বঙ্গ থেকে কঙ্গো
২৯ মে ২০২৩ ১৫:০৪ | আপডেট: ২৯ মে ২০২৩ ১৭:২৯
জুলাই। ২০০৪ সাল। আমি তখন চ্যানেল আইয়ে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। জুলাই মাসে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)-এ যেতে হলো বার দুয়েক। একবার পাসপোর্ট জমা দিতে, আরেকবার ব্রিফিংয়ে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন এবং মিশনে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ব্রিফ করলেন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ। ব্রিফিং শেষে যেতে হলো সম্মিলিত সামরিক হাসপালে (সিএমএইচ)। সেখানে গিয়ে রক্ত দিতে হলো কয়েকটি টেস্টের জন্য। সেদিনই জানলাম, ১২ জনের একটি মিডিয়া টিম যাবে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে।
কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশ ব্যাটেলিয়নের প্রথম দল ব্যানব্যাট-১ এক বছরের দায়িত্ব পালন শেষে দেশে ফিরবে। তাদের পরিবর্তে ব্যানব্যাট-২ যাবে দায়িত্ব নিতে। প্রথম গ্রুপটির সাথেই যাবে মিডিয়া টিম। মিডিয়া টিমে দলনেতা হিসেবে থাকবেন আইএসপিআর-এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নজরুল ইসলাম।
১২ সদস্যের টিমে সেনা সদস্য ছিলেন আরও দুইজন। এদের একজন এমআই-এর মেজর আনোয়ার (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল)। আরেকজন ডিজিএফআই-এর মেজর এমদাদ (বর্তমান অবস্থান জানা নেই)। সাংবাদিকদের মধ্যে আমি ছাড়াও ছিলেন চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র ক্যামেরাপারসন ফুয়াদ হোসেন রুবেল (বর্তমানে নাগরিক টিভিতে), বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বখতিয়ার রানা, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি’র বার্তা বিভাগের প্রযোজক মো. মঈনউদ্দিন চৌধুরী ও ক্যামেরাপারসন মোহাম্মদ রফিক, এটিএন বাংলার রিপোর্টার আরিফ হোসেন নিশির (বর্তমানে প্রিন্ট মিডিয়ায়), ক্যামেরাপারসন কামাল হোসেন এবং এনটিভি’র জহিরুল আলম ও ক্যামেরাপারসন তানভীর আহমেদ।
কঙ্গোর উদ্দেশে আমরা ঢাকা ত্যাগ করি ২ আগস্ট সকালে। সাথে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আকতার হোসেনসহ প্রায় চারশ’ জন সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ান। প্রায় পাঁচ ঘন্টার ভ্রমণ শেষে আমরা উগান্ডার এনতিবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছি। তখনই জানলাম, গৃহযুদ্ধের কারণে কঙ্গোতে কোন বিমানবন্দরেরই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই।
এনতিবি থেকে ৯০ জনের একেকটি দলে ভাগ হয়ে যেতে হবে কঙ্গোর বুনিয়া এয়ারপোর্টে। এনতিবি থেকে বুনিয়া যেতে সময় লাগে ৪০ মিনিট। এই বুনিয়া বিমানবন্দরের কর্তৃত্ব নিষ্ঠা ও যোগ্যতার সাথে পরিচালনা করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি চৌকষ দল। নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সহযোগিতা করেন সেনাবাহিনীর কয়েকজন জুনিয়র অফিসার। বিমানবন্দরের কাছেই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ঘাটি। খানিকটা দূরে বাংলাদেশের সেনা ক্যাম্প। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল নূরুস সামা।
দুই.
কঙ্গো সফরের শুরুর অভিজ্ঞতা অসাধারণ। ক্যাম্পের সবাই আমাদের আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন। অনেকদিন পর সশস্ত্রবাহিনীর বাইরে, কোন সিভিলিয়ানের সাথে দেখা হওয়ায় অফিসার থেকে শুরু করে জওয়ানরা পর্যন্ত… সবাই যেন নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা হয়েছে, এমন আন্তরিকতায় আমাদের বরণ করে নিলেন।
দুইদিন ছিলাম বুনিয়ায়। এই দুইদিন মূলত আমরা শিক্ষানবীশের ভূমিকায় ছিলাম। আমাদের জানানো হলো কঙ্গোর ইতিহাস, রাজনীতি সম্পর্কে। ধারণা দেয়া হলো চলমান যুদ্ধ সম্পর্কে। আমরা যে কয়েকদিন কঙ্গোতে থাকবো সে কয়েকদিনের কর্মসূচি সম্পর্কে জানানো হলো। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, আচমকা আসা বিপদে কিভাবে নিজেকে দলবদ্ধ রেখে বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হবে সে বিষয়ে। এই দুইদিন আমরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর আরও কিছু কাজ সম্পর্কে জানলাম। নিউজের জন্য ক্যাম্প সংশ্লিষ্ট কিছু রিপোর্টও তৈরি করলাম। সংগ্রহ কলাম সাক্ষাতকার ও ভিডিও ফুটেজ।
বুনিয়ায় দুইদিন থেকে গেলাম রাজধানী কিনশাসায়। মাঝে যাত্রাবিরতি কিসাঙ্গানিতে। কিনশাসায় গিয়ে উঠলাম ট্রানজিট ক্যাম্পের ডরমিটরীতে। সেখানে গিয়ে পেলাম সৈনিকজীবনের খানিকটা অভিজ্ঞতা। বিশাল একটি রুমে প্রায় দুইশ’ জনের থাকার ব্যবস্থা। আমরা যখন গেলাম, সেসময় অন্তত ২০টি দেশের সৈনিক ছিলেন সেখানে। কথা হলো অনেকের সাথে। আমরা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে প্রত্যেকেই শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন। বুঝলাম, আমাদের সশস্ত্রবাহিনী বাংলাদেশের যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে তার জন্যই আমরা এ শ্রদ্ধা ও বিনয়টুকু পেলাম।
পরের দুইদিন আমরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার সাক্ষাতকার গ্রহণ করলাম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নানা কার্যক্রমের দৃশ্য ধারণ করি। দ্বিতীয় দিন খুব কাছ থেকে যুদ্ধ দেখলাম। স্থানীয় তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের মুখোমুখি যুদ্ধ। আমরা অবশ্য দেড় থেকে দুই কিলোমিটার দূরে নিরাপদ আশ্রয়ে।
কিনশাসায় দুইদিন থেকে আবার ফিরি বুনিয়ায়। এরপর টানা ৮ দিন সেখানেই থাকি। বুনিয়া থেকেই আশপাশের এলাকায় গিয়েছি সংবাদ সংগ্রহের কাজে।
কঙ্গোতে তখন দায়িত্ব পালন করছিল ৪৯টি দেশের সেনাবাহিনী। কিন্তু জাতিসংঘ মিশনের যাদের সাথেই কথা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর প্রশংসা করেছেন অকুণ্ঠ চিত্তে। প্রথম দু’য়েকদিন মনে হয়েছিল… আমরা বাংলাদেশের মিডিয়া টিমের সদস্য বলে সৌজন্যতাবশত তারা হয়তো বাঙালি সেনাদের প্রশংসা করছেন। কিন্ত্র এ সংশয় বেশি সময় ছিল না। টের পেলাম, সত্যিকার অর্থেই আমাদের সেনাসদস্যরা কঙ্গোর সাধারণ মানুষেরও মন জয় করে নিয়েছে। অফিসিয়াল সাক্ষাতকারের পালা কমে এলে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলি। তখনই টের পাই, আমাদের সশস্ত্রবাহিনী দেশটির মানুষের মাঝে হিংসা আর যুদ্ধের পরিবর্তে ভালবাসার বীজ বপন করতে সক্ষম হয়েছে।
তিন.
বুনিয়াকে বেইজ করে আশপাশে কাজ করেছি সপ্তাহখানেক। দেখলাম, কঙ্গোর মানুষের কাছে বাঙালিদের পরিচয়- ‘রফিকী’… মানে বন্ধু। শুধু তা-ই নয়, স্থানীয় ভাষায় মারাবো অর্থ বাজার। তারা তাদের সেই এলাকার নাম রেখেছে ‘বাংলা মারাবো’- অর্থাৎ ‘বাংলা বাজার’।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিমের সদস্যরা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন জাতিগত দাঙ্গায় বিধ্বস্ত নয়াকুন্দে এলাকায়। বীড়া জাতির স্থানীয় গোত্র প্রধান জানালেন, চিকিৎসার অভাবে আগে যখন যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু ছিল নিত্যসঙ্গী- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম সেখানে কাজ শুরু করার পর মৃত্যু ভয়কে তারা জয় করেছেন। বাংলাদেশের মেডিকেল টিমের সদস্যরা তাদের কাছে যেন দেবদূত।
সাধারণ মানুষের ধারণা, এতো দেশের সেনাসদস্য না রেখে শুধু বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী কাজ করলে শান্তি প্রতিষ্ঠা পেতে লাগবে খুব বেশি হলে দুই বছর। তারা ধারণার পিছনে যুক্ত কি? এ উত্তর খুঁজতে কথা বলি নানা বয়সের অন্তত জনা বিশেক নারী পুরুষের সাথে। এদের মধ্যে ছিলেন লেন্দু, বীড়াসহ প্রধান ছয়টি জাতির মানুষ। তাদের কথা-
জাতিসংঘ বেশ কয়েকটি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে চ্যাপ্টার সেভেন-এর আওতায়। শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেসব দেশে যুদ্ধ করতেই হবে এমন কোন কথা নেই। আলোচনার মধ্য দিয়ে যদি শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়, তবে সেই পথে চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কঙ্গোর পরিস্থিতি ভিন্ন। সেখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় বেছে নিয়েছে চ্যাপ্টার সিক্স। ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় শক্তি প্রয়োগে বাঁধা নেই দেশটিতে। বিভিন্ন দেশের সেনা সদস্যরা এর সুযোগ নেয় অহরহ। বিনা কারণেই গুলি ছোড়ে আতঙ্কে থাকা সাধারণ মানুষের দিকেও। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি গোষ্ঠীর অনেক সদস্য যেমন গ্রেফতার বা আটক হওয়ার পর স্বীকার করেছে, কোন ধর্মীয় বা আদর্শিক কারণে তারা এ পথ বেছে নেয়নি। তারা আর্থিক দীনতার কারণে যোগ দিয়েছে এসব জঙ্গি সংগঠনে। মাত্র পাঁচশ’ টাকার বিনিময়ে নিয়েছে জীবনের ঝুঁকি, বোমা হামলা চালিয়েছে নিরীহ নাগরিকদের ওপর। হত্যা করেছে শিশু, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে এজলাসে দায়িত্ব পালনরত বিচারককেও। ঠিক তেমনি বিশ্বের দেশে দেশে মানুষের আর্থিক অস্বচ্ছলতাকে পুঁজি করে বিদ্রোহীরা তাদের লোক সংগ্রহ করে। এসব বিদ্রোহী মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিলে দু’বেলা খাবার পাওয়া যাবে- এমন আশাতেও অনেকে এসব বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে।
মারাবোতে মেজর মনিরের কাছে ভিডিও ফুটেজ দেখলাম। তাতে দেখা গেল, ৮/১০ বছরের শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে অস্ত্র বহনের কাজে। মিলিশিয়ারা ক্ষুধার্ত শিশুদের রুটির লোভ দেখিয়ে মাইলের পর মাইল অস্ত্র বহন করাচ্ছে। ফলে বাঙালি সেনা সদস্যরা যখন তাদের খাবারের অংশ ভাগ করে নেন নিরন্ন কঙ্গোলিজদের সাথে… তখন তারা আপ্লুত হয়, ভালোবেসে ফেলে ভীনদেশি মানুষগুলোকে। তাছাড়া, খাবারের বিনিময়ে বাংলাদেশি সেনা সদস্যদের দ্বারা তাদের শিকারও হতে হয় না যৌন নিপীড়নের; যেমনটি হতে হয় কোন কোন দেশের সেনা সদস্যদের দ্বারা।
এক রোববার গেলাম ব্যানব্যাট ক্যাম্পের কাছের গির্জায়। ফাদার জানালেন, কয়েক মাস আগে বাঙালি মুসলমান সৈনিকরা গির্জাটি নির্মাণ করে দিয়েছেন ধর্মপ্রাণ আফ্রিকান খ্রিস্টানদের জন্য।
বাঙালি সৈনিকদের প্রতি তার ভালোবাসার টান দেখলাম ঠিক দুই দিন আগে যেমনটা দেখেছি মসজিদের ইমামের মাঝে। শুক্রবারে জুমা নামাজ শেষে ইমাম জানিয়েছিলেন, মসজিদটি নির্মাণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। শুধু তাই নয়, তাদের নিরাপত্তার দিকটিও দেখছেন বাঙালি সেনারা।
চার.
এক বিকেলে গেলাম বুনিয়া বাজারে। সেদিন ছিল হাট বার। স্থানীয়রা আমাদের সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করলেন। অনেকেই বুকে জড়িয়ে ধরেছেন আমরা বাঙালি শুনে। কিছুক্ষণ পর চারদিকে হৈ-চৈ শুরু হলো। যে কোন মুহূর্তে গোলাগুলি শুরু হবে বলে মনে হলো।
আমরা ৯ জন সিভিলিয়ান, সংবাদকর্মী। আমাদের নিয়ে চিন্তিত হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুলসহ সব সেনা সদস্য। কারণও ছিল। আমরা ৩/৪ জন বিচ্ছিন্ন হয়ে বাজারে ঘুরছি আর স্যুভেনির কিনছিলাম নিশ্চিন্ত মনে। হট্টগোল শুরু হলে আমরা এগুনোর চেষ্টা করি আমাদের মূল দলের দিকে। কয়েকজন কঙ্গোলিজ আমাদের পথ আটকে দাঁড়ান। আমাদের ঘিরে রেখে তারা একটি দোকানের ভিতর নিয়ে যান। আমরা শঙ্কিত হই।
তারা ফ্রেঞ্চ, সোহালিজ, বাংলা আর ইংরেজির মিশেলে যোগ করে ইশারা ভাষা। তারা বললেন, বাঙালিদের তারা বন্ধু মনে করেন। কিন্তু ইউএন মিশনে থাকা কয়েকটি দেশের সৈনিকদের তারা শত্রু মনে করেন। বাইরে টার্কিশ আর মরোক্কান সাজোয়া যান। গোলাগুলি হতে পারে। সাধারণ নাগরিকরাও হাতের কাছে যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত। এ অবস্থায় আমাদের বাইরে থাকা ঠিক হবে না।
এদিকে, আমাদের সাথে থাকা ব্যানব্যাট-১’এর অপারেশনাল চিফ লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল (বেশ কয়েক বছর আগে অবসরে গেছেন বলে জেনেছি) ক্যাম্পে উত্তপ্ত পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, আমরা কয়েকজন বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছি। আমাদের উদ্ধারে যে কোন মুহূর্তে সাহায্য প্রয়োজন হতে পারে। বাংলাদেশ ক্যাম্প থেকে নির্ধারিত মাধ্যমে টার্কিশ আর মরোক্কানদের কাছে খবর পাঠানো হলো। বলা হলো, কোনভাবেই যেন ফায়ার ওপেন করা না হয়। তাহলে বাংলাদেশের মিডিয়া টিমের জীবন বিপন্ন হতে পারে।
এই যখন অবস্থা, তখন সদ্য পাওয়া বন্ধুরা আমাদের পৌঁছে দিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে। বাংলাদেশিদের প্রতি তাদের এ ভালোবাসা তিলতিল করে অর্জন করেছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। আমরা এক বছর পর গিয়ে তার ক্ষীরটুকু খেয়েছি।
বাঙালি আর বাংলাদেশের প্রতি তাদের এ ভালোবাসার মাত্রা সম্পর্কে বলতে গেলে অবশ্যই এক যুবকের কথা বলতে হবে। এখন আর তার নাম মনে নেই। সেই যুবক বেশ আবেগ দিয়ে আমাদের গেয়ে শুনিয়েছিলেন কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা ও সুর করা ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো…’ গানটি। নির্ভুল বাংলায় গানটি গেয়েছিলেন তিনি। বাংলা গান শেখার বিষয়ে তার আগ্রহ দেখে এটি তাকে শিখিয়েছিলেন বিমান বাহিনীর এক তরুণ অফিসার।
এই তরুণ অফিসারের কথাও বলতে হয়। সম্ভবত তার নাম ছিল শহীদ। সংস্কৃতিমনা এই অফিসারের ছিল নানান বয়সের এক ঝাঁক ছাত্র-ছাত্রী। তিনি এদের বাংলা শেখাতেন। শেখাতেন বাংলা কবিতা আর গান।
বুনিয়া এয়ারপোর্টে স্থানীয় কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রায় সবার গায়েই দেখেছি বাংলাদেশ লেখা টি-শার্ট। স্মর্তব্য, আমাদের বিমান বাহিনীর সদস্যরা মাঝে মধ্যেই স্থানীয়দের মাছে পোশাক বিতরণ করতেন।
আমাদের যে দো-ভাষী ছিলেন তিনি এক সময় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। গৃহযুদ্ধ তাকে কর্মহীন করেছে। যুদ্ধের কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। এই ভদ্রলোক নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন।
পাঁচ.
মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু একটি রাষ্ট্র যুদ্ধের কারণে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হলে তাকে রক্ষায় কেউ না কেউ এগিয়ে তো আসবেই। কঙ্গোতে যেমন এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী। তাদের দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের সশস্ত্র বাহিনী শুধু অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেনি। বলেছে মানবতার ভাষায়- কখনও স্কুল, মসজিদ বা গির্জা প্রতিষ্ঠা করে; কখনও মুখে খাবার তুলে দিয়ে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। স্বাস্থ্যসেবা আর সড়ক নির্মাণেও এগিয়ে বাঙালি সেনারা। আর সে কারণেই কঙ্গোলিজরা মনে করেন তাদের দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ একাই যথেষ্ট।
কঙ্গোর শান্তি মিশনে অংশ নিয়ে আমাদের সেনা ও বিমানবাহিনী কতো টাকা দেশে পাঠাচ্ছে সে হিসেব এখানে অবান্তর। তবু বলা যায়, বেশ কয়েকটি দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের আয় ছাড়াও অস্ত্র ও সামরিক বাহন ভাড়া দেয়ার মাধ্যমে যে টাকা আনছে তা দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে।
ছয়.
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছি অনেক বছর। শুরুতে যে গ্রুমিং হয়েছে তাতে ফার্স্ট জেনারেশন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট হিসেবে স্টার ইমেজ গড়ে তোলার সুযোগ ছিল না। সেলিব্রেটি ইমেজের গরমটাও বোঝার সুযোগ হয়নি। কিন্তু কঙ্গোতে গিয়ে প্রথমবারের মত মুখোমুখি হলাম সেলিব্রেটি ইমেজের। দেখলাম সফরকারী ৪টি প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকের মধ্যে একমাত্র আমার প্রতিষ্ঠানের সম্প্রচারিত সংবাদ ও অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পান সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা। ফলে সবার কাছে একমাত্র আমিই পরিচিত মুখ। চ্যানেল আইয়ের প্রত্যেক সংবাদকর্মীকেই তারা চেনেন। ফলে তাদের কাছে খুব সহজেই পরিবারের একজন হিসেবে গণ্য হলাম।
ব্যানব্যাট ১ ও ২ –এর যে সদস্যরা তখন কঙ্গোতে ছিলেন তাদের সবার আপন হয়ে ওঠাটা কিছুদিন পর কাজে লেগেছিল। অবশ্য তা ছিল খুবই কষ্টদায়ক ঘটনার কারণে।
দেশে ফেরার কয়েকদিন পর বুনিয়ায় বাংলাদেশ ক্যাম্পের কাছেই একটি অ্যাম্বুশের ঘটনা ঘটে। তাতে সেনা বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ও ৯ জন সৈনিক শহীদ হন। একটি বিদেশি বার্তা সংস্থা প্রাথমিক তথ্যটুকু দিয়েছিল শুধু। খবরটা পেয়ে স্বজন হারাবার বেদনা অনুভব করেছিলাম।
প্রধান বার্তা সম্পাদক রাত দেড়টায় ফোন করে অফিসে ডাকলেন। অফিসে এসে সেই প্রাথমিক তথ্যে ছোট্ট একটা সংবাদ তৈরি করে দিলাম বুনিয়া এলাকার ফুটেজ দিয়ে। সকালে যোগাযোগ করলাম জাতিসংঘের সদর দফতরে। তাদের মাধ্যমে ফোনে কানেক্ট হলাম বুনিয়ায় বাংলাদেশ ক্যাম্পের সাথে।
পরিচয় দিয়ে কথা বললাম। জানলাম, কর্নেল নুরুস সামা-সহ কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ঘটনাস্থলে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছ থেকে পুরো তথ্য পেলাম। দুপুর ২টার সংবাদে জানালাম বিস্তারিত তথ্য। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের আর কোন মিডিয়া ঘটনার প্রকৃত চিত্র জানে না। বিবিসি ওয়ার্ল্ড, সিএনএন বা রয়টার্সের মত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো তখন পর্যন্ত দিয়ে যাচ্ছে ভুল তথ্য।
সেদিন উপলব্ধি করি, আমরা যত সহজে পরিচিতি পাই, দেশের জন্য কাজ করছি বলে মনে করি… আসলে তা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। স্টার ইমেজের মোড়কে যে পেশার মানুষ যতটাই কাজ করুক না কেন, প্রকৃত হিরোতো তিনিই যিনি দেশ ও মানুষের স্বার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর প্রত্যেক সদস্যই নিজের জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের সবাইকে সালাম।
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, সারাবাংলা ডটনেট
সারাবাংলা/রমু/এএসজি