Thursday 18 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধ্বংসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা রিকুজেনটাকাটার মিরাকল পাইন

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:০৫

প্রকৃতি কখনো কখনো এমন এক নিষ্ঠুর রূপ নেয়, যা মানুষের সভ্যতাকে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে চুরমার করে দেয়। ২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানের তোহোকু উপকূলে ঠিক সেটাই ঘটেছিল। শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর আছড়ে পড়া ভয়ংকর সুনামি কেড়ে নিয়েছিল প্রায় ১৯ হাজার মানুষের প্রাণ, ধ্বংস করে দিয়েছিল শহর, গ্রাম আর জীবনের পরিচিত সব চিহ্ন। সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর, রিকুজেনটাকাটা শহরের তাকাতা-মাতসুবারা উপকূলে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় ৭০ হাজার পাইন গাছ এক নিমিষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে, সেই বিস্তীর্ণ পাইন বনের মাঝখানে একটি মাত্র গাছ দাঁড়িয়ে ছিল। চারপাশে মৃত্যু, ধ্বংস আর নীরবতার মাঝেও সে মাথা উঁচু করে ছিল অবিচল। পরে বিশ্ব একে চিনেছে ‘মিরাকল পাইন’ নামে— রিকুজেনটাকাটা বৃক্ষ।

বিজ্ঞাপন

একটি গাছের টিকে থাকার গল্প

প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল, প্রকৃতি বুঝি নিজেই এই গাছটিকে বেছে নিয়েছে বেঁচে থাকার জন্য। গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এর ছবি, সামাজিক মাধ্যমে মানুষ আবেগে ভেসে যায়। অনেকে একে ঈশ্বরের আশীর্বাদ, কেউ কেউ অলৌকিক ঘটনা বলেও ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল আরও জটিল ও বেদনাদায়ক।

সুনামির নোনা পানি মাটির ভেতরে ঢুকে পড়ায় গাছটির শিকড় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন—গাছটি কার্যত মৃত। সে আর স্বাভাবিকভাবে পানি টানতে পারে না, সালোকসংশ্লেষণও বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ, যে গাছটিকে সবাই জীবনের প্রতীক ভেবে বুকের ভেতর তুলে নিয়েছিল, সেটি তখন নিঃশব্দে মৃত্যুর পথে। কিন্তু জাপানিরা সহজে হাল ছাড়ে না।

যখন বিজ্ঞান হয়ে ওঠে সহমর্মিতা

রিকুজেনটাকাটার মানুষ ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে এই গাছটি কেবল একটি উদ্ভিদ ছিল না। এটি ছিল দুর্যোগ-পরবর্তী জাপানের মানসিক পুনর্জন্মের প্রতীক। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—এই গাছকে যেকোনো মূল্যে দাঁড়িয়ে রাখা হবে।

শুরু হয় এক অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক উদ্যোগ। উদ্ভিদবিদ, প্রকৌশলী, সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞরা একসঙ্গে বসেন। লক্ষ্য একটাই—গাছটির দৃশ্যমান অবয়ব সংরক্ষণ করা, যেন এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস আর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলতে পারে।

গাছটির পচে যাওয়া শিকড় ও কাণ্ডের ভেতরের অংশ সরিয়ে সেখানে ব্যবহার করা হয় অ-কার্বন কৃত্রিম উপাদান। ভেতরে বসানো হয় একটি শক্তিশালী ধাতব কাঠামো—এক ধরনের ‘মেকানিক্যাল স্কেলিটন’। বাইরে থেকে যেন এটি দেখতে পুরোপুরি জীবন্ত পাইন গাছের মতো লাগে, সেজন্য সংরক্ষিত আসল কাণ্ড ও ডালপালা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পুনরায় স্থাপন করা হয়।

এটি ছিল এক অর্থে গাছের কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন— বিশ্বে বিরল এক উদ্যোগ।

মরা, তবু জীবন্ত বার্তা

বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে, রিকুজেনটাকাটার মিরাকল পাইন আর জীবিত নয়। সে আর বাড়ে না, তার পাতায় আলো থেকে শক্তি তৈরি হয় না। কিন্তু তবু সে দাঁড়িয়ে আছে—ঝড়, বৃষ্টি আর সময়ের বিরুদ্ধে।

এই দ্বৈত বাস্তবতাই গাছটিকে আরও শক্তিশালী প্রতীকে পরিণত করেছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আশা সব সময় জীববিজ্ঞানের নিয়ম মেনে চলে না। কখনো কখনো মানুষ নিজেই আশাকে দাঁড় করিয়ে রাখে।

জাপানের অনেক গবেষক একে বিশ্বের প্রথম “সাইবর্গ ট্রি” বলেও উল্লেখ করেছেন— যেখানে প্রকৃতি ও প্রযুক্তি মিলেমিশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে।

কিছু জানা-অজানা তথ্য

রিকুজেনটাকাটা বৃক্ষের উচ্চতা প্রায় ২৭ মিটার। গাছটিকে বর্তমান অবস্থায় সংরক্ষণ করতে খরচ হয়েছে প্রায় দেড় মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বিপুল ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল—একটি মৃত গাছের পেছনে এত অর্থ কেন?

উত্তরটা জাপানিরা দিয়েছে নীরবে। কারণ দুর্যোগের পর মানুষ শুধু ঘরবাড়ি নয়, বিশ্বাসও হারায়। এই গাছটি সেই বিশ্বাস ফেরানোর একটি উপায়।

আজ এটি দাঁড়িয়ে আছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে, যেখানে প্রতিবছর হাজারো মানুষ আসে। কেউ ফুল রেখে যায়, কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কারও চোখে জল, কারও চোখে দৃঢ়তা।

একটি গাছ, একটি বিশ্ববার্তা

রিকুজেনটাকাটার মিরাকল পাইন আমাদের শেখায়— সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও সব গল্প শেষ হয়ে যায় না। কখনো কখনো একটি নিঃসঙ্গ গাছই হয়ে ওঠে হাজারো মানুষের কণ্ঠস্বর।

যখন পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে, জলবায়ু সংকট তীব্র হচ্ছে, তখন এই গাছ আমাদের প্রশ্ন করে—আমরা কি শুধু ধ্বংস গুনব, নাকি ধ্বংসের মাঝেও অর্থ খুঁজব?

রিকুজেনটাকাটার সেই একাকী পাইন গাছ আজ আর শুধু জাপানের নয়। এটি গোটা মানবজাতির জন্য একটি নীরব উচ্চারণ—

সবকিছু ভেঙে পড়লেও, আশা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর