চাইছি তোমার বন্ধুতা…
৪ আগস্ট ২০১৯ ০৯:২৬ | আপডেট: ২৩ মে ২০২২ ১৩:১৫
‘বন্ধু চল… রোদ্দুরে/মন কেমন… মাঠজুড়ে…/খেলবো আজ ওই ঘাসে/তোর টিমে তোর পাশে’– এই আহ্বান যাকে জানানো যায়, বন্ধু সেই। বন্ধু মানেই বিশেষ কেউ যার সঙ্গে বিশ্বাস আর ভালোবাসার অন্যরকম এক বন্ধন। প্রতি বছর আগস্টের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস।
শুরুটা যদিও হয়েছিল ব্যবসায়িক স্বার্থে কিন্তু ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী বন্ধু দিবস পালিত হতে শুরু করে বন্ধুত্বের নির্মল আবেদন উদযাপন করতে। বন্ধুত্বে নাই কোন ভেদাভেদ, নাই বয়সের ব্যবধান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বের ধরন বদলালেও বদলায় না আবেদন। মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্ব হতে পারে, হতে পারে প্রকৃতি, জড়বস্তু (বই) আর প্রাণীর সঙ্গেও।
বন্ধু মানেই তার সঙ্গে কারণে অকারণে কাটানো অনেকটা সময়। বিখ্যাত বাংলা গান কফি হাউজের সেই আড্ডা জমে ওঠে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে চায়ের দোকানে, ভাতের হোটেলে আর সবুজ ঘাসের মাঠে। শিক্ষা জীবন শেষে দূরে চলে যায় সেইসব মানুষেরাও। কারও কারও সঙ্গে সম্পর্কটা থেকে যায় আর কেউ কেউ হারিয়ে যায়। মান্না দের কন্ঠে বেজে চলে, ‘কতো স্বপ্নের রোদ ওঠে/এই কফি হাউজে/কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়/কতজন এলো গেল কতজনই আসবে/কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়’
বন্ধুত্বের রঙিন গল্পগুলো বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একেকটা প্রতিষ্ঠান কিংবা জায়গা। শিক্ষাজীবন শেষেও বন্ধুত্ব আসে আমাদের জীবনে। কর্মক্ষেত্রে যেয়েও আমাদের অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। বিভিন্ন গবেষণা বলছে কর্মক্ষেত্রে বন্ধু থাকলে কাজে আনন্দ পাওয়া যায়, সৃষ্টিশীলতা বাড়ে, কর্মক্ষমতা বাড়ে ও কাজের ক্ষেত্রে সুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়ে। ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে করা কিছু জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই বলেছেন, কাজের ক্ষেত্রে পরিচয় হওয়া বন্ধুরা তাদের অন্যান্য বন্ধুর বা স্বামী/স্ত্রীদের তুলনায় বেশি ভালোভাবে বুঝতে পারেন। তবে গবেষকরা কাজের জায়গায় বন্ধুত্বের ব্যপারে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেন যাতে কাজের কোন ক্ষতি না হয়। বিশেষত উচ্চ পদস্থ কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব সম পর্যায়ের অনেকের কাছেই পছন্দ নাও হতে পারে। তাই কর্মক্ষেত্রে বন্ধুত্ব হলেও সেটাকে যতটা সম্ভব কাজের থেকে দূরে রাখার পরামর্শই দিচ্ছেন তারা।
আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে একজন মানুষ একইসঙ্গে পাঁচজন ব্যক্তির সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলতে পারেন। পাঁচজনের একজন হতে পারেন বৈবাহিক জীবনের সঙ্গী। স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক শুধু তাদেরই নয় সুখি করে তাদের সন্তানসহ পরিবারের অন্যদেরও।
বন্ধুত্ব মানুষকে শুধু সুখিই বানায় না, দেয় দীর্ঘজীবনের নিশ্চয়তা। প্রয়োজনের সময় কথা বলার মত বন্ধু আছে যাদের, তারা তুলনামূলক কম দুশ্চিন্তা আর মানসিক চাপে ভোগে। বন্ধুবৎসল মানুষের নিজেকে রক্ষার ক্ষমতাও বেশি থাকে, বলছে বিভিন্ন গবেষণা।
১৯৯৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী রবিন ডানবার এক গবেষণায় দেখান যে একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে ১৫০ জন মানুষের সঙ্গে একই রকম সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিচিত মিলিয়ে কত মানুষকেই না আমরা বন্ধু ভাবি কিন্তু আসলে আমাদের একসঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে মাত্র দেড়শ জনের সঙ্গেই।
তবে বন্ধুত্ব রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তি মনে করাচ্ছে কোন বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনা কবে, কবে কোথায় গিয়েছেন বা কবে কার জন্মদিন। এভাবে বন্ধুত্বের পরিসীমা বাড়লেও আসলে কী এভাবে কারও সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে? অনেকেই তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই পোস্ট দিয়ে জানান তারা কতটা একা। আবার অনেকেই একজন বন্ধুর অভাবে জীবনের জটিল সময়ে সাহায্য না পেয়ে আত্মহত্যা করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার আগেও মানুষ আত্মহত্যা করত। কিন্তু হাজার হাজার বন্ধুর ভিড়েও একজন মানুষ নিজেকে একা ভেবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন যখন তখন বন্ধুত্বকে নতুন করে ভাবার সময় এসেই যায়। আবার এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই মানুষ খুঁজে পান হারিয়ে যাওয়া অনেক বন্ধুকে। এর মাধ্যমেই ভেঙে যায় দেশ-কালের ব্যবধান।
বন্ধুত্ব মানষকে ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে, বিষণ্ণতা কমিয়ে মানসিকভাবে সুস্থ ও সুন্দর রাখে। এটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে। ব্রিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক হল্ট-লানস্টেড বন্ধুত্বের সঙ্গে দীর্ঘজীবনের সম্পর্ক বিষয়ক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন বন্ধুহীন ব্যক্তিরা অনেক বেশি মোটা হয়ে যাওয়া, একাকীত্বে ভোগার মতো সমস্যা ভোগেন। এতে করে তাদের আয়ু কমে যায় বলে দাবি তার।
ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক জরিপ বলছে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আমাদের আরও বেশি মানবিক বানায়। শেখায় অন্যের প্রতি আরও বেশি সহানুভূতিশীল হতে। একজন বন্ধুকে চাইলেই বলা যায় মনের সব ইচ্ছা, সুখ আর দুঃখগাঁথা। তাকেই বলা যায়, আমি মেঘের দলে আছি/ঘাসের দলে আছি।।/তুমিও থাকো বন্ধু হে/বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো।
সারাবাংলা/আরডে