মিশরের গিজা মালভূমি মানেই চোখে ভাসে আকাশছোঁয়া পিরামিড, স্ফিংসের নীরব দৃষ্টি আর হাজার বছরের ইতিহাস। কিন্তু এই দৃশ্যমান বিস্ময়ের নিচে, মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে আরেক গিজা— যেখানে রহস্য, বিশ্বাস ও প্রত্নতত্ত্ব একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। গবেষকদের মতে, গিজার প্রকৃত রহস্যের বড় অংশই রয়েছে ভূগর্ভে।
মৃত্যুর দেবতা ওসিরিস: বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু
প্রাচীন মিশরীয় ধর্মবিশ্বাসে ওসিরিস ছিলেন মৃত্যুর দেবতা, পরকাল ও পুনর্জন্মের প্রতীক। তিনি কেবল মৃত্যু নয়, ন্যায়বিচার ও নতুন জীবনেরও দেবতা। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, মৃত্যুর পর আত্মা ওসিরিসের বিচারসভায় উপস্থিত হয়। তাই ওসিরিস শুধু এক দেবতা নন, বরং গোটা সভ্যতার আধ্যাত্মিক ভিত্তি।
পিরামিডের পাশেই পাতালের পথ
গিজার মেনকাউরে (Menkaure) বা খাফরে পিরামিড এলাকার কাছাকাছি একটি গভীর শ্যাফট বা সুড়ঙ্গ বহু আগেই গবেষকদের নজর কাড়ে। এটি পরিচিত ‘ওসিরিস শ্যাফট’ নামে। প্রথমে সাধারণ কূপ মনে হলেও পরে বোঝা যায়— এটি তিন স্তরবিশিষ্ট এক জটিল ভূগর্ভস্থ স্থাপনা, যার গভীরতম অংশ প্রায় পাতালের মতো।
তিন স্তরের রহস্যময় কাঠামো
এই শ্যাফটটি মূলত তিনটি স্তরে বিভক্ত…
প্রথম স্তর: তুলনামূলক অগভীর, যেখানে সাধারণ কক্ষ ও নিদর্শন পাওয়া গেছে।
দ্বিতীয় স্তর: আরও গভীরে, যেখানে খোদাই করা কক্ষ ও পথ দেখা যায়।
তৃতীয় স্তর: সবচেয়ে রহস্যময়—যেখানে স্থায়ী পানির স্তর রয়েছে এবং একটি পাথরের শবাধার বা সারকোফেগাস আবিষ্কৃত হয়েছে।
পানির মাঝে পাথরের শবাধার
সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি হলো—গভীর স্তরে পানির মধ্যে অবস্থিত একটি বড় পাথরের সারকোফেগাস। এটি এমনভাবে স্থাপন করা যে, চারপাশে সবসময় পানি জমে থাকে। অনেক গবেষক মনে করেন, এটি প্রতীকীভাবে মৃত্যুর পর পুনর্জন্মের ধারণার সঙ্গে যুক্ত—যেখানে পানি জীবন ও পুনর্জাগরণের প্রতীক।
সত্যিই কি ওসিরিস সেখানে শায়িত?
এখানেই আসে বিতর্ক। প্রত্নতত্ত্ববিদদের বড় অংশের মতে, এই স্থাপনাটি ওসিরিসের প্রতীকী সমাধী, প্রকৃত কবর নয়। কারণ ওসিরিস ছিলেন দেবতা, মানুষ নন। তবে প্রাচীন মিশরে দেবতাদের প্রতীকী সমাধী নির্মাণের নজির আছে। তাই সাধারণ মানুষের কৌতূহলে একে ‘ওসিরিসের সমাধী’ বলা হলেও, বৈজ্ঞানিকভাবে এটি একটি ধর্মীয়-অনুষ্ঠানিক কাঠামো বলেই বিবেচিত।
সারকোফেগাস খালি— নাকি আরও রহস্য লুকানো?
খননের সময় সারকোফেগাসটি খালি পাওয়া যায় বলে জানা যায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এটি কি আগে থেকেই খালি ছিল, নাকি সময়ের সঙ্গে কিছু হারিয়ে গেছে? কেউ কেউ মনে করেন, এটি কেবল আচার-অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হতো, যেখানে মৃতদেহ রাখা হয়নি।
অজানা ধাতু ও পাথরের দাবি
এই স্থাপনা ঘিরে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর দাবি হলো—এখানে নাকি এমন কিছু ধাতু ও পাথর পাওয়া গেছে, যেগুলোর সুনির্দিষ্ট পরিচয় এখনো স্পষ্ট নয়। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এ বিষয়ে সতর্ক। অনেক সময় অস্বাভাবিক সংমিশ্রণের পাথর বা ক্ষয়প্রাপ্ত ধাতুকে ‘অজানা’ বলা হয়, যা পরবর্তীতে বিশ্লেষণে পরিচিত উপাদান হিসেবেই চিহ্নিত হয়। তবু এই দাবি রহস্যপ্রেমীদের কল্পনাকে উসকে দেয়।
কেন এত গভীরে নির্মাণ?
একটি বড় প্রশ্ন হলো— কেন এত গভীরে, পানির নিচে এমন কাঠামো তৈরি করা হলো? গবেষকদের ধারণা, এটি ধর্মীয় প্রতীকবাদ। ওসিরিসের সঙ্গে পাতাল, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের সম্পর্ক থাকায় ইচ্ছাকৃতভাবেই এই নকশা বেছে নেওয়া হতে পারে।
সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার
সাধারণ পর্যটকদের জন্য এই শ্যাফট সবসময় খোলা থাকে না। বিশেষ অনুমতি, গবেষণা বা সীমিত ভিআইপি ট্যুরের মাধ্যমে কখনো কখনো প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়। খরচের অঙ্ক সময় ও অনুমতির ধরন অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে—যা অনেকের কাছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে মনে হয়।
গিজার রহস্য কি কখনো শেষ হবে?
পিরামিড, স্ফিংস, ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ—সব মিলিয়ে গিজা যেন এক জীবন্ত ধাঁধা। প্রতিটি আবিষ্কার নতুন প্রশ্ন তোলে, পুরোনো প্রশ্নের উত্তর খুব কমই দেয়। ওসিরিস শ্যাফটও তার ব্যতিক্রম নয়।
বিশ্বাস, বিজ্ঞান ও কল্পনার সংযোগস্থল
ওসিরিসের সমাধী—হোক তা প্রতীকী কিংবা বাস্তব—মানুষের কৌতূহল, বিশ্বাস ও কল্পনাকে এক সুতোয় বেঁধেছে। এখানেই গিজার প্রকৃত শক্তি। এটি শুধু পাথরের স্থাপনা নয়, বরং মানব সভ্যতার প্রশ্ন করার প্রবণতার প্রতীক।
শেষ কথা: রহস্যই গিজার প্রাণ
মিশরে রহস্যের যেন সত্যিই কোনো শেষ নেই। হয়তো ভবিষ্যতের প্রযুক্তি আজকের অজানাকে জানা করে তুলবে। আবার হয়তো কিছু রহস্য চিরকাল বালুর নিচেই ঘুমিয়ে থাকবে— ঠিক যেমন ওসিরিস, বিশ্বাস আর ইতিহাসের মাঝামাঝি কোথাও।