগঞ্জের নলডাঙার মোবারকগঞ্জ চিনিকলে। ফটকে গার্ডদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম আঁখ উৎপাদনের সময় হয়নি তাই কল বন্ধ। হতাশ হয়ে কলের আশপাশের এলাকা ঘুরে রওনা হলাম পরবর্তী গন্তব্য কালিগঞ্জের দিকে। পুরো সময়টা জুরে আমরা সাত ছাড়াও অটোরিকশার চালক ছিল। তখন ঘড়িতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। কালিগঞ্জে ফিরে রওনা হলাম ঝিনাইদহের পথে। সেখানে নেমে খাওয়া সেরে ক্যাম্পাসের বাসে ফিরলাম ক্যাম্পাসে। সারাদিনের তীব্র ক্ষুধা আর তৃষ্ণা রেস্টুরেন্টে মিটিয়ে নিলেও ভ্রমণতৃষ্ণা মেটেনি। সারাটাদিন যেন একটি ঘোরের মধ্য দিয়ে গেছে। যা স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে। আবার কোনো এক ছুটিতে শোনার অপেক্ষায়, ‘বন্ধু চল……’

লেখক: শিক্ষার্থী

সারাবাংলা/এজেডএস

আজহারুল ইসলাম বন্ধু চল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর