Wednesday 10 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মহাস্থানগড়— আড়াই হাজার বছরের কিংবদন্তির নগরী

সানজিদা যুথী সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:২১

বাংলার বুকে কত ইতিহাস… কত সভ্যতার পদচিহ্ন! কিন্তু বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন নগরী— যার বয়স আজ আড়াই হাজার বছরেরও বেশি, সে নগরীর নাম— মহাস্থানগড়।

যিশু খ্রিষ্টের জন্মের শত শত বছর আগেই এখানে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ। ইতিহাসে যার পরিচিতি ছিল— পুণ্ড্রবর্ধন, পুণ্ড্রনগর, পৌণ্ড্রবর্ধন… ২০১৬ সালে মহাস্থানগড়কে ঘোষণা করা হয় সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী।

স্কন্দপুরাণের বর্ণনায় আছে— বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম কঠিন তপস্যার জন্য করতোয়ার তীরের এই স্থানটি আবিষ্কার করেন। তপস্যায় সিদ্ধিলাভের পর তিনি নাম দেন— ‘মহাস্থান’। আর পরবর্তীতে এখানেই গড়ে ওঠে পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী।

বিজ্ঞাপন

৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে চৈনিক পর্যটক ইউয়ান চোয়াং এসেছিলেন এই নগরীতে। বিবরণে লিখেছেন— তখন করতোয়া ছিল ভয়ানক বিস্তৃত একটি নদী।

মহাস্থানগড়— বাংলাদেশের প্রাচীনতম প্রত্ননগরীগুলোর একটি। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দেই এখানে বসতি ছিল। এটি ছিল পুণ্ড্ররাজ্যের রাজধানী।

৬৩৯–৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত চীনা ভিক্ষু হিউয়েন সাঙ এখানে এসে বর্ণনা দিয়ে গেছেন— এখানে তখন সমৃদ্ধ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। চীন–তিব্বত থেকে ভিক্ষুরা পড়তে আসতেন, আর এখান থেকে বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে যেত দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায়।

সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণসেনের সময়ে এই গড় অরক্ষিত হয়ে পড়ে। রাজা নল আর তার ভাই নীলের বিবাদের গল্প তখন লোকমুখে ছড়ায়। কথিত আছে— এ সময় ভারতের শ্রীক্ষেত্র থেকে এক অভিশপ্ত ব্রাহ্মণ, রাজা পরশুরাম বা রাম, এখানে আসেন।

আর ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য আসেন হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র.) — যিনি নাকি করতোয়া নদী পার হয়েছিলেন, এক বিশাল মাছের পিঠে চড়া নৌকা দিয়ে! এই কিংবদন্তি আজও স্থানীয় কাহিনিতে জীবন্ত।

মহাস্থানগড় অবস্থিত— বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৩–১৮ কিলোমিটার উত্তরে, করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম উচ্চ ভূমি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৬ মিটার উঁচু। পুরোনো দিনে এর এটাই ছিল সুরক্ষার প্রধান কারণ।

উপরে থেকে দেখলে এই দুর্গটি ছিল বড় একটি আয়তাকার শহর, যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ প্রায় ১.৫ কিমি। প্রতিটি পাশে বিশাল প্রাচীর, বিভিন্ন গেট, যেমন— কাঁটা দুয়ার, দোরাব শাহ তোরণ, বুড়ির ফটক, তাম্র দরজা।

ভিতরে রয়েছে— জিয়ৎ কুণ্ড মানকালীর ধাপ, পরশুরামের প্রাসাদ, বৈরাগীর ভিটা, খোদার পাথর ভিটা, জাহাজঘাটা, গোবিন্দ ভিটা এবং আরও অসংখ্য নিদর্শন।

মহাস্থানগড় ঘিরে প্রায় শতাধিক ঢিবি ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

গোকুল মেধ—যেখানে বেহুলা–লখিন্দরের বাসরঘর ছিল বলে লোককথা তোতারাম পণ্ডিতের ধাপ নরপতির ধাপ (ভাসু বিহার)।

১৮০৮ সালে ফ্রান্সিস বুকানন মহাস্থানগড় শনাক্ত করেন। ১৮৭৯ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম একে পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত করেন।

১৯৩১ সালে খননে পাওয়া যায়— ব্রাহ্মী লিপি, যেখানে সম্রাট অশোক দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে সাহায্যের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ খননে পাওয়া গেছে— ১৮টি নির্মাণ স্তর ও প্রাক– মৌর্য যুগের উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ পাত্র, রুলেটেড পাত্র, মাটির ঘর, চুলা— যা আদিম বসতির স্পষ্ট প্রমাণ।

মহাস্থানগড় শুধু বগুড়ার একটি প্রত্নস্থল নয়— এটি বাংলার রাষ্ট্র-ধর্ম-সভ্যতা-সংস্কৃতির এক মহাগ্রন্থ। হাজার বছরের উত্থান–পতনের গল্পে ভরা, কিংবদন্তি ও ইতিহাসের এক বিশাল জাদুঘর।

সারাবাংলা/এসজে/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

সানজিদা যুথী - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর