সাইকেলের কথা উঠলেই চোখে ভাসে দুই চাকার হালকা, ছোট্ট আর চটপটে এক বাহন। স্কুলে যাওয়া হোক, অফিস, পার্ক কিংবা অলিগলি— সাইকেল মানে হাসিখুশি স্বাধীনতা। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের একদল প্রকৌশলী যেন ভাবলেন, ‘সাধারণে আর কত? এবার অসাধারণ কিছু হোক!’— আর সেই ভাবনার ফলেই তৈরি হলো— বিশ্বের দীর্ঘতম বাইসাইকেল! দৈর্ঘ্যে মোট ১৮১ ফুট (ঠিক করে বললে ১৮০ ফুট ১১ ইঞ্চি!)।
এত লম্বা সাইকেল কল্পনা করতেই মাথায় আসে একটাই প্রশ্ন—
এটা কি চালানো যায়? নাকি শুধুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য?
না, একেবারেই চালানো যায়— আর তা-ই এই রেকর্ড ভাঙা সাইকেলের সবচেয়ে মজার দিক।
ইভান শ্যাক— দীর্ঘ স্বপ্নের দীর্ঘ সাইকেল…
৩৯ বছর বয়সী ডাচ প্রকৌশলী ইভান শ্যাক ছিলেন এই মহাপ্রকল্পের নায়ক। ছোটবেলা থেকেই গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের বই হাতে নিয়ে বড় হয়েছেন। বইয়ে দেখে নাকি ঠিক করেছিলেন— ‘একদিন এমন কিছু বানাবো, যা দেখলে পৃথিবী হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে!’
২০১৮ সালে তিনি পরিকল্পনা নিয়ে কাজে নেমে পড়েন। সময় কাটাতেন নানান নকশা, কাঠামো আর পরীক্ষামূলক মডেল নিয়ে। ধীরে ধীরে তার সাথে জুটে গেলেন আরও সাতজন প্রকৌশলী। লক্ষ্য একটাই— দুনিয়ার সবচেয়ে লম্বা সাইকেল বানানো।
এই সাইকেলের সামনে দাঁড়ালে মনে হবে যেন একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে আপনাকে দেখে হা করে আছে!
দৈর্ঘ্য: ১৮১ ফুট!
আগের রেকর্ড: অস্ট্রেলিয়ার ২০২০ সালের সাইকেল—১৫৫ ফুট ৮ ইঞ্চি।
পার্থক্য: প্রায় ২৬ ফুট বেশি!
এই দূরত্বে ঢাকার একটি মাঝারি সাইজের পার্কিং লট কিংবা দুইটা বড় বাস দাঁড়িয়ে যেতে পারে।
এত লম্বা সাইকেল বেয়ে সামনে ঠেলে নিয়ে যেতে গেলে নিশ্চয়ই জিমে মেম্বারশিপ লাগবে— এমনটাই প্রথমে মনে হয়; কিন্তু না, চালানোটা আশ্চর্যজনকভাবে সহজ!
চালানো এত সহজ কেন?
এই সাইকেলের স্টিয়ারিং আর প্যাডেল সিস্টেম এমনভাবে বানানো হয়েছে, যাতে—
একজন চালালেও চলে,
চাইলে কয়েকজন মিলেও চালাতে পারে,
স্থিতি (balance) ধরে রাখা আশ্চর্য সহজ,
কারণ পিছনের দিকে এবং মাঝ বরাবর বিশেষ support frames আছে, যা ওজনকে বিভক্ত করে। ফলে সাইকেলটা লম্বা হলেও বেশ স্থিতিশীল।
এ যেন সাইকেল নয়— একটা চলমান সরু ব্রিজ!
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড
বিশ্বের দীর্ঘতম সাইকেলের রেকর্ডটা নিজের মধ্যেই এক রোমাঞ্চকর গল্প।
১৯৬৫: জার্মানির কোলন শহরে প্রথম ৮ মিটার সাইকেল তৈরি হয়
এরপর নিউজিল্যান্ড, ইতালি, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া আর নেদারল্যান্ডস বারবার রেকর্ড ভেঙেছে
সারাবিশ্বে যেন রেকর্ড ভাঙা আর লম্বা সাইকেল বানানোর এক নীরব প্রতিযোগিতা চালু আছে। আর শেষ পর্যন্ত ইভান শ্যাকের ৮ জনের টিম সেটি নিয়ে গেল এক অন্য লেভেলে!
সাইকেল তৈরির পেছনে মজার বাস্তবতা
ইভান শ্যাকের কাছে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে— ‘এত লম্বা সাইকেল বানাতে এত সময় কেন লাগল?’
তাহলে তিনি হয়তো বলবেন— ছুটির দিন, পরিবার সামলানো, অফিসের কাজ আর মাঝে মাঝে ‘আজ কি সত্যিই এটা বানানো দরকার?’
সব মিলিয়ে ৬ বছর ধরে তিনি ধীরে ধীরে এগিয়েছেন। একপ্রকার শখ, একপ্রকার ধৈর্য—দুটো মিশে সৃষ্টি হলো নতুন ইতিহাস।
এরকম সাইকেল বানানোর বিজ্ঞান
লম্বা সাইকেল বানানো মানে শুধু লম্বা চাকা আর লম্বা লোহার ফ্রেম নয়। এখানে মূল বিষয়গুলো হলো—
স্থিতি নিয়ন্ত্রণ:
এত লম্বা সাইকেল যদি সামান্য ডানে-বামে দুলে, তাহলে ভেঙে পড়তে সময় লাগবে না। তাই বিশেষ অ্যালাইমেন্ট আর লম্বা সাপোর্ট ব্যবহার করা হয়েছে।
লোড বন্টন:
মোট দৈর্ঘ্যজুড়ে ওজন সমানভাবে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ভেতরে লুকানো আছে বহু সংযোগ বিন্দু।
ফ্লেক্স কন্ট্রোল:
১৮১ ফুট লম্বা ধাতব কাঠামো সামান্য নড়লেই টান লাগে। দলটি সেই টেনশন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ‘flex management’ প্রযুক্তি প্রয়োগ করেছে।
দলগত চালনার ক্ষমতা:
যাতে একা চালানো গেলেও আলাদা সেকশনে কয়েকজন প্যাডেল দিতে পারে—এমন নকশাও তৈরি হয়েছে।
লম্বা সাইকেলের ভবিষ্যৎ— এবার কি হবে ২০০ ফুট?
যত রেকর্ড, তত ভাঙন। বিশেষজ্ঞরা বলেন— এ রকম সাইকেল বানানোর কোনো বাস্তবিক প্রয়োজনে নেই, কিন্তু মানুষের সৃজনশীলতা যে কত দুর্দান্ত জায়গায় যেতে পারে, এটাই তার প্রমাণ।
আগামী দিনে হয়তো— কেউ বানাবে ২০০ ফুট!কেউ বানাবে এমন সাইকেল যা বাঁকানো। অথবা এমন সাইকেল, যেটা বহুতল ভবন ঘুরে ঘুরে যায়। রেকর্ড তৈরি যেমন মজা, ভাঙাটাও যেন আরও বেশি রোমাঞ্চকর।
সাইকেল নয়, এটা মানুষের সৃজনশীলতা
১৮১ ফুটের লম্বা সাইকেল দেখলে মনে হয় যেন পৃথিবীর সব অদ্ভুতুড়ে স্বপ্ন একসঙ্গে এসে ফ্রেমে বাঁধা পড়েছে। এটা শুধু লম্বা সাইকেল না— এটা মানুষের কল্পনা, আনন্দ, প্রযুক্তি আর উদ্ভাবনী চিন্তার এক বিশাল জীবন্ত উদযাপন।