দূর থেকে তাকালে মনে হবে— সমুদ্রের বুকে ভাসমান কোনো যুদ্ধজাহাজ। কাছাকাছি গেলে চোখে পড়ে কংক্রিটের স্তূপ, ভাঙা জানালা, নীরব বারান্দা। অথচ এক সময় এই দ্বীপেই জীবন ছিল ঠাসা— হাসি, কান্না, স্কুলের ঘণ্টা, সিনেমা হলের কোলাহল। জাপানের নাগাসাকি শহরের অন্তর্গত হাশিমা দ্বীপ, যাকে অনেকেই ‘ঘোস্ট আইল্যান্ড’ বা ভূতুড়ে দ্বীপ নামে চেনেন, আজও ইতিহাসপ্রেমী ও পর্যটকদের কৌতূহলের কেন্দ্রে।
সমুদ্রের মাঝে এক ক্ষুদ্র দ্বীপ
হাশিমা দ্বীপ নাগাসাকি শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আয়তনে মাত্র ৬.৩ হেক্টর— অর্থাৎ প্রায় ১৬ একর। কিন্তু আকারে ছোট হলেও ইতিহাসে এর অবস্থান বিশাল। নাগাসাকির ৫০৫টি জনশূন্য দ্বীপের মধ্যে এটি সবচেয়ে পরিচিত।
দ্বীপটির চারপাশে উঁচু সমুদ্রপ্রাচীর। এই প্রাচীর শুধু ঢেউ ঠেকানোর জন্য নয়, বরং যেন দ্বীপটিকে বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে রাখা এক প্রাচীন দুর্গ।
কয়লার খোঁজে গড়ে ওঠা শহর
উনিশ শতকের শেষভাগে জাপানে শিল্পায়নের জোয়ার। তখনই সমুদ্রের নিচে কয়লার সন্ধান মেলে হাশিমার আশপাশে। মিতসুবিশি কোম্পানি এখানে কয়লাখনি স্থাপন করে। ধীরে ধীরে শ্রমিক, প্রকৌশলী, কর্মকর্তা— সবাই আসতে শুরু করেন।
দ্বীপে তৈরি হয় বহুতল কংক্রিট ভবন, যা জাপানে প্রথম দিকের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলোর একটি। জায়গা কম, মানুষ বেশি— ফলে ভবনগুলো আকাশমুখী।
একসময়ের ব্যস্ত নগরজীবন
১৯৫৯ সালে হাশিমা দ্বীপের জনসংখ্যা পৌঁছায় সর্বোচ্চ ৫,২৫৯ জনে। ভাবা যায়? মাত্র ১৬ একর জায়গায় এত মানুষ! সেই সময়ে এটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনঘনত্বপূর্ণ স্থানগুলোর একটি।
দ্বীপে ছিল— স্কুল, হাসপাতাল, দোকান, সিনেমা হল, স্নানঘর, শিন্তো মন্দির, শিশুরা স্কুলে যেত, সন্ধ্যায় সিনেমা হল ভরে উঠত, ছাদে বসে মানুষ সমুদ্র দেখত। বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনই পড়ত না— হাশিমাই ছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর।
সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই
হাশিমার জীবনযাত্রা সহজ ছিল না। চারপাশে শুধু সমুদ্র। ঝড়-বৃষ্টি, টাইফুন ছিল নিত্যসঙ্গী। সমুদ্রপ্রাচীর ভেঙে গেলে পুরো দ্বীপ ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকত। তবু মানুষ মানিয়ে নিয়েছিল— কারণ কাজ ছিল, জীবন ছিল।
কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে সবচেয়ে বড় লড়াইটা ছিল কয়লার ভাণ্ডার ফুরিয়ে যাওয়া।
হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যাওয়া দ্বীপ
১৯৭০-এর দশকে জাপান ধীরে ধীরে কয়লার পরিবর্তে তেল ও অন্যান্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকে পড়ে। হাশিমার খনিতে কয়লার মজুতও কমে আসে। অবশেষে ১৯৭৪ সালে খনি বন্ধের ঘোষণা দেয় মিতসুবিশি।
এরপর যা ঘটেছিল, তা যেন সিনেমার দৃশ্য। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পুরো দ্বীপ ফাঁকা। মানুষ ঘর ছেড়ে চলে যায়, স্কুল বন্ধ হয়, দোকানের শাটার নামিয়ে দেওয়া হয়। কোলাহলময় দ্বীপ মুহূর্তেই নীরব।
তিন দশকের নিঃশব্দতা
পরবর্তী প্রায় ৩০ বছর হাশিমা ছিল সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। কংক্রিট ভবনগুলো ভাঙতে থাকে, জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে বাতাস, ছাদে জন্মায় গাছ। সমুদ্রের লবণাক্ত বাতাসে লোহা মরিচা ধরে।
এই নীরবতাই দ্বীপটিকে দেয় ‘ঘোস্ট আইল্যান্ড’ নাম। রাতে কেউ থাকলে হয়তো শুনতে পেত কেবল ঢেউয়ের শব্দ আর বাতাসে দুলতে থাকা ভাঙা দরজার কড়া।
সিনেমার পর্দায় হাশিমা
হাশিমার রহস্যময় পরিবেশ নির্মাতাদের নজর এড়ায়নি। ২০১২ সালে জেমস বন্ড সিরিজের Skyfall সিনেমার কিছু দৃশ্য অনুপ্রাণিত হয় এই দ্বীপ থেকে। এরপর আরও ডকুমেন্টারি, ভিডিও গেম ও ছবিতে হাশিমা উঠে আসে।
বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি
২০১৫ সালে ইউনেস্কো হাশিমা দ্বীপকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, ‘জাপানের শিল্প বিপ্লবের নিদর্শন’ হিসেবে। যদিও এ নিয়ে বিতর্কও আছে—বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জোরপূর্বক শ্রম ব্যবহারের ইতিহাস নিয়ে।
আজকের হাশিমা: পর্যটনের দ্বার খুলে
বর্তমানে সীমিত আকারে পর্যটকদের জন্য হাশিমা দ্বীপ খোলা হয়েছে। তবে নিরাপত্তার কারণে দ্বীপের মাত্র কিছু অংশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। ট্যুর গাইডের সঙ্গে নির্দিষ্ট পথ ধরে হাঁটতে হয়।
ভাঙা ভবনের মাঝে দাঁড়িয়ে অনেকেই ভাবেন— এইখানেই কি একসময় শিশুদের হাসি শোনা যেত?
এক দ্বীপ, এক শিক্ষা
হাশিমা দ্বীপ শুধু পরিত্যক্ত ভবনের গল্প নয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
শিল্পায়নের উত্থান ও পতন,
মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা,
আর উন্নয়নের পেছনে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো,
সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এই কংক্রিট শহর যেন ফিসফিস করে বলে— সব সাফল্যই চিরস্থায়ী নয়।
শেষ কথা
হাশিমা দ্বীপ আজ নীরব, কিন্তু তার ইতিহাস এখনো কথা বলে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এই দ্বীপ আমাদের শেখায়— শহর গড়ে ওঠে, শহর হারিয়ে যায়, কিন্তু গল্প থেকে যায়।