Saturday 28 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেতনার বিলের গণহত্যা ও শহীদ লক্ষণ দাসের সার্কাস

রাআদ রহমান
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৪২

বরিশালের আগৈলঝাড়ার রাজিহার ইউনিয়নের ঐতিহাসিক কেতনার বিল বধ্যভূমি। ছবি: লেখক

হাতিটার নাম ছিল মধুবালা। লক্ষণ দাস সার্কাসের প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটিশ আমলের নামেররা কুস্তিগির, ভারোত্তোলক, ম্যাজিশিয়ান লক্ষণ দাসের খুব প্রিয় সঙ্গী ছিল মধুবালা। তার সার্কাসের মূল আকর্ষণ ছিল মধুবালার পারফরম্যানস। নামটা যেমন সুন্দর, মধুবালা দেখতেও ছিল নজরকাড়া। মায়াভরা চোখের শান্ত চাহনি। গলায় ঘণ্টিটা টুংটাং বাজতো, কপালে টকটকে লাল সিঁদূরে অপূর্ব লাগত মধুবালাকে। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচারে গুলিবর্ষণে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল মধুবালা। অবলা হাতি-বাঘ-ভাল্লুক-হরিণসহ সার্কাসের প্রত্যেকটা প্রাণীকে মেরে ফেলেছিল তারা। প্যান্ডেল করার তাবু,টিন-কাঠ-বাঁশসহ সার্কাসের অন্যান্য উপকরণ লুটে নিয়ে গিয়েছিল। পুড়িয়ে দিয়েছিল সব সরঞ্জামসহ লক্ষণ দাসের বাড়িঘর। সেদিন শুধু লক্ষণ দাস নন, পাকিস্তানিদের নির্বিচার ব্রাশফায়ারে কেতনার বিলে শহীদ হয়েছিলেন দুই হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষ। কেতনার বিল দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বড় বধ্যভূমি।

বিজ্ঞাপন

ছোটবেলা থেকেই স্কুল-কলেজে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে পরিচিত লক্ষণ দাস কুস্তিগীর ও ভারোত্তোলক হিসেবে নামডাক কামানোর সাথে সাথে বিভিন্ন কসরত ও জাদু দেখিয়েও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এমন নানা গুণে গুণান্বিত মানুষটাকে তার মেসো নিয়ে এলেন তৎকালীন বিখ্যাত লায়ন সার্কাসে। লায়ন সার্কাসে লক্ষ্মণ দাস দুর্লভ অনেক খেলা দেখানো শুরু করেন। দাঁত দিয়ে রড কাটা, গলা দিয়ে রড বাঁকানো, ভারোত্তোলন, বর্ষা নিক্ষেপ, ত্রিশূল ভেদ, ড্যাগার বোর্ড ইত্যাদি। এরপর ১৯৪৮ সালে নিজেই প্রতিষ্ঠা করলেন “রয়েল পাকিস্তান সার্কাস”। স্বীয় মেধা, পরিশ্রম ও দক্ষতার অনবদ্য মিশেলে আর নতুন ধরনের কায়দা-কসরতের চোখ ধাঁধানো জৌলুসে লক্ষণ দাস ও তার সার্কাসের সুনাম দক্ষিণবঙ্গের গৌরনদীর বিস্তীর্ণ এলাকা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দশ দিকে।

বিজ্ঞাপন

লক্ষণ দাস বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামের এই পুরো সময়টায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাই একাত্তরে যখন পাকিস্তানি সেনা ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঙালিদের ওপর, তখন লক্ষণ দাস মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগীতায় এগিয়ে এলেন। নানা কৌশলে বিভিন্ন স্থানে সার্কাসের দল নিয়ে শো করতে যাওয়ার ছদ্মবেশে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও চলাচলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করলেন লক্ষণ। খবর চাপা থাকল না। গৌরনদী কলেজে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প তৈরি হওয়ার পর স্থানীয় দালাল, আলবদর ও রাজাকারেরা পাকিস্তানিদের জানায় যে, লক্ষণ দাস তার সার্কাসের আড়ালে দেশদ্রোহীদের (মুক্তিযোদ্ধা) প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় দিচ্ছেন।

গোপনে পাকিস্তানিদের অপারেশনের খবর আগেই পেয়ে যাওয়ায় লক্ষণ দাস তার স্ত্রী, দুই ছেলে এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান জীবন বাঁচাতে। তার এতো সাধের এবং প্রিয় সার্কাসের সকল সরঞ্জাম, তাবু থেকে শুরু করে সকল উপকরণ এবং প্রিয় প্রাণীদের পেছনে ফেলে আগৈলঝাড়ার কোদালধাওয়া গ্রামের পাশে কেতনার বিলে চলে যান। সেখানে পরিবার নিয়ে নৌকায় আত্মগোপনে থাকতে শুরু করেন লক্ষণ দাস। অল্পের জন্য লক্ষণ দাসের পুরো পুরিবার বেঁচে যাওয়ায় তাদের না পেয়ে ক্ষোভে সার্কাস লুটপাট করে সবকিছু পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও আলবদরের দল। সার্কাসের প্রাণীগুলোকে গুলি করে মারে। কিন্তু মৃত্যু লক্ষণ দাসের পিছু ছাড়েনি।

কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তানিরা কোদালধোওয়া গ্রামে সদলবলে হামলা চালায়। একপর্যায়ে তারা গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে পাশের কেতনার বিল দিয়ে প্রাণভয়ে পালাতে থাকা হাজার হাজার মানুষের ওপর হামলা চালায়। মিলিটারি বোট দেখা মাত্র লক্ষণ দাস তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিলের পানিতে ঝাঁপ দেন। দুই ছেলে অরুণ-বীরেন সাঁতরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে পারলেও পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার সময়েই লক্ষণ পাকিস্তানিদের চোখে ধরা পড়ে যান। তারা নির্বিচারে গুলি ছুঁড়তে থাকে লক্ষণের দিকে। তলিয়ে যান লক্ষণ। এভাবেই শহীদ হন লক্ষণ দাস।

পাকিস্তানিদের বর্বরতা এখানেই শেষ হয়নি। লক্ষণের গুলিবিদ্ধ স্ত্রী লীলা দাসের ওপর বেয়নেট চার্জ করতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। একপর্যায়ে তার সাথে থাকা গয়না লুট করে তারা। কিছু গয়না পানিতে পড়ে যায়। পাকিস্তানিরা চলে যাওয়ার পর অরুণ-বীরেন বাবা-মায়ের লাশ তুলতে আসলে বিলের পানির নীচে ৩টা আংটি ও মায়ের কোমর থেকে খুলে পড়া বিছা খুঁজে পান। বাবার স্মৃতির লক্ষণ দাস তার সার্কাস, জাদু আর নানাবিধ গুণের ছটায় এতোটাই আলো ছড়িয়েছিলেন যে তার মৃত্যু গৌরনদী এলাকায় দীর্ঘ শোকের ছায়া ফেলেছিল। বিশেষ করে তার সার্কাসের সবচেয়ে অসাধারণ পারফরমার হাতি মধুবালার প্রভুভক্তি এবং হাতিটির প্রতি লক্ষণ দাসের ভালোবাসার গল্প চমকপ্রদ ঘটনার মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল সবখানে। সেজন্যই লক্ষণ দাস ও হাতির মৃত্যুর ঘটনার অন্য আরেক বয়ানও লোকের মুখে মুখে ফেরে আজও। রীতিমত অলৌকিকতার আবরণে মোড়ানো সে গল্পটি হচ্ছে এমন— পাকিস্তানিরা লক্ষণ দাসের বাড়িতে হামলা চালানোর পর জীবন হাতে নিয়ে লক্ষণ দাস যখন তার পরিবার নিয়ে পালাচ্ছিলেন, তখন পেছনে পাকিস্তানিদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে মালিককে রক্ষা করতে তাকে বিশাল শরীর দিয়ে আড়াল করে দৌড়াচ্ছিল মধুবালাও। পাকিস্তানিদের একটানা ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেটে মধুবালার মাথা-গায়ে-পায়ে ঝাঁজরা হলেও এক মুহুর্তের জন্যও মধুবালা লক্ষণের শরীরে কোনও গুলি লাগতে দেয়নি। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত মালিককে বাঁচিয়ে যাওয়ার এই গল্প বছরের পর বছর ধরে গৌরনদী এলাকায় চলে আসছে এক অলৌকিক কিংবদন্তীর মতো।

সেদিন কেতনার বিলে শুধু লক্ষণ দাসই নন, শহীদ হয়েছিল আরও হাজারও মানুষ। গবেষণা অনুযায়ী বরিশাল জেলায় কমপক্ষে ৩৩টি বধ্যভূমিতে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে নির্মমতম গণহত্যাগুলোর একটা ছিল কেতনার বিলে চলা নরমেধযজ্ঞ। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আগৈলঝাড়া উপজেলার রাংতা গ্রামের শহীদ কাশীনাথ পাত্রের পুত্র জগদীশ পাত্র (৬৫) স্মৃতিচারণ থেকে জানান, “ঘটনার দিনে পহেলা জ্যৈষ্ঠ সেনাবাহিনী আসার খবরে গৌরনদী-আগৈলঝাড়ার কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর প্রাণভয়ে কেতনার বিলে আশ্রয় নেয়। ওইদিন আমিও বাবার সঙ্গে ওই বিলে আশ্রয় নেই। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাকসেনারা সেখানে পৌঁছে মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করে পাখির মতো মানুষ মারতে থাকে। আমি প্রাণে বেঁচে গেলেও আমার বাবার শরীরে ৫টি গুলিবিদ্ধ হয়। তিনি মারা যান। ওই দিন সকালে চেঙ্গুটিয়া এলাকা দিয়ে হাজার-হাজার লোক জীবন বাঁচাতে কেতনার বিল পাড়ি দিয়ে আগৈলঝাড়ার কোদালধোওয়া, রামানন্দেরআঁক ও বাঁকালো এলাকায় পালানোর সময় অনেকেই কেতনার বিলের পার্শ্ববর্তী কেষ্ট পাত্রের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানি সেনারা কেস্ট পাত্রের বাড়িতে ঢুকে হত্যা করে অসংখ্য মানুষকে। ওইদিন পাকিস্তানিদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে সমস্ত কেতনার বিল লাশের স্তূপে পরিণত হয়েছিল। পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে আসতে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে কেতনার বিলে দুই হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হন। অনেক লাশ শিয়াল, কুকুরে ছিঁড়ে খেয়েছে। পরদিন এলাকার অমূল্য পাত্র ও হরলাল পাত্রের নেতৃত্বে পাত্র বাড়ির বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি গর্ত করে মরদেহগুলো মাটি চাঁপা দেওয়া হয়। পাত্র বাড়ির শিশু ও মহিলাসহ ১৯ জনের মরদেহও একত্রে মাটি দেওয়া হয়। বহু মরদেহ কেতনার বিলেই পচে গলে নষ্ট হয়। ”

কেতনার বিলের বধ্যভূমিতে শহীদ অসংখ্য মানুষের স্মরণে কোনও স্মৃতিস্তম্ভ বা শহীদ স্মারক আজও তৈরি হয়নি। শুধু কেতনার বিল নয়, বাবুগঞ্জে বরিশাল ক্যাডেট কলেজের অবস্থিত আর্মি ক্যাম্পের পেছনে প্রতাবপুর এলাকা জুড়ে ছিল ভয়াবহ পাকিস্তানি সেনাদের টর্চার সেল। যুদ্ধের পুরো নয় মাস জুড়ে বাবুগঞ্জ ও আশেপাশের উপজেলাগুলো হতে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের আশ্রয় দানকারী সাধারণ মানুষ ও শিক্ষক-আইনজীবী-লেখকসহ বুদ্ধিজীবীদের ধরে প্রতাবপুরের টর্চার সেলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর পৈশাচিকভাবে হত্যা করত পাকিস্তানিরা। অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এখানে, যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল অক্টোবর মাসের এক দিন। শতাধিক মানুষকে ধরে এনে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে প্রথমে ব্রাশফায়ার করে এবং এরপর বেয়নেটে পেট চিরে ফেলে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। কেতনার বিলের মতো বাবুগঞ্জের প্রতাবপুরের বধ্যভূমি সংরক্ষণেও নেই কোনও উদ্যোগ।

“শালা উদারসে ইদারাও-মুক্তি কিয়া আশ্রয় দিয়া— এ কথা বলেই আমার বাবা শ্যামা কান্ত রায়সহ আমাদের গ্রাম ও আশপাশের গ্রাম থেকে ধরে আনা ৪৫ জন নিরীহ গ্রামবাসী নারী-পুরুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি মিলিটারিরা। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই ভারতে ট্রেনিং নিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের তালিকায় আমাদের নাম ওঠেনি, আমিও রাষ্ট্রের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাইনি”— স্মৃতিচারণে এভাবেই আগৈলঝাড়া উপজেলার কাঠিরা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শতীশ চন্দ্র রায় (৭০) আক্ষেপ করছিলেন।

শুধু সতীশ নন, আমরা ভুলে গিয়েছি ৪৫ জন শহীদকেও। ভুলে গিয়েছি হরেন মধুর বাড়িতে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে মেরে ফেলা হরেনের বাবা নারায়ণ মধু, কাকা মনোরঞ্জন মধু, জগীন্দ্র নাথ মধু, রনজিত মধুসহ ১৮ জনকেও। অবলীলায় ভুলে গিয়েছি কেতনার বিলের বধ্যভূমিতে নিহত দুই হাজারেরও বেশি শহীদের কথা। শহীদ লক্ষণ দাসের কথা। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বধ্যভূমিগুলো চেনাতে কোনও স্মৃতিস্তম্ভ নেই, শহীদস্মারক নেই, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের পূর্বসূরিদের এই নিঃশর্ত আত্মত্যাগের গল্প পৌঁছানোর কোনও উপায় নেই। যাদের ত্যাগে একটা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেলাম আমরা, কী প্রবল অকৃতজ্ঞতায় দিনের পর দিন বছরের পর বছর ধরে একটু একটু করে তাদের ভুলে যাই আমরা। আমাদের রক্তাক্ত জন্ম ইতিহাসের আত্মত্যাগ আর গৌরবগাঁথার উপাখ্যানেরা চাপা পড়ে যেতে থাকে নীরবে, নিঃশব্দে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

কেতনার বিলের গণহত্যা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর