শতবছর আগে যে জ্বর কেড়েছিল ৫ কোটি প্রাণ
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৫৬
বোম্বাই শহর। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর। হঠাৎ দেখা গেল কিছু মানুষ ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে আক্রান্তরা মারা যাচ্ছে। পত্রিকাগুলো সংবাদ করতে লাগল। ব্রিটিশ প্রশাসন নড়ে চড়ে বসল। শুকনোর দিন সামনে। মশার উপদ্রব বেড়েছে। ব্রিটিশ অফিসাররা ভাবলেন, মশা থেকে হয়ত এ জ্বর হচ্ছে। তারা লোকজন লাগাল ঝোপঝাড় কাটতে। কিন্তু আক্রান্ত হু হু করে বাড়তে লগল। কিছুদিন পর জানা গেল এটা মশা থেকে ছড়ায় না। এটা বিশ্বজুড়ে চলমান এক প্যানডেমিক বা অতিমারির প্রভাব। যার নাম স্প্যানিশ ফ্লু। বোম্বের জাহাজ থেকে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে বলে ভারতীয়দের কাছে এর নাম হয় বোম্বে জ্বর।
অক্টোবর নাগাদ সারা দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়ল এ ফ্লু। ভারতের ইতিহাসে একে স্পেনিশ ফ্লুর ভয়ংকর ৯০ দিন বলা হয়। এতে ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ মারা যায় বলে ধারণা করা হয়। যা সে সময়ের ভারতের মোট জনসংখ্যার সাড়ে ৪ থেকে ৬ শতাংশ মানুষ। পৃথিবী জুড়ে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫ কোটি মানুষ। বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে মৃত্যু সংখ্যা তুঙ্গে ওঠে ১৯১৮-র সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে অক্টোবরের মাঝামাঝি আর কলকাতা প্রেসিডেন্সিতে নভেম্বরের মাঝামাঝি। তরুণরা আর মেয়েরাই এতে বেশি মরেছিল।
ধারণা করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানাসাস শহর থেকে এটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। এক অঞ্চলের সৈনিক আরেক অঞ্চলে যাচ্ছিল। সুয়েজ খাল খুলে দেওয়ার ফলে ভারতের সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগ সহজ হয়ে যায়। বোম্বে সুয়েজ খাল থেকে ৩২০০ নটিক্যাল মাইল দূরে হওয়ায় ইউরোপ থেকে আসা সব জাহাজ বোম্বেতেই নোঙ্গর করত। ফলে ইউরোপ থেকে আগত মানুষে ভরপুর ছিল বোম্বে শহর।
ইউরোপে এ ফ্লু ছড়ায় ফ্রান্সের এক সেনাঘাঁটি থেকে। কানাডার বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মার্ক হামফ্রিস মনে করেন, চিন থেকে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সে কাজ করতে আসা ৯৬ হাজার শ্রমিকই ছিলেন এই সংক্রমণের মূল উৎস। ভারতবর্ষেও এই রোগের প্রভাব পড়েছিল মারাত্মক।
কিন্তু প্রথম প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন এ ফ্লু’র কথা চেপে যায়। কারণ তখনও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছাইচাপা আগুন রয়ে গেছে। সৈনিকদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে গেলে বিপদ। এ কথা প্রথম ফাঁস করে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার যুদ্ধনিরপেক্ষ দেশ স্পেনের সংবাদপত্র। তাই এ ফ্লু’কে স্প্যানিশ ফ্লু বলা হয়। অথচ এ ফ্লু’র সঙ্গে স্পেনের কোন যোগসূত্র নেই।
এ ফ্লুয়ের ভয়াবহতা বোঝা যায় ভারতের গড় আয়ুর পরিসংখ্যান দেখলে। এর প্রভাবে ১৯২০ সালে ভারতের মানুষের গড় আয়ু কমে ২১-এ নেমে আসে। এর আগে ভারত জুড়ে ১৮৭৬-৭৮ পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। তখনও গড় আয়ু এতো কমেনি। ২২ এর কাছাকাছি চলে এসেছিল। ফ্লু’র প্রভাব কাটতে না কাটতে হু হু করে মানুষের গড় আয়ু বাড়তে থাকে। মাত্র ৫ বছরে ৫.৭৫ বছর বেড়ে যায়। ফ্লু ও মহামারিতে ভারতের ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৯১১-১৯২১ সালের আগে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধিহার নেমে আসে ১.২ শতাংশে, যা ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।
এ ফ্লুতে উচ্চবিত্ত ও ইউরোপীয়রা খুব একটা মারা যায়নি। মরেছে ভারতের দরিদ্র মানুষ। প্রতিদিন শহরে শত শত শবযাত্রা হতো। পোড়ানোর মতো যথেষ্ট কাঠ ছিল না বোম্বাই শহরে। হিন্দি কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী ‘নিরালা’ (১৮৯৬-১৯৬১) তার জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, গঙ্গা নদী লাশে থিকথিক করছিল। কারণটা অতি সরল, অত মড়া পোড়ানোর কাঠ ছিল না। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় ভারতে মৃত্যুর হার ছিল অধিক। ভারতে হাজারে প্রায় ৬২ জন মানুষ মারা যায়। সেখানে ইংল্যান্ডে সে সংখ্যা ছিল ৮।
আক্রান্ত হয়ে পড়েন মহাত্মা গান্ধীও। তৎকালীন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রোগের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রাদুর্ভাব ছিল বেশি মারাত্মক, এমনকি মহাত্মা গান্ধীও তার জীবনীতে দ্বিতীয় দফার প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন। চারদিকে এতো মৃত্যু দেখে মহাত্মা গান্ধী লিখেছিলেন, বাঁচার আগ্রহ চলে যাচ্ছে।
বাংলার সাধারণ দরিদ্র পরিবারের পাশাপাশি সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতেও এ জ্বর দেখা দেয়। শান্তিনিকতনে অবস্থানরত ঠাকুর বাড়িতেও এ জ্বর হানা দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ো ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলের বউ সুকেশী দেবী ২ জানুয়ারি ১৯১৯ মারা যান। আক্রান্ত হন প্রতিমা দেবী ও হেমলতা দেবী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরমবন্ধু অজিতকুমার চক্রবর্তী মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ফ্লুতে মারা যান। ২৯ ডিসেম্বর ১৯১৮ রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘অজিতের অবস্থার কথা শুনে মন বড় উদ্বিগ্ন হল। বুঝতে পারছি কোনও আশা নেই এবং এতক্ষণে হয়ত জীবনাবসান হয়ে গেছে। অল্প বয়স থেকে ও আমার খুব কাছে এসেছিল– ও যদি চলে যায় ত একটা ফাঁক রেখে যাবে।’
অনেকেই চিন্তিত হয়ে যান শান্তিনিকেতনের নিভৃতপল্লীতে এ রোগ হানা দিলো কি করে? এ তো বোম্বে থেকে অনেক দূর। এসথার ফেরিং নামে এক ইংরেজির শিক্ষিকা কিছুদিন আগে মাদ্রাজ থেকে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। ধারণা করা হয় তিনিই ছিলেন এ ফ্লু’র বাহক।
এই অতিমারির তীব্রতা, বিস্তারের গতি এবং স্থায়িত্ব অনুমান করতে তৎকালীন ন’টি প্রদেশের ২১৩ টি জেলায় সাপ্তাহিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান ভিত্তিক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। সেই গবেষণাপত্রের লেখকরা বলছেন, তাদের অনুমানের উদ্দেশ্য হলো স্থান এবং সময়ভিত্তিক তথ্য ব্যবহার করে ১৯১৮ সালের অতিমারির বিস্তার, মৃত্যুর হার এবং বিবর্তনের চরিত্র নির্ধারণ করা (‘The Evolution of Pandemic Influenza: Evidence from India, 1918-19’, by Siddharth Chandra and Eva Kassens-Noor: BMC Infectious Diseases, 4, 510 (2014))।
গবেষণায় যে চারটি মূল তথ্য প্রকাশ পায়, তা হলো-
(ক) যত দিন যায়, তত কমে আসে অতিমারির তীব্রতা;
(খ) অতিমারির গতি হ্রাস পায়, অর্থাৎ রোগের আবির্ভাব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অতিবাহিত সময় বৃদ্ধি পায়;
(গ) তবে অতিমারির মেয়াদ বৃদ্ধি পায়;
(ঘ) ভারতের পূর্বভাগে অতিমারি সবচেয়ে শেষে এসে পৌঁছয়।
কিন্তু আশ্চর্য বিষয় এতো মানুষের মৃত্যু যে অতিমারিতে মারা গেল, তা নিয়ে খুব একটা লেখালেখি হয়নি সাহিত্যে। এমন মহামারির মধ্যেও ভারতের বড়ো বড়ো রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো অব্যাহত ছিল। ব্যাপারটা খুব বিস্ময়কর।
তথ্যসূত্র:
theconversation.com
www.statista.com|
www.telegraphindia
en.wikipedia.org
www.anandabazar.com
bengali.indianexpress.com
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা
সারাবাংলা/এসবিডিই
জয়দীপ দে শাপলু ফিচার বিচিত্রা শতবছর আগে যে জ্বর কেড়েছিল ৫ কোটি প্রাণ