Sunday 29 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একাত্তরের রোজা-রমজান


১০ এপ্রিল ২০২৪ ২০:০৩

বাংলাদেশে রোজার ঐতিহ্য মানে হাঁকডাকে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘুম ঘুম চোখে সেহরি খাওয়া। সন্ধ্যায় ছোলা–মুড়ি–খেজুর–শরবতসহ যথাসম্ভব আয়োজনে ইফতার। পাকিস্তানে অল্পবয়সী কিশোরেরা দল বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে গজল গেয়ে মুসল্লিদের ঘুম ভাঙায়। তুরস্কেও এ ধরনের সংস্কৃতি রয়েছে। তারা ঐতিহ্যবাহী অটোমান পাঞ্জাবি ও টুপি পরে ঢোল পিটিয়ে প্রার্থনা সংগীত গায়। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মুসলিমদেরও রমজানে কিছু আচার আছে। সেখানে সাহ্রির সময় যাঁরা ঘুম ভাঙান, তাদের ‘সাহ্রিওয়ালা’ বলে ডাকা হয়। তারাও পাড়া ও মহল্লার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ইসলামি সংগীত গান। ভারতে এই সংস্কৃতি ক্রমে কমে এলেও পুরোনো দিল্লিতে এখনও টিকে আছে। যার কিছুটা মিল আছে পুরান ঢাকার কাওয়ালি-কাসিদায়।

বিজ্ঞাপন

দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সংস্কৃতিতেও ভিন্নতা। সেই ভিন্নতার কারণেই এশিয়ার দেশগুলোয় ইফতারের সময় খাবারের পাতে থাকে নানা শোভা। মিসরীয়রা ইফতারের সময় ‘কাতায়েফ’ নামের একধরনের মিষ্টি খায়। দেখতে কিছুটা প্যানকেকের মতো। এটি বাদাম দিয়ে ভরা অত্যন্ত সুস্বাদু একটি খাবার। তুর্কিদের মিষ্টান্নের নাম আবার ‘বাকলাভা’। উজবেকিস্তানের মুসলমানরা রোজার সময় তাদের ঐতিহ্যবাহী তন্দুর চুলায় একধরনের মাখনের রুটি তৈরি করেন। এটাই তাদের ইফতারের ঐতিহ্যবাহী খাবার। মরক্কোর মানুষেরা আবার ইফতারে ‘হারিরা’ নামের একধরনের অতি উপাদেয় ও সুস্বাদু স্যুপ খায়। অনেকটা আমাদের দেশের হালিমের মতো। আবার আমাদের পুরান ঢাকার ‘বড় বাপের পোলায় খায়’–এর মতো একধরনের রুটি খেতে পছন্দ করে সিরিয়ার মানুষেরা। সেই রুটির নাম ‘মারুক’। পবিত্র রমজান মাসে টানা তিন দিন ধরে কুয়েতে চলে কারকিয়ানআন উৎসব। এখানে ছোট ছেলেমেয়েরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ঐতিহ্যবাহী গান গায়। সাহ্রি ও ইফতারের বাইরে রোজাকে ঘিরে আরও কিছু রেওয়াজ দেখা যায় দেশে দেশে। যেমন মিসরীয়রা তাদের রাস্তাগুলো সুন্দর সুন্দর কাচের লণ্ঠন দিয়ে সাজিয়ে রোজাকে স্বাগত জানায়। এসব লণ্ঠনের নাম ‘ফানুস’। এ ছাড়া মুসলিম–অধ্যুষিত দেশগুলোর প্রায় প্রতিটি বাজার এই রমজানে আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠে। ঘরে ঘরেও অনেকে চাঁদ–তারার অলংকার সাজিয়ে ঝুলিয়ে দেন। ঈদের আগে সবাই ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে ঝকঝকে তকতকে করে ফেলেন। ঈদ উপলক্ষে প্রায় সবাই সাধ্যমতো জামাকাপড় কেনা থেকে শুরু করে নানা ধরনের উপহারসামগ্রী ও কার্ড কেনেন এবং উপহার দেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘হক আল লায়লা’ নামে বিখ্যাত এক উৎসব রয়েছে। এটা তাদের রোজার ঐতিহ্য। যথাসাধ্য ও সংস্কৃতিতে বাঙালিরও রোজা-রমজানে কিছু ঐতিহ্য ছিল এবং আছে। সময় ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় কি ভাবা যায় একাত্তরের উত্তাল দিনে কেমন ছিল রোজার দিনগুলো? কেমনই ছিল একাত্তরের সেই ঈদ?

বিজ্ঞাপন

দিনপঞ্জিকা বলছে, গোলাবারুদের গন্ধমাখা একাত্তরে রোজা পড়েছিল অক্টোবর-নভেম্বরে। শুরু হয় ২২ অক্টোবর। আর ঈদ নভেম্বরে। সাধারণ ভাবনায় ভাবা কঠিন কেমন ছিল যুদ্ধগ্রস্ত সেই সংযম সাধনার মাস ও ঈদটি। সাধারণ বোধে মনে হতে পারে রমজানের চাঁদ দেখা গেলে বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা যা করে একাত্তরে মুসলমান বাঙালিরাও তা–ই করেছিল। সেহরি খেয়ে রোজা রাখার নিয়ত, দিনভর রোজা শেষে সন্ধ্যায় ইফতার। না, সেই বাস্তবতার আবহ ছিল না একাত্তরে। ইতিহাসে একাত্তরে বাঙালির শৌর্যবীর্যের বর্ণনা আছে। বিভীষিকার পর বিভীষিকা সইবার ঘটনা আছে। সে দিনগুলোতে একটি রমজান ও ঈদুল ফিতরেরর কিছু বিচ্ছিন্ন তথ্যও উঠে এসেছে কারো কারো লেখনিতে। পূর্ববাংলার মানুষের মরণপণ যুদ্ধ ও চারদিকে বিদীর্ণতার মাঝেও দিনপঞ্জিকার যথানিয়মে আকাশে পবিত্র রমজানের চাঁদ উঠেছে একাত্তরে। রোজা পালন হয়েছে। সিয়াম সাধনার পর ঈদ পালনও হয়েছে। অথচ এই রোজাদারদের ‘হিন্দু কা বাচ্চা’ বলে গাল দেওয়া ‘সাচ্চা মুসলমান’ দাবিদার পাকিস্তানি হানাদের মধ্যে সংযম দেখা যায়নি।

মহাঁপবিত্র মাস বিবেচনায় নিরীহ বাঙালি হত্যা-নিধনে একটু কমতিও দেয়নি ‘সাচ্চা মুসলমানরা’। বরং অকথ্য নির্যাতন, লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞের তীব্রতা আরো বাড়িয়েছে। এর বিপরীতে কোনও কোনও এলাকায় বিজয়ের নমুনাও দেখতে থাকে স্থানীয়রা। ওই সময়টাতে মুক্তিযোদ্ধারা কেউ ঘরে নেই। কেউ যুদ্ধে জানবাজ। কেউবা কোথাও অবরুদ্ধ। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর মতো পাকিস্তানি বাহিনী এ মাসেও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে, ভেঙেচুরে নিরীহ মানুষের বুকে সেঁটে দিচ্ছিল এক ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ। অগ্নিঝরা-ঝঞ্ঝাসংকুল সময়ে রোজাদাররা সাহ্রি সেরে আজান শুনেছেন। গুলির শব্দ-আর্তনাদও শুনেছেন।
সাহিত্যিক আবুল ফজলের দুর্দিনের দিনলিপিতে এর কিছু বর্ণনা রয়েছে। এতে তিনি লিখেছেন, ‘তারা কোনও দোষ করেনি, করেনি কারও কোনও ক্ষতি। কেউ নিয়মমাফিক অফিস করে, কেউ–বা বেচাকেনা করে, কেউ হয়তো আসন্ন ঈদের সওদা করে বাড়ি ফিরছে, অনেকেই রোজাদার, অতর্কিতে তাদের ওপরই কিনা নেমে এসেছে ছোরাছুরির মুখে এক অভাবনীয় মৃত্যু। কয়েক দিন ধরে চলেছে এ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড।’ হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডে মেলে রাজশাহী অঞ্চলের বর্ণনা। রাজশাহীর দুর্গাপুরের সরদার আবদুল মালেকের বরাত দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ‘পহেলা রমজান শুক্রবার পাকসেনারা গগনবাড়িয়ায় অপারেশন করে। এখানে ত্রিমুখী অভিযান চালিয়ে ১০–১১ শত জন লোককে ধরে আনে এবং তাদের দিয়ে গর্ত করানোর পর হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। কচি শিশুদের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের অপরাধ, তাদের মায়ের ওপর যখন পশুরা অত্যাচার করছিল, তখন তারা কাঁদছিল। এখানে ১০০ বছর পেরোনো এক অন্ধ বৃদ্ধকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। গ্রামে আগুন দিলে মেয়েরা যখন প্রাণভয়ে মাঠে পালায়, তখন সেখানেও তাদের ধরে শ্লীলতাহানি করা হয়। বাপের সামনে মেয়েকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে নির্যাতন করা হয়।’

দিনাজপুরের চিরিরবন্দর এলাকার পরিস্থিতির বিবরণে বলা হয়- ‘১১ রমজান খানসেনারা ও রাজাকাররা সোলায়মান গণি নামে একজনকে ঘর থেকে গ্রেপ্তার করে। শান্তি কমিটির সদস্যদের ইচ্ছায় তাকে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে মিছিলসহযোগে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। রাস্তায় রাইফেলের গাদা ও হাত দিয়ে বেদম প্রহার করা হয়। গ্রেপ্তার করা ছাড়াও তার বাড়িঘর লুটপাট এবং শেষে আগুন জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা হয়। থানায় নেবার পর পা উপরের দিকে লটকিয়ে লোহার রড দিয়ে অনবরত পেটানো হয়। সঙ্গে চলে কিল, ঘুষি ও লাথি। চার দিন, চার রাত সোলায়মান গণিকে থানায় আটকে রাখা হয় এবং রোজার দিন হওয়া সত্ত্বেও সাহ্রি ও ইফতারের জন্য কোনও খাবার দেওয়া হয়নি। ওই কদিন না খেয়ে তাকে রোজা থাকতে হয়েছে। বহুবার পানি চাওয়া হলেও পানি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। চতুর্থ দিন পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে সে ছাড়া পায়।’

কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার সম্পাদিত ১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সংকলনে বগুড়ার পীরবাড়িতে রমজান মাসে ঘটে যাওয়া বর্বরতার কিছু দুঃসহ স্মৃতিকথা উঠে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শী মো. তবিবুর রহমান, আবদুল হান্নান ও রহিমুদ্দিন ফকিরের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘২৩ রমজান (১৩ নভেম্বর, ১৯৭১) পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা সাহ্রির সময় পীরবাড়ি ও তার আশপাশের এলাকা ঘেরাও করে। বাড়ির মোট ৭ জন পুরুষ সদস্য ও গ্রামের অন্য পাড়ার যাকে যেখান থেকে ধরতে পেরেছে এমন ৪ জন, মোট ১১ জনকে পুকুরপাড়ে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ওই ১১ জন শহীদের মধ্যে ১৪ বছর বয়স্ক ৭ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত একজন কিশোর থেকে শুরু করে ৬৮ বছর বয়স্ক একজন অসুস্থ বৃদ্ধ লোক পর্যন্ত ছিলেন। উল্লেখ্য, এদের সবাইকে ধরা হয়েছিল সেহরি খাওয়ার সময়। কেউ সেহরি শেষ করেছেন, আবার কাউকে তার অর্ধসমাপ্ত সেহরি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, একজন ফজরের নামাজ পড়ার সময় চেয়েছিলেন কিন্তু পাকিস্তান ও ইসলামের রক্ষাকারী খাঁটি মুসলমানেরা তাদের সে সময় দেয়নি।’

মাহবুব আলম তার গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে (দ্বিতীয় খণ্ড) বইয়ে সেই ইফতারের স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন, ‘সোনারবান পৌঁছে যাই সন্ধ্যার মাগরেবের নামাজের সময়, রোজার ইফতারের সময় তখন। হুজুর ইফতারি নিয়ে বসেছেন। আমাদের দেখেই তিনি উঠে দাঁড়ান এবং ইফতারি জোগাড়যন্তর করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। হুজুরকে বলি, ৪–৫ জন ছাড়া কেউই রোজা নেই। তিনি বলেন, তাতে কী হয়েছে, রোজার দিনে ইফতার করা তো সওয়াবের কাজ। এরপর তার ঘরের সামনে লম্বা করে মাদুর বিছিয়ে তিনি সবার আয়োজন করেন। সবার জন্য ইফতারের প্লেট আসে। মুড়ি-চিড়া-গুড়সহযোগে সামান্য আয়োজন। কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে গভীর আন্তরিকতার ছোঁয়া। মসজিদে আজান হয়। হুজুর বলেন, “নেন বিসমিল্লাহ্ করেন।” আমরা সবাই হাত লাগাই প্লেটে। রমজান মাসের দিন শেষের এই শান্ত সমাহিত ক্ষণ একটা পরম পবিত্র লগ্ন হিসেবেই সবার কাছে ধরা দেয়।’

রণাঙ্গনের শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়েই অনেক মুক্তিযোদ্ধা রোজা রেখেছেন। নিয়মিত তারাবিহর নামাজও পড়েছেন। কোথাও রোজাদারদের জন্য আলাদা দল গঠন করা হয়েছে এবং তাদের ভারী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি যেদিন কোনও অভিযান থাকবে না, সেদিন সবাই রোজা রাখবেন—এমন সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের রোজা রাখার এই প্রবণতা নিয়ে মাহবুব আলমের উপলব্ধি হলো, ‘জন্ম থেকে বয়ে নিয়ে আসা ধর্মীয় অনুভূতি আর বিশ্বাস কি ঝট করে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায়? মুক্তিযুদ্ধ বা জয় বাংলার জন্য যে সংগ্রাম, তা তো আর ধর্মহীন হবার বা তার বিরুদ্ধে যাবার মতো কোনও ব্যাপার নয়। যার যা ধর্ম, সে সেটা পালন করুক। ছেলেদের ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুভূতি আমাদের যুদ্ধে বা সংগ্রামে কোনওই বিরূপ প্রভাব ফেলছে না।’

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার একাত্তরের দিনগুলিতে ঢাকায় ঈদের কেনাকাটার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন- ‘গতকাল বায়তুল মোকাররমের দোকানে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। আজকাল ঢাকায় এ রকম কোথাও কিছু হলে আমার বিস্তারিত খবর জানতে কোনও অসুবিধা হয় না…। দোকানের সামনে দাঁড়ানো তিনজন খানসেনা মরেছে, আরও কয়েকজন জখম হয়েছে। ফল হয়েছে বাকি দিন দোকানপাট সব বন্ধ। লোকের ঈদের কেনাকাটায় ছাই পড়েছে। বেশ হয়েছে।’

একাত্তরের রমজান মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেমে আসা নিস্তব্ধতার কথা আছে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের আমার আপন আঁধার বইয়ে। তিনি তখন থাকতেন মহসিন হলে। তার বর্ণনা এ রকম- ‘রোজার সময় বলেই সব দোকান বন্ধ। হোটেল তো বন্ধই, চায়ের দোকানও বন্ধ। হলের মেসও বন্ধ। ধর্মীয় কারণে নয়, নিতান্তই বাধ্য হয়ে হলের অনেকেই রোজা রাখছে। সেখানেও বিপদ আছে। বিকেলে ইফতারি কিনতে নিউমার্কেটে গিয়ে একজন মিলিশিয়ার হাতে বেধড়ক মার খেল। মিলিশিয়ার বক্তব্য, রোজার দিনে এই ছাত্র নাকি ছোলা ভাজা খাচ্ছিল।’

শহীদ বুদ্ধিজীবী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তার একাত্তরের ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর। আজ সকালে কিছুক্ষণ বসে প্রশ্নপত্র তৈরি করলাম কিছুটা। ১২.৩০টায় বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গেলাম। আজ জুমাতুল বিদা। দোয়া করা হলো। আজ রোজা রাখলাম। বিকেলে বোমার শব্দ। আজ আমরা আর কোথাও গেলাম না। কাল নাকি ঈদ হবে।’ তার বর্ণনাতেই বোঝা যায়, ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর, ঈদের আগের দিন ছিল পবিত্র জুমাতুল বিদা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেছিলেন তিনি। ‘কাল নাকি ঈদ হবে’-মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর এই বাক্যের ব্যবহার জানান দেয় কী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা ছিল তখন।

প্রথমা প্রকাশনের একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (প্রথম খন্ড)-এর এক বর্ণনা বলছে- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার কাইয়ুমপুরে মঈনুল হোসেন (বীর উত্তম)সহ আট জন মুক্তিযোদ্ধা রাতে আগেভাগে সেহেরি খেয়ে নিলেন। তারপর নিজেদের গোপন শিবির থেকে বেরিয়ে পড়লেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন মঈনুল হোসেন। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক প্রতিরক্ষা অবস্থানে মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ করবেন। রাতের অন্ধকারে দ্রুত এগিয়ে চললেন সেদিকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, লক্ষ্যস্থলে যাওয়ার আগেই তারা নিজেরাই পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের মুখে পড়লেন। অতর্কিত প্রচণ্ড মর্টার আক্রমণে থমকে গেল তাদের অগ্রযাত্রা। বিপর্যস্ত তারা। প্রাথমিক হকচকিত অবস্থা কাটিয়ে পাল্টা আক্রমণ করার আগেই পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে গেলেন তিনিসহ দুজন। পাকিস্তানিরা তার চোখের সামনেই দুই সহযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করল আর তার হাত-পা বেঁধে ফেলল। এরপর তার ওপর শুরু হলো নির্দয় নির্যাতন। নিষ্ঠুর নির্যাতনেও তিনি পাকিস্তানিদের কোনও তথ্য দিলেন না। পরে পাকিস্তানি সেনারা তাকেও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় হত্যা করে। এ এইচ এম আবদুল গাফফারের (বীর উত্তম) নির্দেশে তারা সেখানে অপারেশনে গিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুপ্তচরের মাধ্যমে এ খবর আগেই পেয়ে যায় এবং পাল্টা অ্যামবুশ করে।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক এক বর্ণনায় বলেছেন- ‘যত দূর মনে পড়ে একাত্তরের অক্টোবরের দিকে ক্যাম্পে ছিলাম। আর সে মাসেই রোজা আসে। আমাদের থাকার জায়গা বিশেষ করে সিলেটের কুলাউড়া, বড়লেখা, মৌলভীবাজারের দিকে। যখন যেখানে গিয়েছিলাম আমরা প্রায় রোজা রাখতে পেরেছিলাম। বয়সও কম ছিল, শরীরে শক্তি সামর্থও ছিল। চা বাগানের পাশে এলাকাবাসী ইফতার দেওয়ার চেষ্টা করতো। যুদ্ধ বিধ্বস্ত সময়েও আন্তরিকতা দেখাতো, বলত বাবারা আসো, বসো, একসাথে ইফতার করি। তাদের খুব আছে এমন না, তবু বলতো আমরা খুশি হতাম। আর ইফতার মানে চিড়া, মুড়ি, গুড় আর পানি। তা আমরা নিজেরাই সংরক্ষণে রাখতাম। সেহরী ইফিতার সাদামাটা হলেও মানিয়ে নিয়েছি। রমজান এলে আজও সে স্মৃতি ভাবায়।’

রণাঙ্গনের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের ‘একাত্তরের রণাঙ্গন: অকথিত কিছু কথা’ গ্রন্থে মুজিবনগর সরকারের ঈদ উদযাপনের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। তিনি লিখেছেন- মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তরের ছোট মাঠে এক অনাড়ম্বর পরিবেশে ঈদুল-ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীন বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে মুজিবনগরে খুব ঘটা করে ঈদুল-ফিতর উদযাপনের ব্যাপক প্রচার করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে মুসলিম দেশগুলোর কাছে ফ্যাসিস্ট পাকিস্তানিদের অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি দূর করার জন্যে। ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনা। কারণ, মুসলিম দেশগুলোর বিভ্রান্তি ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সৃষ্ট ভুল ধারণা মোচন করে তাদেরকে জানিয়ে দেয় যে বাংলাদেশের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, কোনও মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে বিধর্মীদের যুদ্ধ নয়। এটা স্বাধীনতাকামী একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়াই। ধর্মের দুশমন, মানবতার দুশমন এই ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধেই মুক্তিযুদ্ধ।
ঈদের দিনও মুসলমান নামের পাকিস্তানি হায়েনাদের হামলে পড়ার বেশ কিছু ঘটনা রয়েছে। একাত্তরের ঈদুল ফিতরের বর্ণনাও উঠে এসেছে কিছু প্রকাশনায়। একাত্তরে এ ঈদের তারিখ ছিল ২০ নভেম্বর। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় একাত্তরের সেই ঈদে আনন্দ ভাগাভাগি দূরে থাক, আনন্দ উপভোগের বিষয়আসয়ই ছিল না। বিশাল বধ্যভূমিতে যেখানে সারাক্ষণ মৃত্যুর তাড়া ঈদ আনন্দ সেখানে বাহুল্য হওয়াই স্বাভাবিক। সেদিনের মর্মস্পর্শী বর্ণনা জাহানারা ইমামের “একাত্তরের দিনগুলি” গ্রন্থে- রয়েছে এভাবে“…২০ নভেম্বর, শনিবার ১৯৭১। আজ ঈদ। ঈদের কোনও আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারো জামা-কাপড় কেনা হয়নি। দরজা-জানালা পর্দা কাঁচা হয়নি। ঘরের ঝুল ঝাড়ু হয়নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান। শরীফ, জামী ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি। …আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে! বাবা-মা-ভাই-বোন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়িতে! তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপিচুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবো। তাদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন্য এক শিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি…।”

ওই আনন্দক্ষণকে ঘিরেও দ্রোহের কাজ ঠিকই করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আকাশে ঈদের চাঁদ ওঠার সাথে সাথে স্বাধীন বাংলা বেতারে সমবেত কণ্ঠে বেজে ওঠে- ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও, ফিরে যাও।’ রক্তভেজা একাত্তরের ওই ঈদে মুক্তিযোদ্ধাদের জামাতে নামাজ আদায়ের অনেক নিদর্শণও রয়েছে। ঈদ-চাঁদেও হায়েনাদের বিশ্বাস নেই-সেই ধারনা ও অভিজ্ঞতা থেকে যুদ্ধের হাতিয়ার পাশে রেখে নামাজ আদায় করেছে মুসলিম মুক্তিযোদ্ধারা। আর পাহারা দিয়েছে হিন্দু মুক্তিযোদ্ধারা। সাম্প্রদায়িক সেই সম্মিলনই প্রকৃত বাংলাদেশ।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর ২০২৪ একাত্তরের রোজা-রমজান মুক্তিযুদ্ধ মোস্তফা কামাল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর