Saturday 28 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছাত্র মৈত্রীর গৌরবের ৪৪ বছর

সৈয়দ আমিরুজ্জামান
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৪৭ | আপডেট: ৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:০২

বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রির ১৬তম জাতীয় কাউন্সিলের দেয়াললিখন। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর গৌরবের ৪৪ বছর পূর্ণ হলো ৬ ডিসেম্বর। মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার আহবান নিয়ে ১৯৫২ সালের ২৬ শে এপ্রিল গড়ে উঠেছিল তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’। এরপর ৭২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতা এবং উত্তরাধিকার বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনে, শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী এদেশের ছাত্র সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠন। মেহনতী জনতার সাথে একাত্ম হওয়ার রাজনৈতিক দিশা নিয়ে, মেহনতী মানুষের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাহসী ভূমিকার ইতিহাস রচনা করেছে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।

আমারও সুযোগ হয়েছিল, এরশাদ স্বৈরাচার বিরোধী দীর্ঘ নয় বছরের ছাত্র গণআন্দোলনসহ ’৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণের, স্কুল ও কলেজ জীবনের শুরুতে ছাত্ররাজনীতির প্রতি অতি উৎসাহ ও আকর্ষণ, সাংগঠনিকভাবে ’৮৫ সালে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নে, পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন ’৯২ সালে একীভূত হওয়ার পর ছাত্রমৈত্রীর তিন মেয়াদে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করার।

‘৬০-এর দশকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলা ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’ থমকে দাঁড়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মহাবিতর্কে। বিভক্ত হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। আপোষকামিতা ও সুবিধাবাদকে পরিহার করে সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরাচার এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আপোষহীনভাবে এগিয়ে নিয়েছেন ‘বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’র পূর্বসুরীরা। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ আসাদ আমাদের গর্ব। ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখো শহীদ আমাদের প্রেরণা।

এদেশের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে ধারাবাহিক ভাঙ্গন আমাদের আন্দোলনের ঐতিহ্যকে নিঃশেষ করছিল। সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরাচার এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের এ রকম ক্রান্তিকালে, ১৯৮০ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান বুকে ধারণ করে তৎকালীন প্রগতিশীল ৪টি সংগঠন যথাক্রমে (১) জাতীয় ছাত্র আন্দোলন (২) জাতীয় ছাত্র দল (৩) জাতীয় ছাত্র দল এবং (৪) বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী’ গঠন করে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের ধারাকে শক্তিশালী করে। অতীতের ভূল-ভ্রান্তিকে সচেতনতার সাথে এড়িয়ে ঐক্যের ধারাবাহিক সংগ্রামে ১৯৮১ সালে জাতীয় ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশ, ১৯৮৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ‘বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন’-এর একটি অংশ, ১৯৮৮ সালের ৭ এপ্রিল বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের আরেকটি অংশের ঐক্যের মধ্য দিয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’ সুস্থ ধারার ছাত্র আন্দোলনে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২১ নভেম্বর ঐক্যের মোহনায় মিলেছে ‘জাতীয় ছাত্র সংসদ’।

বিজ্ঞাপন

অপরদিকে ঐক্যের ধারায় বিকশিত হয় ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন’। ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন’। ১৯৮৭ সালের আগষ্টে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন’ ও ছাত্র ঐক্য ফোরাম ঐক্যবদ্ধ হয় ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নে’।

‘৬০-এর দশকে থমকে পড়া পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সংগ্রামী ধারা ‘বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’ এবং ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন’ ঐক্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালের ২৩, ২৪ অক্টোবরে ‘বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’ গঠন করে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে দিয়েছে নতুন প্রাণ।

মেহনতী জনতার সাথে একাত্ম হওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে সমাজ বিপ্লবেরসহযোগী শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’র কর্মীরা গড়ে তুলেছেন নিজেদেরকে। জনমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করতে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী নিরলসভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রি বিষয়ক আরেকটি দেয়াললিখন। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস শিক্ষা একটি সার্বজনীন বিষয়। যা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ এবং সচেতন করার ক্ষেত্রে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষা মানুষকে তার সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করে। ফলে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সকল মানুষের শিক্ষা গ্রহণ অপরিহার্য। আমাদের দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়েই এ দেশের ছাত্র সমাজ। আমাদের সমাজে যেমন একদিকে রয়েছে মুষ্টিমেয় ধনীক শ্রেণী। অপরদিকে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হচ্ছে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং গরীব শ্রেণী।

এদেশের ছাত্র সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশই হচ্ছে গরীব শ্রেণীর পরিবার হতে আগত। বিভিন্ন শ্রেণীর পরিবার হতে আসলেও শিক্ষা এবং সমাজ চেতনা ছাত্র সমাজকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, প্রতিবাদী এবং সাহসী করে তোলে। বাংলাদেশের অনেক গৌরব-উজ্জ্বল ইতিহাস রচনার পেছনে রয়েছে এদেশের প্রতিবাদী ছাত্র সমাজ।

ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রক্তদান পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মায়ের ভাষা বাংলাকে রক্ষা করার জন্য ১৯৪৮ সালে এ দেশের ছাত্র সমাজ মহান ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে।

ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে ছাত্রদের জীবন দানের মধ্য দিয়ে এ দেশের ছাত্র সমাজের গৌরবময় রক্তাক্ত ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ‘৫২ এর ছাত্র আন্দোলন এদেশের বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের আকাঙ্খাকে জাগ্রত করে। ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি ছাত্রদের সমস্যাভিত্তিক দাবী, সিয়াটো-সেন্টো পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং স্বাধীন জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির দাবিতে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার পিছনে নিরলসভাবে কাজ করেছে এদেশের ছাত্র সমাজ। প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ‘৫৪ সালে যুক্তফ্রণ্ট গঠনে ছাত্র আন্দোলন গ্রহণ করেছে বিশেষ ভূমিকা। ‘৫৮ সালে সামরিক একনায়ক আইয়ুবশাহীর ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রামের ধারায় ‘৬২ সালে গণবিরোধী শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে এবং ‘৬৪ সালে কুখ্যাত হামিদুর রহমানের শিক্ষানীতিকে প্রতিরোধ করেছে এ দেশের সাহসী ছাত্র সমাজ দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে।

‘৬৮-‘৬৯ এর ১১ দফা আন্দোলন এবং ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে এদেশের ছাত্র সমাজের রয়েছে অবিস্মরণীয় ভূমিকা। অভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে ‘৭১ এর স্বাধীনতাযুদ্ধের ভিত রচনা করে এদেশের সাহসী ছাত্র সমাজ। ১৯৭১ সালের লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি বাংলাদেশ। কিন্তু জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আজও হয়নি। সাম্রাজ্যবাদ তার এদেশের পাহারাদারদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট করছে।

সমাজ কাঠামো এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। শোষণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, প্রতিক্রিয়াশীলতার এই সমাজ কাঠামোকে রক্ষা করেছে। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ শোষণ এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তার আপোষহীন লড়াই অব্যাহত রেখেছে। স্বাধীনতা লাভের পর অধিকারের প্রশ্নে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এদেশের ছাত্র সমাজ সাহসী যাত্রাকে অব্যাহত রাখে। পরবর্তীতে সামরিক শাসক জিয়ার শাসনামলে অপোষহীন সংগ্রাম করেছে এদেশের ছাত্র সমাজ।

সামরিক জান্তা বিরোধী ছাত্র সমাজের এই লাগাতার সংগ্রাম আরও দৃঢ় ও দৃঢ়তার জঙ্গীরুপ লাভ করে সামরিক একনায়ক এরশাদ আমলে। ‘৮২ সালে অবৈধভাবে ক্ষমতায় চেপে বসা সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে এদেশের ছাত্র সমাজ স্পর্ধিত প্রতিবাদে ছিল সোচ্চার। ‘৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি রুখে দিয়েছে তারা সাহসী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ক্ষমতায় চেপে বসা সামরিকতন্ত্রের প্রতিভূ জনধিকৃত এরশাদ চক্রের বিরুদ্ধে শিক্ষা ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য ‘৮২ সাল হতে ‘৯০ সাল পর্যন্ত অনেক বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করেছে এদেশের ছাত্র সমাজ। ‘৯০ এর গণঅভ্যুত্থান এবং স্বৈরশাসক এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা এদেশের ছাত্র সমাজের আপোষহীন সাহসী ভূমিকার কারণেই সম্ভব হয়েছে।

‘৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় সামরিক সরকার একনায়ক এরশাদ। ‘৯১ এ ক্ষমতাসীন হয় নির্বাচিত সরকার। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা থেকে সামরিকতন্ত্রের অবসান ঘটলেও রক্তে সিক্ত এদেশের ছাত্র সমাজের দশ দফা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অব্যাহত সন্ত্রাসে সাধারণ শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত। ছাত্র সমাজ সুস্থ ছাত্র আন্দোলনের ধারায় শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে অব্যাহত রেখেছে।

এদেশের ছাত্র সমাজ শুধু নিজেদের স্বার্থে আন্দোলন করেনি, তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় মুক্তি আর স্বাধীনতার লড়াইয়ে মুক্তিকামী জনতার সাথেও একাত্মতা ঘোষণা করেছে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ উন্মাদনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, শান্তিকামী মানুষের আন্দোলনে শরিক হয়েছে। আমাদের দেশের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় ঐতিহ্যের পাল্লাটা ভারী হলেও এখনও পর্যন্ত শিক্ষার অধিকার, মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের পূর্বসূরীরা জীবন ও রক্ত দিয়ে শিক্ষার অধিকার আদায় ও প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র কাঠামোর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন তাকে পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে হবে। বিরাজমান শিক্ষাব্যবস্থার স্বরুপ শিক্ষার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। অথচ, আমরা দেখছি ব্যাপক সংখ্যক মানুষ শিক্ষার এ অধিকার থেকে বঞ্চিত।

কারণ সাম্রাজ্যবাদ ও তারসহযোগী এখানকার ধনীক শ্রেণীর শোষণ-লুণ্ঠনমূলক সমাজ ব্যবস্থা। আমাদের দেশে যে ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে, তার প্রবর্তন করেছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ। এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তক বৃটিশ রাজপ্রতিনিধি লর্ড মেকলে। বৃটিশ প্রবর্তিত এই শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল, ইংরেজি জানা কিছু লোক তৈরী করা। যাদের কাজ হবে বৃটিশ উপনিবেশকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা। অর্থাৎ একদল কেরানি তৈরি করা হবে, যারা স্বার্থরক্ষা করবে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির, এদেশের সাধারণ মানুষের নয়। বৃটিশ চলে গেছে। পাকিস্তানী শাসকরাও চলে গেছে। কিন্তু শোষণভিত্তিক সমাজ পাল্টায়নি। নতুন কায়দায় সাম্রাজ্যবাদ এর উপর নির্ভরশীল ধনীক শ্রেণী একই শ্রেণী স্বার্থে এই শিক্ষাব্যবস্থার কোন মৌলিক পরিবর্তন করেনি।

ধনীক শ্রেণী একদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে, দমন পীড়নের মাধ্যমে তার শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখে, তেমনি অপরদিকে তারা ভাবাদর্শগতভাবেও বিভ্রান্ত করে। সমাজে শোষক শ্রেণীর ভাবাদর্শের আধিপত্য রক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থা একটি বড় হাতিয়ার। আমাদের দেশেও আজকের শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে শোষক বুর্জোয়া শ্রেণীর চিন্তাচেতনার আধিপত্য রক্ষার অন্যতম ভাবাদর্শগত হাতিয়ার। মেকলের শিক্ষানীতি থেকে শুরু করে শরীফ, হামিদুর রহমান, মজিদ খান এবং মফিজ উদ্দিন কমিশন পর্যন্ত প্রবর্তিত সকল শিক্ষানীতির বৈশিষ্ট্য অভিন্ন, শিক্ষাকে শোষক শ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহার করা। তাই আমরা যারা সাম্রাজ্যবাদের শোষণ উচ্ছেদ করে মানুষের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই তাদেরকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, এ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কেমন করে শোষক শ্রেণী এ কাজটি সম্পন্ন করে চলেছে। এবং শিক্ষাব্যবস্থার কোন জায়গাটায় আমাদের আঘাত হানতে হবে। বিরাজমান শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরাসহজেই বিষয়টি বুঝতে পারি। শিক্ষার বিষয়বস্তু অবৈজ্ঞানিক, প্রতিক্রিয়াশীল ও শোষক শ্রেণীর স্বার্থে প্রণীত। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সমস্ত পাঠ্য তালিকা তৈরি হয় শোষক ধনীক শ্রেণীর প্রয়োজনে। এমনকি এদেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের সিলেবাসের অনেক বিষয় নির্ধারিত হয় মুনাফাবাজ বহুজাতিক ঔষধ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকেই অত্যন্ত সুকৌশলে শিশুদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় অবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণা।

আমাদের দেশে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যা শেখানো হয় তার অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয়। আমরা যা শিখি তার ব্যবহারিক বা প্রয়োগিক বাস্তবতাও খুবই কম। ছাত্রছাত্রীরা উপলব্ধির চাইতে কেবল তোতা পাখির মত মুখস্ত করেই পাশ করে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত স্বাধীন, প্রজ্ঞাসম্পন্ন চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মানুষ তৈরী করা। শিক্ষা এমন হবে যাতে শিক্ষার্থীরা সব ধরণের শোষণ ও অত্যাচারকে ঘৃণা করতে শেখে।

যাতে মেহনতী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগে। বিপ্লবী চেতনা, মানবিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়। শিক্ষার্থীরা অর্জিত জ্ঞান যেন সমাজ ও গণমানুষের প্রকৃত কাজে লাগে সে জন্য শিক্ষার বিষয়, পদ্ধতি, পরীক্ষা-পদ্ধতি পরিবর্তন ও আধুনিকীকরণ করা অপরিহার্য।

শিক্ষা সংকোচন নীতি শিক্ষা সংকোচন এ যাবৎ কালের সব সরকারেরই সাধারণ নীতি। উচ্চবিত্তের সন্তানরাই লেখাপড়া শিখবে, বাকি জনগণ মুর্খ থাকুক এটাই তারা চায়। এর কারণও খুবই স্পষ্ট। লেখাপড়া শিখলে সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে উঠবে এবং শিক্ষার সাথে সাথে তাদের অর্থনৈতিক চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। তাই স্বাভাবিক কারণে শোষক শ্রেণী সবসময় শিক্ষা সংকোচনের নীতি অনুসরণ করে আসছে। এ পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগে যতগুলো শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে সকল কমিশনের মূল প্রস্তাব এবং নীতি হচ্ছে শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করে সংকুচিত করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফি, পাঠ্যপুস্তক, কাগজ-কলম, ছাত্রাবাসের ফি, পোশাক, খাওয়া-দাওয়া খরচের পরিমাণ হিসাব করলেই বুঝা যায় এই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কেন সাধারণ গরীব ঘরের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখা দুরুহ।

আমাদের দেশে শোষক ধনীক শ্রেণী শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করে একদিকে যেমন শিক্ষাকে ধনীক শ্রেণীর একচেটিয়া করতে চায়, সাধারণ মানুষকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়। তেমনি তারা শিক্ষাকে বেচাকেনার পণ্যে পরিণত করতে চায়। টাকা হলে যেমন বাজার থেকে পণ্য কেনা যায়, তেমনি টাকা থাকলে শিক্ষা ক্রয় করা যাবে। শিক্ষা কোন পণ্য নয়, প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। সকল মানুষের জন্মগত শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যয়বহুলতার মাধ্যমে শিক্ষাকে সংকুচিত করার নীতির অবসান ঘটাতে হবে।

ব্যয়বহুল শিক্ষা সাধারণ গরীব মানুষকে বঞ্চিত রেখে মুষ্টিমেয় ধনীক শ্রেণীর সন্তানদের শিক্ষার সুয়োগ করে দেয়। প্রয়োজন এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন। বৈষম্যমূলক শিক্ষা আমাদের দেশে একদিকে ব্যাপক মানুষ যেখানে শিক্ষার অধিকার হতে বঞ্চিত, অপরদিকে সেখানে এক শ্রেণীর স্কুল কলেজে ধনীক শ্রেণীর সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে বিশাল অংকের টাকা। সাধারণ শিক্ষা যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে তারই পাশাপাশি রয়েছে কিণ্ডার গার্টেন, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল, টিউটরিয়াল হোমাস, ক্যাডেট কলেজ, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধনীক শ্রেণীর সন্তানদের জন্য সাধারণ শিক্ষা থেকে ভিন্নতর কলাকৌশলে প্রতিক্রিয়াশীল বিষয়বস্তু অভিজাত পরিমণ্ডলে পরিবেশন করা হচ্ছে।

এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা সাধারণ মানুষকে ঘৃণা করতে শেখে। বিদেশী কায়দা, ইংরেজী প্রীতি এবং বাঙালী জাতিসত্তাবোধ বাঙালী সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি চরম অবজ্ঞা এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অথচ সাধারণ স্কুল-কলেজের তুলনায় এই সামান্য সংখ্যক ক্যাডেট কলেজের ছাত্রের পিছনে বছরে সরকারি ব্যয়, সাধারণ স্কুলের একজন ছাত্রের বছরে সরকারি ব্যয় অপেক্ষা ২০ গুণ বেশী। এর থেকেই বৈষম্যের চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাই সৌভাগ্যবান কিছু লোকের সন্তানরা যারা অভিজাত স্কুল কলেজে পড়ার সুয়োগ পায়, তারা যে পরীক্ষায় গ্রাম বা শহরের সাধারণ স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় ভাল ফলাফল করবে এটাই স্বাভাবিক।

শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে গণতান্ত্রিক। এজন্য, বৈষম্যমূলক শিক্ষার বিপরীতে সকলের জন্যে একই নীতিমালার ভিত্তিতে শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতা আমাদের দেশে জনসংখ্যা অনুপাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। নতুন নতুন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হল-হোস্টেল, ল্যাবরেটরী গড়ে তোলা হচ্ছে না। অথচ জাতীয় আয়ের সিংহভাগ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা হচ্ছে।

ইউনেস্কো (ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক এণ্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন) আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলির জন্য জাতীয় আয়ের ন্যূনতম ৮% শিক্ষাখাতে বরাদ্দের জন্য সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর পক্ষ থেকে জাতীয় বাজেটের ২৫% বরাদ্দের দাবি করে আসছে।কিন্তু আমাদের বরাদ্দের পরিমাণ বহুকষ্টে শিক্ষাখাতে ১২.০১ শতাংশ। বোধগম্য কারণে বাজেটের কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষাখাতে অর্থায়নের পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু জিডিপির হারে, বাজেটে মোট ব্যয়ের অনুপাতে বরাদ্দ কমেছে।

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক থেকেও ভালো অবস্থানে নেই শিক্ষাখাতের বাজেট। কয়েক বছর ধরে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশের কাছাকাছি থাকছে শিক্ষার বরাদ্দ।

দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাখাতের বরাদ্দের হার বাড়ানোর দাবি থাকলেও তা খুব একটা কাজে আসছে না। ফলে গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে বাংলাদেশ। ইউনেসকোর চাওয়া হলো, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হবে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ এবং জিডিপির ৬ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও সেই লক্ষ্যমাত্রা থেকে দূরে অবস্থান করছে।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পর্যাপ্ত পরিমাণে ছাত্রাবাস না থাকার কারণে বহু ছাত্র-ছাত্রী উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অধিকাংশ কলেজেই ছাত্রাবাস নেই। থাকলেও প্রয়োজন অনুযায়ী খুবই কম।

ফলে দুরের গ্রামের ছেলে-মেয়েরা বিশেষ করে মেয়েরা লেখাপড়া ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বেশির ভাগ স্কুলে ভালো ক্লাসরুম নেই। ক্লাশরুশ থাকলেও বেঞ্চ নেই। আর ল্যাবরেটরী, খেলার মাঠ ইত্যাদি নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় গরীব ও মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব নয়।

শিক্ষক সমস্যা অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র অনুপাতে শিক্ষকের অভাব রয়েছে। শিক্ষকতার মত মর্যাদা সম্পন্ন পেশার মর্যাদা ও বেতন খুবই কম। শিক্ষকের লেখাপড়া, গবেষণা ও প্রকাশনার সুযোগ খুবই সীমিত। এসব কারণে শিক্ষকদের মধ্যেও অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রদানে অমনোযোগিতা, ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গী, প্রজেক্ট ব্যবসা ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষা সমস্যার সাথে শিক্ষকের সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে শিক্ষক সমস্যার যথাযথা সমাধান করতে হবে। নিরক্ষরতা আমাদের শিক্ষার বড় সমস্যা হচ্ছে, এদেশের অধিকাংশ মানুষের একেবারেই অক্ষরজ্ঞান নেই। সরকারি হিসাব মতে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫ ভাগের একভাগ মাত্র অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। প্রকৃত শিক্ষিতের সংখ্যা আরও কম। যা হাতে গোনা যায়।

এদেশের কোটি কোটি গরীব খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানেরা লেখাপড়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না। তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠালেও আর্থিক সংকট ও বেঁচে থাকার সংগ্রামের কারণে তাদেরকে দ্রুত স্কুল থেকে বাধ্য হয়ে বিদায় নিতে হয়। প্রতি বছর এমনি নিরক্ষরের সংখ্যা বাড়ছেই। সরকার নিরক্ষরতা মুক্ত করার ঘোষণা দিলেও তা কার্যকারী করার জন্য প্রয়োজনীয় কোন উদ্যোগ গ্রহণ করছেন না। কারণ শোষণমূলক রাষ্ট্র এবং সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে এদেশের মানুষকে শিক্ষার আলো থেকে দূরে রাখতে হবে।

আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে হলে শিক্ষা অপরিহার্য। তাই প্রতিটি শিশু-কিশোরকে শিক্ষার সুযোগ দিতেই হবে। আর এজন্যই প্রয়োজন সকলের জন্য শিক্ষার আন্দোলনকে বেগবান করা। নারী শিক্ষা ও নারী মুক্তি- আমাদের সমাজে অর্ধেক নারী। অর্ধেক জনসমষ্টিকে শিক্ষার আলো থেকে দূরে রেখে সমাজের মুক্তি ঘটাতে পারে না।

অথচ আমাদের সমাজে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের, বিধি-নিষেধের কারণে নারীর শিক্ষার অধিকার ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ হল-হোস্টেল না থাকার কারণেও ছাত্রীদের লেখাপড়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরী হচ্ছে। নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা পশ্চাৎপদ ও নানা ধরণের সামাজিক শোষণ নির্যাতনের শিকার। নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সমমর্যাদা এখানে অনুপস্থিত।

নারী মুক্তির বিষয়টি সামাজিক প্রগতির সাথে জড়িত। প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন আলোকপ্রাপ্ত ছাত্র সমাজকে শিক্ষা সমস্যার সাথে সাথে নারী মুক্তির প্রশ্নেও সামাজিক সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আইনগত অধিকার নিশ্চিত করে নারী মুক্তির পথ প্রশস্ত করতে হবে। গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলনের সাথে নারী মুক্তির বিষয়টিও যুক্ত করে দেখতে হবে। শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ- শিক্ষাব্যবস্থার দুর্নীতি, সন্ত্রাস এখন একটা সাধারণ ব্যাপার।

দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এমন পর্যায় পর্যন্ত রয়েছে যে, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকও অনেক সময় ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে পর্যন্ত পৌঁছায় না। পৌঁছালেও প্রয়োজনের তুলনায় কম এবং তাও আবার বৎসরের মাঝামাঝি সময়ে। বেসরকারি স্কুল কলেজে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রেও বাঁধা । বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরম্ভ করে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সরকারি হস্তক্ষেপ শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছে। সরকার তার স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, বদলিসহ অগণতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ করে শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে।

সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সন্ত্রসীদের হাতে জিন্মি। অনেক মেধাবী ছাত্রকে সন্ত্রাসীদের হাতে জীবন দিতে হচ্ছে। সরকার স্বীয় স্বার্থ রক্ষা করা এবং ছাত্র আন্দোলনের সুষম বিকাশকে নষ্ট করার জন্য পরিকল্পিত উপায়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে লালন করে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছাত্ররা শিক্ষাকোর্স শেষ করতে পারছে না। এতে গরীর ছাত্রদের উপর প্রচণ্ড আর্থিক চাপ পড়ে।
ফলে বহু ছাত্র শিক্ষা জীবন অর্ধ সমাপ্ত রেখেই জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। ব্যাপক দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অগণতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের ফলে শিক্ষার কাঠামোই আজ একেবারে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। শিক্ষার সাথে সাথে সংস্কৃতির বিষয়টিও স্বাভাবিক ভাবে আসে। শাসকগোষ্ঠী তার শ্রেণী শোষণ বজায় রাখার জন্য জনগণের মধ্যে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল ভাবার্দশ প্রচার করে এবং সে অনুযায়ী গড়ে তোলে সেই ধরণের সংস্কৃতি। শিক্ষাব্যবস্থা হল তার একটি বাহন, শোষক ও শাসকগোষ্ঠী এই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কে মিথ্যা ধারণার সৃষ্টি করে এবং প্রগতি বিরোধী মনমানসিকতা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়।

আমাদের শিক্ষার বিষয়বস্তুতে যে কারণে শ্রেণী সংগ্রামের কথা থাকে না বরং শ্রেণী চেতনাকে ভোঁতা করে দেওয়া হয়। সাম্প্রদায়িক ভাবধারার শিক্ষাকে উৎসাহিত করা হয়। শিক্ষাঙ্গনের বাইরেও পত্র-পত্রিকা, সিনেমা, গান, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদিতেও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা ছড়ানো হচ্ছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির মধ্যে দুধরণের বিষয় দেখা যায়। একদিকে রয়েছে ধর্মাদ্ধতা, পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার ইত্যাদি যা সামন্ত সংস্কৃতির পরিচায়ক।

অন্যদিকে রয়েছে অশ্লীলতা, তথাকথিত আধুনিকতা ইত্যাদি যা আজকে পাশ্চাত্যের বিকৃত পুঁজিবাদী সংস্কৃতির পরিচায়ক। সমাজে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান অংশ হিসেবে ছাত্র সমাজকে বিকৃত বুর্জোয়া সংস্কৃতি ও পশ্চাৎপদ সামন্ত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা বিশ্লেষণ করে যে বৈশিষ্ট্য পাই সংক্ষিপ্ত আকারে তা হলো- এ শিক্ষাব্যবস্থায় সকল মানুষ সমান অধিকার নিয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পায় না। এ শিক্ষাব্যবস্থায় নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলে। এ শিক্ষাব্যবস্থা বৈষম্যমূলক ধনীক শ্রেণীর জন্য অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর গরীব-সাধারণের জন্য বিপর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

এ শিক্ষাব্যবস্থা ব্যয়বহুল। যে কারণে গরীব-সাধারণের ছেলে-মেয়েরা উচ্চ শিক্ষার অধিকার হতে বঞ্চিত। এ শিক্ষাব্যবস্থা মেহনতী জনগণের শ্রমশক্তি, সম্পদ লুট করার কৌশল শেখায়। এ শিক্ষাব্যবস্থা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বা বস্তুবাদী চিন্তা করতে শেখায় না। এ শিক্ষাব্যবস্থা ধনীক শ্রেণীর স্বার্থকে রক্ষা করে যা শোষণমূলক বর্তমান রাষ্ট্র ও সমাজকে টিকিয়ে রাখতেসহায়তা করে।

বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্র এবং শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক- বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অর্ন্তভূক্ত আমাদের দেশ বাংলাদেশ। পুঁজিবাদী বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে কয়েকটি শোষক সাম্রাজ্যবাদী দেশ। আর প্রান্ত সীমানা ছড়িয়ে আছে তৃতীয় বিশ্বের শোষিত দেশসমূহ। অশিক্ষা, ক্ষুধা, দারিদ্র আর মৃত্যু তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশ সেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিরই দারিদ্রতম একটি।

আমাদের দারিদ্রের মূল কারণ সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী শোষণ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রধান হোতা। বহুজাতিক কর্পোরেশন, তথাকথিত সাহায্য সংস্থা ও ঋণ, অসম বাণিজ্য, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর কর্তৃত্ব ইত্যাদির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ আমাদের শোষণ এবং লুণ্ঠন করছে। আমাদের দেশে শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না। আমাদের দেশ বিদেশী পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে।

সামন্ত ব্যবস্থার অবশেষ কৃষির বিকাশ করছে রুদ্ধ। আমাদের সকল ক্ষেত্রে পরনির্ভর থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনইভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের নয়া উপনিবেশিক শাসন-শোষণে প্রতিনিয়ত আমরা পিষ্ট হচ্ছি। সাম্রাজ্যবাদেরসহযোগী আমাদের দেশের এক শ্রেণীর দালাল ধনীক গোষ্ঠী সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্ট ভোগ করে রাতারাতি ফেঁপে উঠছে। এরাই আমাদের দেশের শোষক এবং শাসকবর্গ।

বহুজাতিক কোম্পানীর ক্ষুদে অংশীদার হয়ে, বিদেশী কোম্পানিসমূহের এজেন্ট হয়ে অথবা আমদানী-রপ্তানী, চোরাকারবারী-কালোবাজারীতে লিপ্ত থেকে এরা জনগণকে বেপরোয়া শোষণ ও লুণ্ঠন করে দেশকে দারিদ্রের সর্বনিম্ন অবস্থায় রেখে নিজেদের জন্য সম্পদের পাহাড় বানাচ্ছে। এই সম্পাদ তারা উৎপাদনের কাজে বিনিয়োগ করে না। বেশিরভাগই বিদেশে পাচার করে ও চরম বিলাসিতার কাজে অপব্যয় করে। এই দালাল ধনীক গোষ্ঠী কখনই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন চায় না। এরা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্থানীয় এজেন্ট হিসাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ব্যবহার করে।

শিল্পায়নের নামে রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংক থেকে ঋণ সংগ্রহ করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না। ঋণের টাকা আত্মসাৎ করে। সাম্রাজ্যবাদী লগ্নী পুঁজির অধীনে ব্যবসায়িক পুঁজি দেশের প্রকৃত কল্যাণ বয়ে আনে না। ফলে সমাজে দেখা দেয় বেকারত্ব, ঘুষ, দুর্নীতি, অপরাধ প্রবণতা, কালোবাজারী, দ্রব্যমূল্যে উর্ধ্বগতি, গণতন্ত্রহীনতা, স্বৈরাচারী মানসিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র ধর্মান্ধতা প্রভৃতি। সাম্রাজ্যবাদ তার লগ্নী পুঁজি রক্ষা করার জন্য দালাল-ধনীক শ্রেণীকে রাষ্ট্র ক্ষমতার পাহারাদার হিসাবেসহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা করে।

আর এদেরকেসহযোগিতা করে সামরিক এবং বেসামরিক আমলারা। এই চক্রগুলির হাতেই সকল ক্ষমতা। তারাই প্রণয়ন করে দেশের আইন। নিয়ন্ত্রণ করে দেশের সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এরা তাদের স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে প্রণয়ন করে শিক্ষানীতি। শোষণ-লুণ্ঠনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কখনই গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতিকে গ্রহণ করতে পারে না। রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্রের প্রতিফলন ঘটে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে। শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রের উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত। ফলে উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কের পরিপূর্ণ উচ্ছেদ ছাড়া গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সে কারণে সংগ্রাম করতে হবে একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা অর্থাৎ জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য।

জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং ছাত্র সমাজ- জনগণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অপরিহার্যভাবে প্রয়োজন জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। তাই নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছাত্র সমাজের অংশগ্রহণ রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করার ক্ষেত্রে একাকার হয়ে আছে। আমাদের দেশ আজ দুই শিবিরে বিভক্ত। একদিকে রয়েছে কোটি কোটি মানুষ, যারা অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষার অধিকারহীন। অপরদিকে রয়েছে কিছু হাতে গোনা ধনী লোক যারা ভোগ বিলাসে ডুবে রয়েছে।

ব্যাংকের মালিক, বড় বড় ব্যবসার মালিক, বড় বড় শিল্পের মালিক, গ্রামাঞ্চলের জোতদার ও মহাজন, এদের অনেকেই বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত। এরাই হচ্ছে উপরতলার শোষক শ্রেণী। অন্যদিকে শোষিত জনতার মধ্যে রয়েছে শিল্প শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, বিভিন্ন স্তরের কৃষক, গ্রাম-শহর নানা ধরণের শ্রমজীবি মানুষ, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি। দেশকে বাঁচাতে হলে সমগ্র শোষিত শ্রেণীগুলিকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে হবে উপর তলার শোষকের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদেরসহযোগী ধনীক শ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতা করায়াত্ব করে আছে।

দেশের কোটি কোটি মানুষের উন্নতি করতে হলে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কে পরিবর্তন করতে হবে। এজন্য এই ধনীক শ্রেণীকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। শোষক বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থে গঠিত এই রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। মেহনতী মানুষের স্বার্থে নতুন ধরণের বিপ্লবী রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। কেবলমাত্র এই নতুন রাষ্ট্রই জনগণের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান এবং শিক্ষার মত মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে।

দেশের দারিদ্র দূর করা, বেকারত্বকে অপসারিত করা, শিল্প ও কৃষির উন্নতি সাধন, জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্রকে সুনিশ্চিত করার প্রয়োজনে বিপ্লব আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বিপ্লব ছাড়া আমাদের মুক্তি নেই। এই বিপ্লব হবে সব কয়টি শোষিত ও নির্যাতিত শ্রেণীর মিলিত বিপ্লব। তার নেতৃত্বে থাকবে এ যুগের সবচেয়ে অগ্রসরমান শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণী। ছাত্র সমাজকেও সমাজের সচেতন ও সংবেদনশীল অংশ হিসাবে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে এই বিপ্লবে অংশ গ্রহণ করতে হবে।

‘বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’ সেই লক্ষ্যে ছাত্র সমাজকে শিক্ষিত, উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি ও জনগণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা- আমাদের জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের প্রয়োজনে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চাই, যা আমাদের দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করবে। সকল ধরণের প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা এবং মূল্যবোধকে ধ্বংস করবে। বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশকে ত্বরান্বিত করবে। বর্তমানে উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ এক নতুন চরিত্র সম্পন্ন হবে।

কৃষি এবং শিল্পের বিকাশ সাধনেসহায়ক হবে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা। সৃজনশীল গবেষণার মাধ্যমে বাস্তবক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াবার জন্য বই, গবেষণাগার, কারখানা, কৃষিক্ষেত্রে একই সাথে যুক্ত হবে এবং এভাবেই এ ব্যবস্থার ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে সুষম সমন্বয়ের দ্বারা সকল বেকারত্বের অভিশাপ থেকে জাতি মুক্ত হবে। শ্রম শক্তির ঘটবে না কোন অপচয়। শিক্ষা হবে ধর্মনিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন। সাম্রাজ্যবাদী, লুণ্ঠনকারী দেশীয় শাসকগোষ্ঠীর রাহুমুক্ত হবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।

সমাজের বিকাশ ও পরিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রসার, দেশ-প্রেম, শ্রম ও সৃজনশীলতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হবে জাগ্রত। হতাশা, নির্জীবতা, অপরাধ প্রবণতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা সমাজের এই সব নেতিবাচক উপসর্গকে স্বমূলে উৎপাটিত করে জনগণের প্রতি সেবা, কর্ম, মমত্ববোধ ও সৃজনশীলতায় উদ্দীপ্ত জীবনবাদী শিক্ষার প্রসার ঘটবে এবং ব্যক্তি স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার শিক্ষাকে নস্যাৎ করবে।

বতমানে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী শিক্ষার অধিকার আদায়সহ সমতার চেতনায় অসাম্প্রদায়িক শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে নবতর ইতিহাস রচনায় দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে চলছে।

জন্মলগ্নের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর পূর্বসূরি সংগঠন ‘ইপসু’র নেতৃত্বে ‘৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১১ দফাসহ ‘৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৮২- ‘৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলন, ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ ইত্যাদি আন্দোলনে ছিল ধারক-বাহক। ছাত্র মৈত্রী তার বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্যে শিক্ষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অটুট। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন সংগ্রামে প্রাণ দিতে হয়েছে ছাত্র মৈত্রীর বন্ধুদের।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তার প্রেক্ষাপট, ঐতিহাসিক বাস্তবতা সম্পর্কিত বিস্তারিত বিশ্লেষণ জরুরী। অনুধাবন করা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল নয় মাসের যুদ্ধের ইতিহাস নয়। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনা করতে, মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য নানামাত্রিক সংগ্রামের প্রয়োজন হয়েছে। শোষিত, বঞ্চিত এদেশের মানুষ সংগ্রাম করেছে নিজেদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির তাগিদে। মুক্তিযুদ্ধের ভ্রুণ সৃষ্টি হয়েছিল ব্রিটিশ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধ প্রতিবাদ সূচনাকাল থেকে।

শতাব্দীর অধিককাল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এবং দুই যুগ ধরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগঠিত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক মুক্তির লড়াইয়ে সে ভ্রুণ বিকশিত হয়েছে, নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে তা পেয়েছে পুর্ণাঙ্গ আকার-আকৃতি এবং ভূমিষ্ঠ হয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি। মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক পটভূমি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারাবাহিক বিকাশ সম্পর্কিত আলোচনায় অনিবার্যভাবেই এদেশের ক্রমশ গড়ে ওঠা বাম প্রগতিশীল শক্তির গৌরবময় ভূমিকা, আত্মত্যাগ এবং নিরন্তর সংগ্রামের প্রসঙ্গ এসে পড়ে।

এদেশের বাম প্রগতিশীল শক্তির নেতৃত্ব কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মেহনতী মানুষ, প্রগতিশীল মধ্যবিত্তের ধারাবাহিক রাজনৈতিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ইপসু অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে উপলব্ধিতে এনে, দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় পরিচালিত করতে গেলে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর পূর্বসূরী সংগঠন ‘ইপসু’সহ এদেশের বামপস্থী সকল ছাত্র সংগঠনের অবদানের ইতিহাসকে সামনে তুলে আনার কোন বিকল্প নেই।

দেশের শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন পরিস্থিতি যদি তুলে ধরতে হয়। তাহলে আমরা দেখি পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণ ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বিয়োজন করা হয়েছে চলমান শিক্ষাব্যবস্থায়, ২০১৬-শিক্ষা আইন করে কোটি শিক্ষার্থীর সাথে চলছে শিক্ষার নামে প্রহসন, শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণ, শিশুর নিজের ওজনের ১০% এর বেশি ভারি ব্যাগ বহন করা নিষিদ্ধ থাকলেও সেটি আজও বাস্তবায়ন হয়নি, প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে চলছে রমরমা ব্যবসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে জালিয়াতি। দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ। সমগ্র দেশে চলছে সন্ত্রাস ও দখলদারিত্ব, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে অনিয়মে ভরপুর। ইতোপূর্বে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আগুনের কবল থেকে রেহাই পায়নি। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে চলছে নৈরাজ্য।

ছাত্র মৈত্রী দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিজ্ঞান ভিত্তিক ও গণমূখী শিক্ষার দাবির প্রস্তাব করেছে। অবিলম্বে ছাত্র মৈত্রী প্রস্তাবিত সার্বজনীন, গণমূখী বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ণে দাবি রয়েছে। বাজেটে শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় আয়ের ৮ ভাগ বরাদ্দ দিতে হবে। ছাত্র সমাজের ১০ দফা বাস্তবায়ন করতে হবে। অবিলম্বে ডাকসুসহ সকল ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়ে ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে ইত্যাদি। শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে হবে, সকল জাতিসত্ত্বার জন্য মাতৃভাষার শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে ইত্যাদি।

কিন্তু একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ৫৩ বছর অতিবাহিত হলেও আমার শিক্ষার সেই উদ্দেশ্য অর্জনে রাষ্ট্রকে ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখিনি। এত বাধা বিপত্তির মধ্যেও ছাত্র মৈত্রী তার আন্দোলন সংগ্রাম অব্যহত রেখেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ফি বিরোধী আন্দোলনে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবাসন সংকট নিরসনের আন্দোলনের মাধ্যমে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ভর্তি ফি-বিরোধী আন্দোলন ও শিক্ষা বাচাঁও ও অন্যান্য আন্দোলনের মাধ্যমে। সেই সকল চেতনাকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী এই সকল শিক্ষার ধ্বংসের সকল প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে এদেশের সচেতন ছাত্র সমাজকে সাথে নিয়ে।

জাতীয়ভাবে আমরা একটি ক্রান্তিকালীন সময় অতিক্রম করছি। জাতীয় সম্পদ রক্ষায় ছাত্র মৈত্রী প্রতিনিয়ত আন্দোলন করছে, এদিকে সুন্দরবন রক্ষা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বতিলের দাবিতেও আন্দোলন চলমান। দেশে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও আরও অন্যান্য ছাত্র সংগঠন থাকলেও দেশের সংকটময় মূহুর্তে দেশ ও জাতির কাছে তাদের ভূমিকা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। সেই অবস্থান থেকে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী দেশের বিভিন্ন জাতীয় ইসুতে তার আন্দোলন সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে চলছে অবিরাম।

আগামীদিনগুলোতে ছাত্র মৈত্রী এখনও স্বপ্নদেখে একটি লাল টুকটুকে সূর্য উঠবে আমাদের দেশটাকে রাঙ্গাবে। বাসযোগ্য করে তুলবে আমাদের এই সমাজ, দেশ ও পৃথিবী। যেখানে অশুভ শক্তির আগমন সেইখানেই বিপরীতে ছাত্র মৈত্রীর সংগ্রামী অবস্থান অটুট থাকবে। শুভশক্তি ও প্রগতির মিছিল রাঙ্গাবে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী। তবেই আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের আত্মত্যাগের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনে সক্ষম হব, এদেশের মেহনতি মানুষের বক্ত আর ঘামের যথার্থ প্রতিদান দিতে সক্ষম হব।

সবশেষে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেই সমাপ্তি টানছি- মেহনতী জনতার সাথে একাত্ম হওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে সমাজ বিপ্লবেরসহযোগী শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর কর্মীরা গড়ে তুলেছেন নিজেদেরকে। জনমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করতে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী নিরলসভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ছাত্র মৈত্রী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর