রাজশাহী জেলার শান্ত, সবুজ পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এক ঐতিহাসিক নিদর্শন… যার গায়ে গায়ে লেগে আছে পাঁচ শতাব্দীর কালের সাক্ষ্য… বাঘা মসজিদ।
ঢাকা থেকে অনেক দূরে, রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৪১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে— বাঘা উপজেলার এই মসজিদ যেন আজও সেই সুলতানি আমলের গল্পগুলো চোখের সামনে তুলে ধরে।
১৫২৩ খ্রিস্টাব্দে, হুসেন শাহী বংশের শাসক সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ, এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য সংস্কার হলেও— মসজিদটির মহিমা, তার শৈল্পিক সৌন্দর্য, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব— অটুট রয়ে গেছে।
স্থাপত্য— যেখানে কারুকাজেই জীবন্ত ইতিহাস
২৫৬ বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদটি সত্যিই বিশাল! মাটির সমতল থেকে প্রায় ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচুতে তোলা আঙিনা— যেন দূর থেকেও বলে দেয়, ‘আমি যুগের সাক্ষী।’
ভেতরে রয়েছে ৬টি স্তম্ভ, আর উপরে ১০টি চমৎকার গম্বুজ। ৪টি কারুকার্যখচিত মিহরাব এবং ৫টি প্রবেশদ্বার মসজিদের সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
দেয়ালের গাঁথুনি চুন-সুরকি দিয়ে, আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়— মসজিদের দেয়ালজুড়ে রয়েছে অসংখ্য টেরাকোটা কারুকাজ। শাপলা ফুল, আমগাছ, লতাপাতা— আর তার সঙ্গে ফার্সি খোদাই শিল্পের সূক্ষ্ম নকশা… প্রতি ইঞ্চিই যেন জীবন্ত শিল্পকর্ম।
দিঘি— বাঘা মসজিদের শাহী সৌন্দর্যের আরেক বিস্ময়কর
মসজিদের ঠিক পাশেই রয়েছে বিশাল এক দিঘি— যাকে স্থানীয়রা বলে শাহী দিঘি। ৫২ বিঘা জমির ওপর বিস্তৃত এই দিঘিটি খোদ সুলতান নুসরাত শাহ জনকল্যাণে খনন করেছিলেন। চারদিকে সারি সারি নারিকেল গাছ, শীতের সময় অতিথি পাখির কলতান, চাঁদের আলোয় দিঘির জল যেন রূপকথার মতো ঝিলমিল করে। এ দৃশ্য যে কাউকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করবে।
মাজার ও রহস্যময় আবিষ্কার
মসজিদের উত্তর পাশে রয়েছে হজরত শাহ দৌলা ও তাঁর পাঁচ সঙ্গীর মাজার। ১৯৯৭ সালের খননে মাজারের পাশ থেকেই পাওয়া যায় আরেকটি চমক— ৩০ ফুট×২০ ফুট আয়তনের এক মহল পুকুর, যা নাকি একটি সুড়ঙ্গপথ দিয়ে অন্দরমহলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, এটি ছিল রাজপরিবারের বিশেষ ব্যবহারের জন্য নির্মিত গোপন জলাধার।
৫০০ বছরের ঐতিহ্য— বাঘার মেলা
প্রতি বছর ঈদুল ফিতরের দিন থেকে টানা তিন দিন এই মসজিদ প্রাঙ্গণে বসে বিখ্যাত ‘বাঘার মেলা’। এই মেলার বয়সও প্রায় ৫০০ বছর। শিল্প-সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান, লোকজ ঐতিহ্য— সব মিলিয়ে এ মেলা আজও বাঘার অন্যতম সাংস্কৃতিক পরিচয়।
বাঘা মসজিদ শুধু একটি স্থাপনা নয়— এটি বাংলার সুলতানি আমলের স্থাপত্য, ধর্মীয় ঐতিহ্য, আর সৌন্দর্যের এক চিরঅমলিন সাক্ষী।