Sunday 29 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রত্নপ্রমাণ ও ইতিহাসের আলোকে কাবা’র মূর্তি


১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৪৫ | আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৫০

আরব শব্দটির অর্থ হচ্ছে- বালুকাময় প্রান্তর, ঊষর, ধূসর মরুভূমি বা লতাগুল্ম, তৃণশস্যহীন অঞ্চল। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই বিশেষ এক বৈশিষ্ট্যগত অর্থে আরব উপদ্বীপ এবং সেখানে বসবাসকারী মানব প্রজন্মের জন্য আরব পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

আরবের পশ্চিমে লোহিত সাগরে ও সামায়েন সীনা উপদ্বীপ, পূর্বে আরব উপসাগর, দক্ষিণে আরব সাগর, যা ভারত মহাসগরের বিস্তৃত অংশ, উত্তরে শাম দেশ বা সিরিয়া এবং উত্তর ইরাকের কিছু অংশ।

বিজ্ঞাপন

সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ ও সার্বিক বিবেচনায় পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে আরব ভূমির অবস্থান। ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগত বিশেষ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আরববাসীদের উদার, উন্মুক্ত মানবিক চেতনা, অতিথি পরায়নতা, সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবযাত্রা, আমানত গচ্ছিত রাখার অনপনোদনীয় উপযুক্ততার পেক্ষাপটে আরব ভূমি ছিল ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু আর আরব জাতি ছিল আল্লাহ’র পবিত্রতম আমানত ইসলামকে হেফাজত করার উপযুক্ত মানবগোষ্ঠী। আরবি ভাষাকে আল্লাহ’র বাণী ধারণ ও বহনের উপযুক্ত ভার আর আরব সম্প্রদায়ের মধ্যে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তিটিকে নবুওয়াত ও রিসালাতের উপযুক্ত বিবেচনা সাপেক্ষে ইসলামের আয়োজন ও বাস্তবায়নধারা সূচিত হয়েছিল।

পৌত্তলিকতা, অশ্লীলতা, শিরক, বিদ’আত ও বহুত্ববাদের জমাট অন্ধকার ভেদ করে চির ভাস্বর ও চির জোতিষ্ময় ইসলামের সূর্য যখন নবায়িত আলোর বন্যায় উদ্ভাসিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করল তখন প্রচলিত সকল বিশ্বাস এবং মতবাদের অনুসারীগণ একদম হতচকিত হয়ে পড়ল। সর্বশেষ আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সুললিত শাশ্বত বাণী এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উদাত্ত কণ্ঠের তাওহীদের ঘোষণা সকল ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তিমূলকে করে তুলল প্রকম্পিত। যে সকল মুশরিক ও পুতুল পূজক শিরক ও পৌত্তলিকতার পাপে নিমজ্জিত থেকে দাবি করত যে, তারা দ্বীন-ই ইবরাহিম (আ.) ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাদের এ বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে প্রচণ্ড কুঠারাঘাত পড়ল।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু, অসংখ্য নবী-রাসূলের জন্মভূমি আরব কীভাবে মুশরিক ও পুতুল পূজক শিরক ও পৌত্তলিকতার দিকে ধাবিত হল, তা নিয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে লৌকিক, অলৌকিক ঘটনার বিস্তর বর্ণনা মানব জাতির সামনে এলেও প্রত্নপ্রমাণ এবং ইতিহাসের আলোকে চুলচেরা বিশ্লেষণ খুব কমই হয়েছে। আলোচনা যতটা না যুক্তি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রত্নগবেষণা বা ইতিহাস নির্ভর, তার চেয়ে অনেক বেশি ধর্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে এগিয়েছে!

প্রত্ন ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণার ভিত্তিতে ইতিহাসবিদগণ মানব প্রজন্মের নিরিখে আরব সম্প্রদায়সমূহকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। যথা—১. আরবে বায়িদা, ২. আরবে আরিবা, ৩. আরবে মুস্তারিবা। আরবে বায়িদার অন্তর্ভুক্ত ছিল আদ, সামুদ, তাসাম, জাদিস এবং আমালিকা সম্প্রদায়। ইতিহাস থেকে এরা একেবারে নিঃশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এরা এমনভাবে ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে যে, পতনের পর উত্থানের আর কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে আরবে আরিবা হচ্ছে ইয়াশজুব বিন ইয়া’রুব বিন কাহতানের বংশধর। এদেরকে কাহতানী আরব বলা হয়। এদের আদি নিবাস ছিল ইয়ামেনে। এক সময় তাদের বংশধররা বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরমধ্যে হিমইয়ার বিন সাবা ও কাহলান বিন সাবা নামে দুইটি গোত্র প্রসিদ্ধি লাভ করে।

আরবের তিন নম্বর ধারাটা হল- আরবে মুস্তারিবা। এরা হচ্ছে ওইসব সম্প্রদায়, যারা হযরত ইসমাঈল (আ.) এর বংশধারা থেকে এসেছে। এদেরকে আদনানী আরবও বলা হয়। এই বংশধারাই জন্ম হয়েছিল শেষ নবী মুহাম্মদ (স.)-এর।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ মাখলুক সৃষ্টি করেন এবং আমাকে সর্বোত্তম দলভুক্ত করেন। তারপর গোত্রসমূহ নির্বাচন করা হয় এবং এক্ষেত্রেও আমাকে সর্বোত্তম গোত্রের মধ্যে শামিল করা হয়। এরপর পারিবারিক মর্যাদার ওপর দৃষ্টি দেওয়া হয় এবং এক্ষেত্রেও আমাকে অত্যন্ত মর্যাদাশালী পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অতএব আমি আমার ব্যক্তিসত্তায় যেমন উত্তম, বংশ মর্যাদার ব্যাপারেও তেমনি সকলের চেয়ে উত্তম।’

ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের (৭০৪-৭৭০ খ্রি:) মতে, আরবে বসবাসকারী মানুষজন হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর দাওয়াত ও প্রচারের ফলে হযরত ইবরাহিম (আ.) প্রচারিত দ্বীনের অনুসারী ছিল। এ কারণেই তারা ছিল আল্লাহ’র একত্ববাদে বিশ্বাসী। তারা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করত। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তারা আল্লাহর একত্ববাদ এবং খালেস দ্বীনী শিক্ষার আবশ্যকীয় অংশ ভুলে যেতে থাকে। দ্বীনের শিক্ষা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে। তবুও তাদের মধ্যে আল্লাহ’র একত্ববাদ ও দ্বীনে ইবারাহিম (আ.)-এর কিছু বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট ছিল। ইত্যবসরে বনু খোযা’আ গোত্রের সর্দার আমর বিন লুআই দৃশ্যপটে আসেন। ধর্মীয় মতাদর্শের লালন ও পরিপোষণ, দান খয়রাত এবং ধর্মীয় বিষয়াদির প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। এ কারণে লোকজন তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতে থাকে। তাকে উঁচু মাপের আলিম এবং সম্মানিত ধর্মীয় নেতার মর্যাদা দেওয়া হত। সবাই তার অনুসরণ করত।

এক পর্যায়ে তিনি শাম দেশে ভ্রমণে যান। সেখানে গিয়ে মূর্তি পূজা-আর্চনার ব্যাপক চর্চা হতে দেখেন। যেহেতু শাম দেশ বহু নবী রাসূলের জন্মভূমি এবং অহি নাজিলের স্থান। কাজেই সেখানকার মূর্তি পূজাকে তিনি অধিকতর ভাল বা সত্য বলে ধারণা করেন। দেশে ফিরে আসার সময় তিনি ‘হোবল’ নামক মূর্তি সঙ্গে নিয়ে আসেন। সেটা খানায় কাবা’র মধ্যে রেখে ভক্তি ভরে পূজা-আর্চনা শুরু করেন এবং মক্কাবাসীকেও এর পূজা-আর্চনা করার আহ্বান জানান। মক্কাবাসীগণ তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মূর্তি হোবলের পূজা করতে শুরু করে। হিযাজবাসীগণও মক্কাবাসীর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে লাগল। কারণ, তারাও এক সময় বায়তুল্লাহ’র অভিভাবক এবং হারামের বাসিন্দা ছিল। এভাবে একত্ত্ববাদী আরববাসী মূর্তি পূজার দিকে ধাবিত হয়। আরব ভূমিতে সূচনা হয় মূর্তি পূজার।

হোবল ছাড়াও আরবের প্রাচীন মূর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘মানাত’। লোহিত সাগরের তীরে কোদাইদ নামক এলাকায় মুসাল্লাম নামক স্থানে এটি স্থাপন করা হয়। এরপর তায়েফে ‘লাত’ নামক মূর্তি স্থাপন ও তার পূজো শুরু হয়। পরে নাখলা নামক উপত্যকায় ‘উযযা’ নামক মূর্তি স্থাপন করে পূজা চলতে থাকে। এ তিনটি ছিল আরবে সবচেয়ে বড় ও প্রসিদ্ধ মূর্তি। এরপর হিযাজের বিভিন্ন স্থানে মূর্তি পূজার ব্যাপক বিস্তার ঘটতে থাকে।

উল্লিখিত মূর্তিগুলো ছাড়াও আরব ভূমিতে মূর্তি স্থাপন নিয়ে আরও কিছু বর্ণনা ইতিহাস এবং সিরাত গ্রন্থে পাওয়া যায়। বলা হয়ে থাকে, নূহ সম্প্রদায়ের মূর্তি ‘ওয়াদ্দ’, ‘সোওয়া’, ‘ইয়াগুস’, ‘ইয়াউক’ ও ‘নাসর’ জেদ্দার ভূমিতে প্রোথিত ছিল। এ মূর্তির খোঁজ পেয়ে আমর বিন লুআই জেদ্দায় গিয়ে মাটি খনন করে মূর্তিগুলোকে বের করে তেয়ামায় নিয়ে যান এবং পরবর্তী হজ্ব মৌসুমে সেগুলো বিভিন্ন গোত্রের হাতে তুলে দেন।

এভাবে একেকটি মূর্তি একেক গোত্রের হাতে আসে। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন গোত্রের লোকদের ঘরে ঘরে মূর্তি স্থান পেয়ে যায়। অতঃপর মক্কার মুশরিকগণ একের পর এক মূর্তি দিয়ে মসজিদুল হারাম পরিপূর্ণ করে তোলে। কথিত আছে যে, মক্কা বিজয়ের পূর্বে মসজিদুল হারামে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। মক্কা বিজয়ের পর রাসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূর্তিগুলো ধ্বংস করেন।

ইসলামপূর্ব যুগে লোকজনদের মধ্যে মূর্তি পূজার বিশেষ বিশেষ রীতি-পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এসবের অধিকাংশই আমর বিন লুআই-এর মনগড়া রীতি-পদ্ধতি। ইবনে লুআই প্রবর্তিত মূর্তিপূজকের দল মনে করত যে, দীনের ক্ষেত্রে তিনি যে রীতি-পদ্ধতির কথা বলেছেন, তা ইবরাহীম (আ.) প্রবর্তিত দ্বীন-এর পরিবর্তন কিংম্বা বিলোপ সাধন নয়। বরং সেটা হচ্ছে ভালর জন্য কিছু কিছু নবতর সংযোজন।

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

আসাদ জামান ঈদুল ফিতর ২০২৪ নিবন্ধ প্রত্নপ্রমাণ ও ইতিহাসের আলোকে কাবা’র মূর্তি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর