Tuesday 09 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আলোর সন্ধানে এক অগ্নিশিখা ‘বেগম রোকেয়া’

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:০৪ | আপডেট: ৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:০৫

বাংলার নারী জাগরণের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০–১৯৩২)। তিনি ছিলেন একাধারে চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী ও সমাজ সংস্কারক। যে সময়ে বাঙালি মুসলিম নারীরা ঘোর অবরোধের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, শিক্ষা ছিল তাদের কাছে প্রায় নিষিদ্ধ এক অধ্যায়—সেই চরম প্রতিকূল সময়ে রোকেয়া তার ক্ষুরধার লেখনী এবং কর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে নারীমুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন। মাত্র ৫২ বছরের জীবনে তিনি যে আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত করে গেছেন, তার দ্যুতি আজও আমাদের সমাজকে আলোকিত করে চলেছে।

জমিদার কন্যা, শিক্ষাব্রতী নারী

বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে। তার পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন বহু ভাষায় পারদর্শী, কিন্তু মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে ছিলেন রক্ষণশীল। তৎকালীন সমাজের কঠোর পর্দা প্রথার বেড়াজালে রোকেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল না। তবে তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী ও জ্ঞানপিপাসু।

বিজ্ঞাপন

ঘরের অভ্যন্তরেই তার দুই বিদ্যোৎসাহী ভাই, বিশেষত বড় ভাই ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের, এবং শিক্ষানুরাগী বোন করিমুননেসার সহায়তায় তিনি গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন। সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে তার এই স্ব-শিক্ষাই ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের ভিত্তি স্থাপন করে। এই সময় থেকেই তার মনে নারী সমাজের প্রতি যে গভীর মমত্ববোধ ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়, তাই পরবর্তীকালে তার সাহিত্য ও আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হয়েছিল।

স্বামী, অনুপ্রেরণা ও নিঃসঙ্গতা

মাত্র ১৬ বছর বয়সে (১৮৯৬ খ্রি.) রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। স্বামী ছিলেন উদার, মুক্তমনা ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। তিনি শুধু রোকেয়ার জ্ঞানচর্চায় উৎসাহ দেননি, বরং তাকে লেখালেখিতেও অনুপ্রেরণা জোগান। স্বামীর সান্নিধ্যে এসেই রোকেয়ার জ্ঞানচর্চার পরিধি বিস্তৃত হয় এবং তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গল্পের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন।

তবে এই দাম্পত্য জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াত হোসেন আকস্মিকভাবে মারা যান। ইতোপূর্বে তাদের দুটি কন্যাসন্তানও অকালে মারা গিয়েছিল। স্বামীর অকাল মৃত্যু রোকেয়াকে নিঃসঙ্গ করে তুললেও, তিনি ভেঙে পড়েননি। বরং স্বামীর দেওয়া অর্থে এবং তার উৎসাহকে পাথেয় করে তিনি নারী শিক্ষা বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন।

সাহিত্যের তলোয়ার: তীক্ষ্ণ ও মানবিক

বেগম রোকেয়ার সাহিত্যকর্ম ছিল মূলত সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার। তার লেখনী ছিল যুক্তিনিষ্ঠ, কৌতুকপ্রদ এবং একই সাথে সমাজের অসংগতি ও কুসংস্কারের প্রতি তীব্র কশাঘাত। মুসলিম নারী সমাজের শোচনীয় অবস্থা, বিশেষত ‘অবরোধ প্রথা’-র বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন।

তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে—

‘মতিচূর’ (১ম ও ২য় খণ্ড): প্রবন্ধ সংকলন, যেখানে তিনি নারী-পুরুষের সম-অধিকার, নারী সমাজের অবনতির কারণ এবং সমাধানের পথ নিয়ে আলোচনা করেছেন।

‘সুলতানার স্বপ্ন’ (Sultana’s Dream): এটি বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের এক মাইলফলক। এক কল্পরাজ্যের চিত্র যেখানে পুরুষের উপর নারীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং নারীরা স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চা ও সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে।

‘পদ্মরাগ’: এটি তার একমাত্র উপন্যাস, যেখানে নারীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

‘অবরোধ-বাসিনী’: নকশাধর্মী এই গ্রন্থে অবরোধ প্রথার করুণ ও হাস্যকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

তার সাহিত্যে ঘোষিত হয়েছিল মানুষ হিসেবে নারীর আত্মসম্মান ও নিজস্ব অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার কথা। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, কলম তরবারির চেয়েও শক্তিশালী হতে পারে।

শিক্ষাই মুক্তির পথ: আলোর দিশারী

বেগম রোকেয়া উপলব্ধি করেছিলেন, নারীকে মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি নারী শিক্ষা প্রসারের কঠিন ব্রত গ্রহণ করেন।

সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল (১৯১১): স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর ভাগলপুরে ৫ জন ছাত্রী নিয়ে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। পারিবারিক কারণে সেটি বন্ধ হয়ে গেলে, ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে তিনি কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউলাহ লেনে নতুন করে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।

অক্লান্ত সংগ্রাম: প্রতিকূল সমাজে মেয়েদের স্কুলে আনা ছিল এক অসম্ভব কাজ। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়েছেন, মেয়েদের আনা-নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছেন— এমনকি অনেকে যাতে ধর্মীয় কুসংস্কারের দোহাই দিতে না পারে, সেজন্য তিনি ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে যাননি, বরং যুক্তি দিয়ে কুসংস্কার খণ্ডন করেছেন।

আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিনে ইসলাম (১৯১৬): শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠাই নয়, মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে তিনি এই সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল নিরক্ষর ও দরিদ্র নারীদের আত্মনির্ভর করে তোলা এবং তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা।

তার অক্লান্ত পরিশ্রমে স্কুলটি ক্রমে মধ্য ইংরেজি গার্লস স্কুলে এবং পরবর্তীতে উচ্চ ইংরেজি গার্লস স্কুলে রূপান্তরিত হয়।

উত্তরাধিকার ও প্রাসঙ্গিকতা

১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন। তার জীবনকাল ছিল সংক্ষিপ্ত, মাত্র ৫২ বছর। কিন্তু এই স্বল্প পরিসরের জীবনে তিনি যে কাজ করে গেছেন, তা আজও নারী সমাজের কাছে এক অফুরন্ত প্রেরণার উৎস।

বেগম রোকেয়া কেবল শিক্ষাবিদ বা সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সাহসী সমাজ সংস্কারক যিনি নারীকে ‘অর্ধাঙ্গী’র ধারণা থেকে মুক্ত করে সমাজের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তার প্রবর্তিত নারীশিক্ষা আন্দোলন এবং তার নারীবাদী সাহিত্য আজও বিশ্বজুড়ে প্রাসঙ্গিক। আজকের নারী সমাজের অগ্রগতি বেগম রোকেয়ার সেই ঐতিহাসিক সংগ্রামেরই ফল। প্রতি বছর তার জন্ম ও মৃত্যুদিবস, ‘রোকেয়া দিবস’ (৯ ডিসেম্বর), আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, নারী-পুরুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য এখনো অনেক পথ চলা বাকি— আর সেই পথে বেগম রোকেয়াই আমাদের আলোর দিশারী।

বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর