Sunday 29 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শাফী ইমাম রুমী, দেশের জন্য যাকে উৎসর্গ করেছিলেন মা

রাতিন রহমান
৩০ আগস্ট ২০২৩ ১৫:২০

‘আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকা পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাবো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে বিবেক চিরকালের মত অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইন্জিনিয়ার হবো, কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনদিন ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?’

“জননী জাহানারা ইমাম তার দুই চোখ জোরে বন্ধ করে বললেন, ‘না, তা চাই নে। ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধেই যা। ’” জীবনের শেষমুহুর্ত পর্যন্ত আম্মা আফসোস করতেন, কেন তিনি কোরবানি শব্দটা ঊচ্চারন করেছিলেন সেদিন! হয়তো সে কারনেই আর তার আদরের ধন ফিরে এলো না। মায়ের মন, আহারে!

বিজ্ঞাপন

উপরের সংলাপগুলো কাল্পনিক নয়, কোন সংলাপ বুদবুদে ভাসা আবেগের আতিশয্য নয়, গল্প নয়, গল্পের মত সত্য, কোন এক অলৌকিক উপায়ে হয়ে যাওয়া আমাদের সবার গল্প।

ভাষা আন্দোলনের আগের বছরের ২৯ মার্চ ছেলেটির জন্ম। রুমী খুব সহজে পৃথিবীতে আসেনি। দীর্ঘ ১৪ ঘন্টা গর্ভধারিনী মা’কে কষ্ট দিয়ে নিজেও কষ্ট পেয়ে এক বৃহস্পতিবারের দুপুর সাড়ে বারোটায় পৃথিবীর আলো দেখেছিল। সে সময়ের উচ্চবিত্ত পরিবারের একজন বাঙালি সন্তানের মতোই ছিল সে। গড়নে সব সময় পাতলা; পোশাক, পরিচ্ছদে পরিপাটি, চেহারার আভিজাত্যবোধ কিন্তু নীতিনিষ্ঠ রুমী জীবনে সব ভালোকিছুর প্রতি আগ্রহী ছিল। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ের পরেই রুমীর বাহ্যিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে রুমী ছুটে গিয়েছিল দেশের দিক থেকে দিগন্তে।

তারপর দেশে একাত্তর, এলো মার্চের সংগ্রাম। পহেলা মার্চ যখন ইয়াহিয়া অধিবেশন বানচাল করার ঘোষণা দিলেন, রেডিওতে সেই রুমীই ঢাকা স্টেডিয়ামে চলতে থাকা ক্রিকেট ম্যাচ বাদ দিয়ে চলে এসেছিল বটতলায়, পরবর্তী করনীয় কি হবে জানতে। আবার মুহুর্তেই বন্ধুর মোটরবাইকের পেছনে চড়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিল আন্দোলনের ঢাকার খবর জানতে। খেতে ভালবাসতো যে ছেলেটি, সেদিন মায়ের হ্যামবার্গারের কথাও ভুলে গিয়েছিল সে দেশের জন্য। ৭মার্চের ভাষন শুনে বাড়ি ফিরে মাকে চোখ বড় বড় করে সে গল্প শুনিয়েছিল সে। তবে হতাশ গলায়। আশাহত রুমী যুদ্ধ চাইছিল।

বিজ্ঞাপন

‘আম্মা বুঝতে পারছ না, মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এটা ওদের সময় নেবার অযুহাত মাত্র। ওরা আমাদের স্বাধীনতা দিবে না। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে সশস্ত্র সংগ্রাম করে।’ -কথাটা রুমী বলেছিলেন যুদ্ধ শুরু হবার আগে। চে গুভেরার ভক্ত আর মাও সে তুং নখদর্পনে নিয়ে ফেলা রুমী ঠিকই বুঝতে পেরেছিল কি হতে যাচ্ছে আর আমাদের কি করতে হবে।

বেঁচে থাকতে শেষ জন্মদিনটা ভালো কাটেনি রুমীর। যে পিতা নেপথ্যে থেকে পুত্রকে স্বাধীকার আন্দোলনের শরিক করলেন এবার তিনি বেড়িয়ে এলেন প্রকাশ্যে। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে পুত্রের ২০তম জন্মদিনে তাকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন দেশের জন্য। জন্মদিনে রুমীকে তার বাবা শরীফ ইমাম ও মা জাহানারা ইমাম একটি চিঠি লিখেন,

“‘চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছি বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিতকনা শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’। এই অশুভ সময়ে তোমার শুভ জন্মদিনে তাই চিরাচারিতভাবে বলবো না বড় হও, সফল হও, সুপ্রতিষ্ঠিত হও। তা উচ্চারণ করতে পারবো না। তার বদলে মাল্যধ্বণি উচ্চারণ করছি, ব্রজের মত হও, দীপ্ত শক্তিতে জেগে উঠো, দেশের অপমান দূর কর। দেশবাসীকে তার যোগ্য সম্মানের আসনে বসাবার দুরহ ব্রতে জীবন উৎসর্গ কর।

– ইতি তোমার আব্বু ও আম্মু”

১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মাকে রাজি করিয়ে ২মে রুমী সীমান্ত অতিক্রমের প্রথম প্রয়াস চালান। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাকে ফেরত আসতে হয় তবে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সফল হন। পড়েছিলেন কে ফোর্সের খালেদ মোশাররফের হাতে। খালেদ মোশাররফ ক্যাপ্টেন হায়দারের হাতে তুলে দেন রুমীদের। একজন রুমীর ‘বীর রুমী’ হয়ে ওঠার পেছনে ক্যাপ্টেন হায়দারের অবদান বোধহয় সবচেয়ে বেশী। ট্রেনিং শেষে রুমীর অবদান নতুন করে বলা হয়তো লাগে না, কারণ তারপরের তার জীবনের প্রতিটি পরিচ্ছেদ বাংলাদেশের সোনালী ইতিহাসের পাতায় পাতায় মহাকাব্যের অংশ হয়ে আছে।
মেলাঘর থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসার পর জুয়েল, বদি, আলম, মায়া, কাজী কামালদের সাথে রুমিও ঢাকায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অপারেশনে যোগ দেয়। এর মধ্যে আগস্টের ২৫ তারিখে ধানমন্ডির বিভিন্ন রোডে মোবাইল টার্গেটে অপারেশন ‘ডেস্টিনেশন আননোনে’ রুমির অভাবিত বীরত্বগাঁথা তোলপাড় তোলে শহরজুড়ে। অপারেশন সেরে ফিরে আসার সময় স্রেফ রুমির প্রত্যুৎপন্নমতিতা এবং চোখের পলকে ফায়ারিংয়ে সেদিন উল্টে যায় পিছু ধাওয়া করে আসা পাকিস্তানি সেনাদের একটা জীপ। পাকিস্তানিরা সম্মুখীন হয় অচিন্তনীয় ক্ষতির। মার কাছে সে গল্প করতে গিয়ে রুমি বলেছিল,

‘আম্মা দেখো আমার ঘাড়ে, কাঁধে স্টেনগান থেকে আগুনের ফুলকি ছুটে কি রকম ফোসকা পড়ে গেছে। রাস্তায় মিলিটারী ধরলে এইটার জন্যই ফেঁসে যাব। ’

কে-ই-বা জানত দু’দিনের মাথায় রুমির মুখের কথাটাই সত্য হয়ে যাবে। ২৯শে আগস্ট রাতে পাকিস্তানি সেনাদের সাঁড়াশি অভিযানে ধানমন্ডির কনিকা থেকে ধরা পড়ে রুমী। সাথে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বাবা শরীফ ইমাম, ভাই জামী, খালাতো ভাই মাসুমসহ কয়েকজনকে। ক্র্যাক প্লাটুনের বাকি সহযোদ্ধাদের সাথে অকথ্য নির্যাতন চলে তাদের উপর। উনিশ বছর বয়সী রুমি বাবা আর ভাইসহ সবাইকে বলে দিয়েছিল, কেউ যেন কোন কথা না বলে।

নিজের ঘাড়ে সকল দায় নিয়ে বাকি সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল ও। অকথ্য অবর্ননীয় নির্যাতনের মুখেও একটা তথ্যও দেয়নি, ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল, “You people are going to die. You can’t flee, you can’t leave-Nobody can save you. I can’t tell you this much.”

রুমীকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনেকেই রুমীর বাবাকে ইয়াহিয়ার নিঃশর্ত ক্ষমার সুযোগ নিতে বলেছিলেন। কিন্তু রুমীর ধমনীতে যে তার বাবার রক্ত। ছেলেকে আর কখনও ফিরে না পাবার নির্মম বাস্তবতা বুকে চেপে বাবা শরীফ ইমামও পাক হানাদার সরকারের কাছে মাথা নিচু করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। প্রাণভিক্ষা চাননি, চাননি এতটুকু করুণা।

এ এমন পিতার গল্প, যিনি শত অপমান বেত্রাঘাতেও টলেননি এতটুকু। এ এমন জননীর গল্প, যিনি কাহলিল জিবরানের ‘প্রফেট’ থেকে লাইন আউড়ে মনকে শক্ত করেছেন। পুরো পরিবার যেন ‘নীলকণ্ঠ’! পুরাণে এক দেবতা বিষ নিজের গলায় ধারণ করে বাঁচিয়েছিল বিশ্ব, নিজে হয়েছিল নীলকণ্ঠ। এই পরিবার, এই গল্প, এই পিতা-পুত্র-জননীরাও যেন তাই। আমাদের দুর্ভাগ্য দখলদার হানাদার হায়নাদের নষ্ট বীজ আজও বিষবৃক্ষ ছড়িয়ে আছে শ্যামল বাঙলায়; যার জন্য আমাদের জননীকে পেতে হয় রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিধা। এরচেয়ে বড় জঘণ্য অনাচার আর কি হতে পারে!

ধরা পড়ার আগের কোলে মাথা রাখা রুমিকে মা বলেছিল, কত বয়স তোর। পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না, জীবনে কিছুই তো জানলি না। রুমী মুখ তুলে কেমন যেন এক রকম হাসি হাসল, মনে হল অনেক বেদনা সে হাসিতে। একটু চুপ থেকে বললো,

‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন একটা কথা আছে না আম্মা। হয়তো জীবনের পুরোটা তোমাদের মত জানি না, ভোগও করিনি কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য-তিক্ততা সব কিছুর স্বাদ আমি এরমধ্যেই পেয়েছি আম্মা। যদি চলেও যাই কোনও আক্ষেপ নিয়ে যাবো না। ’

রুমি আর ফিরে আসেনি। কখনও না।

তথ্য কৃতজ্ঞতা:
১। একাত্তরের দিনগুলি: জাহানারা ইমাম
২। ব্রেইভ অফ হার্ট: হাবিবুল আলম বীর প্রতীক

সারাবাংলা/এসবিডিই

ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রাতিন রহমান শাফী ইমাম রুমী- দেশের জন্য যাকে উৎসর্গ করেছিলেন মা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর