তিন’শ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী নয়াবাদ মসজিদ
২৪ আগস্ট ২০১৮ ০৯:৩৯ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৮ ১৪:১২
।। মাহিদুল ইসলাম রিপন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট।।
দিনাজপুর: দিনাজপুরের নয়াবাদ মসজিদ এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ঐতিহাসিক কান্তজিউ মন্দিরের পাশেই অবস্থিত নয়াবাদ মসজিদ। মসজিদটি দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার নয়াবাদ গ্রামে অবস্থিত। সুদূর পারস্য থেকে আগত কান্তজিউ মন্দিরের শিল্পীরাই নিজেদের প্রয়োজনে ইসলাম প্রচারের স্বার্থে এ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।
জানা গেছে, মহারাজা প্রাণনাথের শাসনামলে প্রায় তিন’শ বছর পূর্বে ১৭২২ সালে দিনাজপুর জেলার কান্তনগর গ্রামে একটি মন্দির নির্মাণে মধ্যপ্রাচ্য (সম্ভবত মিশর) থেকে একদল কারিগর আনা হয়। মন্দির নির্মাণে আসা সকল কারিগর ছিলেন ইসলাম ধর্মের ধর্মপ্রিয় মুসলিম। মন্দির নির্মাণ কাজ চলাকালীন নামাজের সময় মন্দির সংলগ্ন খোলা স্থানে নামাজ আদায় করতেন। বিষয়টি জানতে পেরে তৎকালীন মহারাজ কারিগরদের সর্দার (হেড মিস্ত্রি) নেওয়াজ অরফে কালুয়া মিস্ত্রিকে দরবারে ডাকেন। মহারাজা তাদের নামাজ ও থাকার জন্য মন্দির পাশবর্তী (প্রায় ১ কিলোমিটার) নয়াবাদ গ্রামে ১ দশমিক ১৫ বিঘা জমি দান করেন।মহারাজার নির্দেশে মন্দিরের পাশাপাশি নয়াবাদ গ্রামে নিজেদের থাকার বাড়ি ও নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ নির্মাণ কাজ চালিয়ে যায় মিস্ত্রিরা। এরই মধ্যে মহারাজা প্রাণনাথের মৃত্যু হয়। নির্মাণ কাজের তত্ত্বধানে দত্তক ছেলে মহারাজা রামনাথের আমলে ১৭১৫ সালে মন্দির কাজ সম্পর্ণ হয়। পাশাপাশি মসজিদ নির্মাণ কাজও শেষ হয়।
নির্মাণ কাজ শেষ হলে সকল মিস্ত্রি তাদের নিজ দেশে ফিরে গেলেও কালুয়া মিস্ত্রি ও তার ছোট ভাই স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য মহারাজার দরবারে গিয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষি জমি আবদার করলে পিতার দেওয়া জমিসহ আরো কৃষি জমি দান করেন মহারাজা রামনাথ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা দুই ভাই মহারাজার দানকৃত জমি চাষাবাদ করে জীবন কাটান। মৃত্যুর পর দুই ভাইয়ের কবর মসজিদ সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে কবর দেওয়া হয়। সে সময় গ্রামের নাম অনুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয় নয়াবাদ মসজিদ। বর্তমানে মন্দির ও মসজিদ নির্মাণের হেড মিস্ত্রি ও তার ছোট ভাইয়ের বংশধররা নয়াবাদ মিস্ত্রিপাড়ায় বসবাস করছে।
মসজিদের অবস্থান, দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের ঢেপা নদীর পশ্চিম কোল ঘেষে নয়াবাদ মিস্ত্রিপাড়া গ্রামে। ঐতিহাসিক এই নয়াবাদ মসজিদটি জেলা শহরের প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম কোণে ঢেপা নদীর পশ্চিম কোল ঘেষে অবস্থিত। এই মসজিদটি ১ দশমিক ১৫ বিঘা জমির প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিনে। মসজিদের উত্তর-দক্ষিণে একটি করে জানালা রয়েছে। দরজা-জানলার খিলান একাধিক খাঁজযুক্ত যার ভিতরে পশ্চিমাংশে আছে তিনটি মিহরাব। মাঝের মিহরাব তুলনায় দু’পাশের গুলো ছোট। মাঝের মিহরাবের উচ্চতা ২ দশমিক ৩০ মিটার ও প্রস্থ ১ দশমিক ৮ মিটার। মসজিদ জুড়ে আয়তাকার বহু পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। পোড়ামাটির নকশাগুলো বহু জায়গায় খুলে পড়েছে। ফলকগুলোর আয়তন দশমিক ৪০ মি. × দশমিক ৩০ মি.।
ফলকগুলোর মধ্যে লতাপাতা ও ফুলের নকশা রয়েছে। একটিতে জোড়া ময়ূরের প্রতিকৃতিও রয়েছে। এরূপ মোট ১০৪টি আয়তাকার ফলক রয়েছে। তবে ফলকের মধ্যে অলংকরণের অনেকটাই প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। আয়তাকার মসজিদটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট। এর চারকোণায় রয়েছে চারটি অষ্টভূজাকৃতির টাওয়ার। বাইরের দিক থেকে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৪৫ মিটার ও প্রস্থ ৫ দশমিক ৫ মিটার। দেয়ালের প্রশস্ততা ১ দশমিক ১০ মিটার। মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্বদিকে রয়েছে তিনটি খিলান। মাঝের খিলানের উচ্চতা ১ দশমিক ৯৫ মিটার, প্রস্থ ১ দশমিক ১৫ মিটার। পাশের খিলানদ্বয় সমমাপের এবং অপেক্ষাকৃত ছোট।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদের ধ্বংস অনেক অংশ সংস্কার করে চারপাশে দিয়েছে সীমানা প্রাচীর। মসজিদ এলাকায় পর্যটকদের বসার জন্য আসন, চলাচলের রাস্তা ও বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা করা হয়েছে। মসজিদ সংলগ্ন একটি মাদ্রাসা রয়েছে।
কালুয়া মিস্ত্রির বংশধর বর্তমান নয়াবাদ মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মওলানা আব্দুল মান্নান সারাবাংলাকে জানান, প্রায় তিন’শ বছর প্রাচীন এই মসজিদ দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এক নজর দখতে ছুটে আসে। ইতিহাসের সাক্ষি নয়াবাদ মসজিদ অত্র এলাকার প্রাচীনতম। ইতিমধ্যে মসজিদটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দেশ-বিদেশ জুড়ে এর বেশ পরিচিতি রয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসা পর্যটকরা ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আসেন। এখানে পর্যটকদের সার্বক্ষনিক নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন থাকে।
কিভাবে যাবেন– দিনাজপুর শহর থেকে খুবই কাছে। নয়াবাদ মসজিদে যাতায়াত করা খুবই সহজ। রাজধানী ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন ও বিমান যোগে যাতায়াত করা যায়।
থাকবেন ও খাবেন কোথায়? মসজিদ সংলগ্ন কান্ত নগর এলাকায় একটি সরকারি রেস্ট হাউজ ও পর্যটন মোটেলের একটি শাখা রয়েছে। এছাড়া দিনাজপুর শহরের বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক হোটেলগুলোতে থাকার সুব্যবস্থা রয়েছে। অত্র এলাকার আশপাশে ছোট-বড় বিভিন্ন মানের খাবার হোটেল রয়েছে।
সারাবাংলা/এমএইচ