সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌকা চলে ধীরে। চারপাশে কেওড়া–গরান, নোনা পানির গন্ধ আর নিস্তব্ধতা। হঠাৎ কেউ ফিসফিস করে বলে ওঠে— ‘ওই নামটা মুখে আনবেন না!’ কেন? কারণ, সে বাঘ।
না— স্থানীয়রা তাকে বাঘ বলে না। বলে মামু, মামা, বড়মিয়া, কেউ কেউ বলে বাংলেট। নাম নিলে নাকি সে শুনে ফেলে!
সাইবেরিয়া থেকে সুন্দরবন
এই ভয়ংকর অথচ রাজকীয় প্রাণীর আদিবাস সাইবেরিয়া। সেখান থেকে যুগে যুগে ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়ার নানা প্রান্তে। রঙ বদলেছে, গড়ন বদলেছে। কিন্তু যারা এসে ঠাঁই নিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে— সুন্দরবনের স্রোতজ বনভূমিতে— তারা হয়ে উঠেছে দৈত্যাকায়।
কারণ কী? খাবার!
শূকর আর হরিণের টানেই তারা থেকে গেছে এখানে। অভাব ছিল, তাই শক্তি বাড়াতে হয়েছে— প্রকৃতিই তাদের বানিয়েছে সুপার পাওয়ারধারী।
শক্তির গল্প, ভয় ধরানো অঙ্ক
সুন্দরবনের বাংলেটের থাবা মানে— এক কোপে মানুষের মাথার খুলি চৌচির।
চোয়াল? ডিমের খোসার মতো মাথার খুলি ভেঙে ফেলে।
একটি পূর্ণবয়স্ক মহিষ মারতে সময় লাগে মাত্র ৫ মিনিট।
হরিণ? ২ মিনিট।
গায়ের জোর এমন যে, শরীরের সম্পূর্ণ ওজন দিয়ে সামনের দুই পা মহিষের ঘাড়ে রাখলেই— ঘাড় ভেঙে যায়।
এদের ডাঙার পিঁপড়া বলা যায়। কারণ, নিজের ওজনের তিন গুণ ভারী শিকার মুখে বা থাবায় নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে নিজের ডেরায় চলে যায়।
বাদা— বাঘের রাজ্য
স্থানীয় ভাষায় বাদা মানে বাঘের রাজ্য।
আর বাঘের আদিনাম? বাংলেট।
হিন্দু–মুসলিম নির্বিশেষে সুন্দরবনে কেউ সরাসরি ‘বাঘ’ শব্দ উচ্চারণ করে না। বিশ্বাস— নাম নিলেই সে হাজির!
গর্জন, যা সাহসও গলিয়ে দেয়
বলা হয়— বাংলেটের গর্জন শুনে অনেক জওয়ান, সাহসী মানুষ পর্যন্ত ভয়ে প্রস্রাব করে ফেলেছে। এটা শুধু ভয় নয়, এটা আদিম আতঙ্ক— মানুষের ডিএনএতে লেখা এক শিকারির ডাক।
সুন্দর কিন্তু মারাত্মক
ছবিতে তাকে দেখতে সুন্দর, প্রায় রাজকীয় এক বেড়াল মনে হয়। কিন্তু ভুল করবেন না— এটা কোনো পোষা বিড়াল নয়। এটা বদ্বীপের শ্বাপদ। যার রাজ্যে মানুষ অতিথি, আর নিয়ম সে-ই বানায়। সুন্দরবনের কাদা, লবণাক্ত পানি আর অরণ্যের গভীরে আজও সে ঘুরে বেড়ায়— নীরবে, গর্বে, ভয় ধরিয়ে।
বাংলেট।
নাম নিলেই সাবধান।